যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
[ব্লগার অক্ষরের জ্বীন বিষয়ক পোস্টটা দেখে মনে হলো, নিজের অভিজ্ঞতার একটি ব্যাখ্যার অযোগ্য ঘটনা সবার সাথে শেয়ার করি। ]
(নোট: পুরোপুরি সত্য ঘটনা)
\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\_\
সম্ভবতঃ পিএইচডির সেকেন্ড ইয়ারের কথা। এসময়টাই এপর্যন্ত জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়, হাজার রকমের চিন্তা মাথায়! এক্সপেরিমেন্টের রেজাল্ট আশানুরূপ হচ্ছেনা, নেক্সট পেপারটা আটকে আছে, সময়মতো ডিগ্রী হবে কিনা, কদ্দিন পর চাকরী খোঁজা শুরু করতে হবে, নেক্সট উইকের ওয়ার্কশপের জন্য পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড ঠিক করো -- এরকম হাজারো ঝামেলা! প্রতিদিন ল্যাব থেকে ফিরতে ফিরতে রাত দুটা, তিনটা বাজে। আমাদের ল্যাবটা, মানে ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাম্পাসটা ছিলো পাহাড়ের উপরে। শহর থেকে একটা রাস্তা সোজা চলে গিয়ে উপরে উঠে গেছে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে, সেই পথ ধরে দিনের বেলা বাসেই যেতাম ক্যাম্পাসে, কিন্তু গভীর রাতে যখন ফিরতে হতো, তখন আর বাস থাকতোনা।
লাস্ট বাস ছিলো রাত দশটা ছয় মিনিটে, এরপর বাসায় ফিরতে হলে উপায় একটই -- হাঁটো। কাজেই রাত দুটো/তিনটার সময় হেঁটে হেঁটে ফিরতে হতো ল্যাব থেকে বাসা পর্যন্ত সারে টিন কিলোমিটারের পথ।
জাপানের ঘরবাড়ী/ অফিস বা অন্যান্য বিল্ডিংগুলোতে যেমন আলোর ব্যবহার খুব বেশী, তার সাথে সমানুপাতিকভাবে রাস্তায় যেন আলোর ব্যবহার ততটাই কম। টোকিওর মতো শহরেও একটু রাত হলেই রাস্তায় বের হলে "শুনশান নীরবতা"র অনুভূতি হয়, আর সেখানে সেনদাই শহরের নির্জন পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে যখন নিচে নেমে আসতাম, তখন কিরকম অনুভূতি হতে পারে -- কল্পনা করতে পারছেন নিশ্চয়ই। অনেক দূরে ল্যাম্পপোস্ট দেখা যেত একেকটা, তাও ল্যাম্পপোস্টের পাশেই যে পাহাড় উপরে উঠে গেছে তার গা বেয়ে জন্মানো ঘনজঙ্গলের গাছের ছায়ায় ল্যাম্পপোস্টের আলোর বারোআনাই যেন গায়েব হয়ে যেত।
প্রায় বছর দুয়েক অন্ততঃ সপ্তায় তিনদিন এই পাহাড় বেয়ে নেমেছিলাম, তারপরও শেষ দিন পর্যন্ত ঐ রাস্তা বেয়ে নামার সময় আমার গা ছমছম করতো।
এমনই এক দিনের ঘটনা!
গা ছমছম অনুভূতি নিয়ে দুরূদ কলেমা পড়তে পড়তে পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে লোকালয়ে চলে এসেছি, তারপর খানিকটা নিশ্চিন্তে গুনগুন করতে করতে বড় রাস্তা পার হয়ে আমার ডর্মের মোটামুটি আধ কিলোমিটার কাছাকাছি চলে গেছি, কারণ সেটুকু পথে আলো ছিলো, মানুষজনও দেখা গেছে। এখানে আসল যে কথাটা বলা হয়নি, তা হলো, রাত দুটো-তিনটের সময় ফিরতে ঐ পাহাড় ভাংতে যতটা না গা ছমছম করতো, তার চেয়ে বেশী গা ছমছম করতো এই ডর্মের আধ কিলোমিটার কাছের অংশটায় এলে। কারণ, এখানে একটা শর্টকাট পথ ছিলো। একটা বিশেষ শিন্তো মন্দির ছিলো এ জায়গাটায়, ডেড এন্ডের মতো।
মন্দিরের পাশেই গাড়ী রাখার যে পার্কিং ছিলো সেটার মধ্য দিয়ে মন্দিরের ওপাশে চলে গেলে একটা সরু গলি ছিলো। এই গলি দিয়ে মন্দিরের পেছনে চলে গেলে, সাধারণ পিচের রাস্তার অনেকখানি না হাঁটলেও চলতো। ফলে, অন্ততঃ দশ মিনিটের পথ বাঁচত। গভীর রাতে যত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারি তত ভালো -- এই কারণে শর্টকাটেই যেতাম। এখানেই মূল সমস্যাটা হলো।
শিন্তো মন্দিরটা বিশেষ ছিলো একারণে যে, এর মূল ঘরটায় মৃত মানুষদের আত্মারা থাকে বলে জাপানীরা বিশ্বাস করতো। অগাস্টের মাঝামাঝি এ মন্দিরে মৃত আত্মীয়দের শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল নামে। তার সাথে যোগ হওয়া আরেকটা ভূতুড়ে ঝামেলা হলো, পার্কিংয়ের মধ্য দিয়ে মন্দিরের ওপাশে চলে গেলে যে ভয়াবহ রকমের সরু গলিটা দিয়ে (বিশ পঁচিশ মিটার হবে) যেতে হতো, তার একপাশে ছিলো মন্দিরটা, আর অন্যপাশে কবরস্থান। জাপানী কবরস্থানে মৃতদেহ থাকেনা, শুধু মৃত পোড়ানো ছাইয়ের একাংশ গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভের উপর রেখে দেয়া থাকে -- এসব কথাটথা বলে আমরা কবরখানার পাশে হাঁটার ভয় কাটাতাম। তারপরও ঘুটঘুটে অন্ধকারের গভীর রাতে যখন চারদিক ভয়াবহ রকমের নীরব, তখন সেই সরু গলির মধ্য দিয়ে বের হয়ে যেতে একটা অদ্ভুত ভয় অনুভব করতাম।
যতদিন রাতে সে রাস্তা দিয়ে গিয়েছি, নিজের অজান্তেই হাঁটার গতি বাড়িয়েছি। মাঝেমাঝে দৌড়েও পার হয়েছি।
এরকম অন্ধকার আর ভুতূড়ে গলি পার হতে সাহায্য করতো আমার মোবাইল ফোনটা, কারণ, ওটার ছবি তোলার যে ফ্ল্যাশলাইটটা ছিলো, সেই ফ্ল্যাশলাইটটাকেই আবার টর্চ হিসেবেও ব্যবহার করা যেত -- সেজন্য মোবাইলে আলাদা একটা বাটনই ছিলো। আমি মনের সুখে মোবাইলের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে একই সাথে রিস্কি এবং গা ছমছম করা মন্দির আর কবরস্থানের মাঝের সরু গলি পার হতাম। টর্চলাইটটা একদম সবচেয়ে উজ্জ্বল করে জ্বালিয়ে রাখতাম ঐ পথটুকু।
যেটা বলছিলাম, সেদিনও আর অন্য পাঁচদশদিনের মতোই মোটামুটি তিন কিলোমিটার হেঁটে সেই মন্দিরের কাছে এসে পৌঁছলাম। প্রতিদিনের মতো এদিনও আমার মনে হলো শর্টকাটে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে যাবো, নাকি ঘোরাপথে বীরের মতো যাবো? শরীরে ক্লান্তি, দুচোখে ঘুম, পারলে রাস্তায়ই শুয়ে পড়ি এমন অবস্থা, কাজেই আর সব দিনের মতোই শর্টকাটই বেছে নিলাম।
পার্কিং পেরিয়ে গলির মুখে ঢুকতেই কেন জানি হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল আজাজীলের কথা। ডেনজেল ওয়াশিংটনের কোন একটা মুভিতে দেখেছিলাম, শয়তানের প্রতিরূপ আজাজীলের কাহিনী। হঠাৎ সেসময়ই আজাজীলের কথা কেন মনে পড়লো আমি আজও জানিনা।
যাই হোক, টর্চ জ্বালিয়ে, টর্চ ধরা হাত উপরে তুলে যতটা সম্ভব সামনের পথটা আলোকিত করে হাঁটা দিলাম।
কিন্তু গলিতে ঢুকে পড়তেই একটা বাতাসের হাল্কা দমকা লাগলো যেন গায়ে। তখনই সামনের তাকিয়ে দেখি গলির অন্যমুখ থেকে কে একজন যেন ঢুকছে, এদিকেই আসছে। শীর্ণকায় একলোক, মুখ নীচু করে রাখা, আর জ্যাকেটের হুড দিয়ে মাথা ঢাকা থাকায় কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। গভীর রাত, আসলেই কেমন যেন ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগলো।
লোকটাকে ঠিক যে মুহূর্তে দেখলাম, তখন আমি অলরেডী গলির ভেতরে দুচার মিটার ঢুকে গেছি। গা ছমছম করে উঠলো, হার্টবিট বেড়ে গেল। আমি প্রাণপণে হাতের টর্চ লোকটার দিকে ঘোরালাম। আর তখনই, ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটলো!!
আমার টর্চ নিভে গেলো! ভীষন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!! উর্ধশ্বাসে হাঁটতে লাগলাম আর টর্চের বাটন পুশ করতে লাগলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলোনা।
আলো জ্বলছেনা! "হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে" ভাবতে ভাবতে আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গলি পার হতে লাগলাম, আবার মাথায় এই ভয়টাও চাপলি, "এখনই নষ্ট হলো কেন?"। এক সময় লোকটা পাশ দিয়ে হেঁটে পারও হয়ে গেল। লোকটা ঠিক যে মুহূর্তে অতিক্রম করল, সে মুহূর্তটা আমার এখনও মনে আছে। বীভৎস এক অনুভূতি! মনে হচ্ছিলো একটা অসভ্য পিশাচের পাশ দিয়ে যাচ্ছি -- জীবনে আর কখনও এমন গা ঘিনঘিনে অনুভূতি হয়নি! আরেকটা ব্যাপার, ভয় পেয়েছি বলেও মনে হতে পারে, সেটা হলো লোকটা যখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো আমার মনে হচ্ছিলো এর কোন পায়ের আওয়াজ হচ্ছেনা। তবে অতিরিক্ত টেনশনে লোকটার ব্যাপারে আর কিছুই খেয়াল করা হয়নি।
পাশ কাটিয়ে চলে যাবার পর পেছন ফিরে আর লোকটাকে দেখার সাহসও হয়নি।
তবে আসল ঘটনা ঘটলো গলি থেকে বের হবার পরেই। বের হবার পর পরই কিছু না ভেবে কোনদিকে না তাকিয়ে আমি কয়েক সেকেন্ড শুধু ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়েছিলাম। আর তখনই খেয়াল করলাম ব্যাখ্যার অযোগ্য ব্যাপারটা। আমার ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে শক্ত করে টিপে ধরে রাখা টর্চটা জ্বলছে!!!!
সেই টর্চ আর কখনো নষ্ট হয়নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।