..
অন্যের সাথে ভাববিনিময়ের জন্যই শুধু নয় --ভাষা আমরা ব্যবহার করি নিজের সাথে কথোপকথনের জন্যেও। আমাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো কখনো নির্বাক নয়। সেই চিন্তা-ভাবনাগুলো অন্যেরা শুনতে না পেলেও আমরা আমাদের নিজের ভেতরে কথাগুলোকে সাজাই-গুছাই--সিদ্ধান্ত নেই। অর্থাৎ একটা মানুষের সার্বক্ষণিক সঙ্গী তার ভাষা। চিন্তাশুন্য মানুষ যেমন কল্পনা করা যায়না তেমনি ভাষাহীন মানুষও নয়।
বোবারও নিজস্ব ভাষা আছে। চিন্তার বাহনই হলো ভাষা। আমাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো কখনো আমরা নিজের ভেতরেই রেখে দেই, কখনো শেয়ার করি অন্যের সাথে,কখনোবা লিখে রাখি কাগজে- কলমে। ভাষা আমাদের মনও মননের প্রতিনিধি। আবেগ-অনুভবের বাহক।
একজন মানুষকে চিনতে হলে ,বুঝতে হলে,তার সাথে ভাবের আদান-প্রদান করতে হলে সাহায্য নিতে হয় ভাষার। স্থান ভেদে কাল ভেদে ভাষা ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয়। অর্থাৎ ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল। যুগে যুগে ,স্থানান্তরে মানুষের মুখের ভাষা বিবর্তিত হয়---বদলে যায়। আমার নিজের ভাষা আমার নিজের ভৌগলিক অবস্থানের ---জন্মভূমির প্রতিনিধিত্ব করে।
আমি বাংলায় কথা বলি,আমার কথ্য ভাষা বাংলা অর্থাৎ আমি একজন বাংগালী।
একজন ইংরেজ ইংরেজীতে কথা বলে। একজন আরব আরবীতে। আবার ব্যতিক্রমও আছে। মনে করি --বাঙ্গালী মা-বাবার সন্তান কিন্তু লালিত -পালিত হলো একটি ভিন্নভাষী পরিবারে ।
তার ভাষা কিন্তু বাংলা হবেনা। তার ভাষাও হবে ওই ভিন্নভাষা---যেখানে সে বড় হয়েছে। অন্য কথায় যার যার আজন্ম লালিত পরিবেশেই গড়ে উঠে মানুষের নিজের ভাষা।
একজন মানুষের নিজের ভাষা তার স্বকীয়তা-মৌলিকত্বের নির্দেশক। মানুষ নিজেকে যেমন ভালবাসে ---নিজস্ব স্বকীয়তা,নিজস্ব পরিচিতি, নিজস্ব স্বাধীনতাকে তেমনি ভালবাসে।
এতে কোনরূপ বাধা বা প্রতিবন্ধকতা কাম্য নয় কখনোই। এর ব্যত্যয় হলেই সৃষ্টি হয় অসন্তোষের ---যার ফলশ্রুতি বিদ্রোহে রূপান্তরিত হতে সময় লাগেনা।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের স্বাধীনচেতনার,আমাদের মৌলিকত্বের প্রতি গভীর অনুরাগের প্রতীকি ইতিহাস হয়ে আছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য,প্রেরণা বা তাৎপর্য নিছক বাংলাভাষায় কথা বলা অথবা লিখতে পারার জন্যেই ছিলনা। এর মূল উদ্দেশ্য বা প্রেরণা আরো অনেক গভীরে প্রোথিত।
পৃথিবীর মানুষ আজ আর শুধু নিজের ঘরের ভিতর আবদ্ধ নেই। মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবী জুড়ে। এ দেশের মানুষ যেমন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে--তেমনি আমাদের দেশেও ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আগত মানুষের অভাব নেই। বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় আমরা কথা বলিনা বা বলবোনা একথাটি ঠিক নয়। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাকেও গ্রহণ না করলে জ্ঞান-বিজ্ঞান বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে সেটাও আমাদের কাম্য হতে পারেনা।
আগেই বলেছি ভাষা আন্দোলন কেবলমাত্র বাংলাভাষায় কথা বলার আন্দোলন ছিলনা---এটা ছিল আমাদের অস্তিত্বের স্বীকৃতির লড়াই। আমাদের স্বাধীন-স্বতন্ত্র সত্ত্বার অধিকার প্রতিষ্ঠার ,মর্যাদা রক্ষার লড়াই। নিপীড়ন -নির্যাতন-নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে ,অবহেলা-বঞ্চনার বিরুদ্ধে,কারো ক্রীড়নক হয়ে থাকার বিরুদ্ধে ---যে জাতিসত্ত্বাটি গুমরে গুমরে মরছিল,তিল তিল করে যে ক্ষোভগুলো জমা হয়ে ভিতরে ভিতরে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের জন্ম দিচ্ছিল --তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে বাহান্নতে। সেই আন্দোলন ছিল আমাদের জাগরণের আন্দোলন। আত্মোপলব্দির আন্দোলন--যার হাত ধরে আজ আমরা একটা স্বাধীন পতাকার অধিকার অর্জন করেছি।
পৃথিবীর মাণচিত্রে 'বাংলাদেশ' নামের একটি স্বাধীন ভূখন্ডের নাম লিখেছি।
কোন আন্দোলনের রাস্তাই ফুল বিছানো থাকেনা। যে কোন আন্দোলনের সাফল্য--অনেক ত্যাগ, ধৈর্য , অধ্যবসায় এমনকি অনেক রক্তপাতও দাবী করে। উদাহরণস্বরূপ '১লা মে' শ্রমিক দিবসের কথাই ধরি। ১৮৮৬খ্রীষ্টাব্দে শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কর্মঘন্টার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য শিকাগোর রাজপথ রক্ত-রঞ্জিত করে শ্রমিকেরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল,নির্দিষ্ট কর্মঘন্টার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছিল।
তাদের ত্যাগের সুফল আজ আন্তর্জাতিক ভাবে সমস্ত বিশ্বের শ্রমিকেরা ভোগ করছে। সমগ্র বিশ্ব প্রতি বৎসর '১লা মে 'সেসব আত্মোৎসর্গকারী শ্রমিকদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তেমনি করেই আমাদের যে সোনার ছেলেরা রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে আমাদের ভাষা তথা মৌলিকত্বের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিল ---বিশ্ববাসী তাদের সেই আত্মত্যাগকে পরম শ্রদ্ধায় স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের '২১ ফেব্রুয়ারী 'আজ আর শুধু আমাদের নয়--সমগ্র বিশ্বের 'ভাষা দিবস' রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ আমাদের অনেক বড় গৌরব---অনেক বড় অহংকার ।
কিন্তু আমাদের এই গৌরবকে বিশ্ব-দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত-মহীয়ানরূপে দেখতে চাইলে আমাদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে 'বাংলাদেশ ' নামক দেশটিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে। যে দেশের ছেলেরা ভাষার জন্য প্রাণ দিতে ইতস্তত করেনি--স্বাধীনতার জন্য বুলেটের সামনে নির্দ্বিধায় বুক পেতে দিয়েছিল ----সে দেশ দেশদ্রোহী-স্বাধীনতাবিরোধীদের আবাসভূমি হবে ভাবা যায়না। যে মাটিতে শত শহীদের পবিত্র রক্তস্রোত বয়ে গেছে সে মাটিতে বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াবে স্বাধীনতাবিরোধীরা এই নির্মম পরিহাস কিছুতেই মেনে নেওয়া যায়না। আবার কিছু লালসা-গ্রস্ত মানুষের দুর্নীতিগুলো যা এদেশের উন্নয়নের প্রতিবন্ধক তাদের এই কর্মকান্ডগুলোকেও মেনে নেওয়া যায়না।
এসব অগৌরবের হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করে তার হৃতমর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে হবে আমাদের সবাইকে মিলেমিশে---দলমত নির্বিশেষে। পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারিত হোক ---'দেশপ্রেমিক বনাম দেশদ্রোহী-স্বাধীনতাবিরোধী'--এভাবে। শুধুমাত্র দল বিভাজন করে অনৈক্য সৃষ্টি করে রাখলে বিশ্বাসঘাতক অপশক্তিগুলোই বারবার জয়ী হবে।
নিজের প্রাণের থেকেও দেশ বড় সে প্রমাণ রেখে গেছে আমাদের শহীদেরা । তাহলে তাদের উত্তরসূরীরা কেন দেশকে দলের উর্ধ্বে স্থান দিতে পারবেনা?কারো পছন্দের দল ক্ষমতায় যেতে না পারলে সেকি সরকারী দলের সমস্ত ভাল কাজগুলোকেও বিরূপ দৃষ্টিতে দেখবে,বিরূপ সমালোচনা করবে --যাচাই-বাছাই ছাড়াই? আর যার পছন্দের দল ক্ষমতাসীন তারা সরকারের অন্যায় কাজগুলোও চুপ থেকে হজম করে যাবে নিজের মনোনীত দল বলে?এই মানসিকতা বলতে দ্বিধা নেই আমাদের অধিকাংশের মাঝেই আছে ।
এবং এটা হলো আত্মঘাতী-মানসিকতা। আমাদের সমস্ত পশ্চাৎপদতার মূল কারণ এটাই। যতদিন পর্যন্ত আমরা এই দলাদলিকে দেশের উন্নয়নের থেকেও বেশী প্রাধান্য দেবো ততদিন পর্যন্ত দেশ যে অন্ধকার-গহ্বরে পড়ে আছে সেখানেই পড়ে থাকবে। কারণ জনগণই শক্তি। জন-প্রতিরোধের মুখে কোন অন্যায় যেমন প্রশ্রয় পেতে পারেনা তেমনি জনগণের সহায়তা ছাড়া কোন উন্নয়ন তৎপরতার সাফল্যের সম্ভাবনাও কমে যায়।
জনমতের অনেক বড় ভূমিকা আছে রাষ্ট্র পরিচালনায়,রাষ্ট্রের উন্নয়নে।
ভাষা আন্দোলনের এই ঐতিহাসিক মাসটিতে আমাদের সকলের শপথ হোক দেশ গড়ার । স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে নির্মূল করার। দেশকে স্থান দিন সবার উপরে। দল নয় ----দেশকে ভালবাসুন।
ভাষা আন্দোলনের এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এটাই আমাদের একমাত্র এবং শ্রেষ্ট উপায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।