সত্যবাদী এক
২৯ জুলাই ২০১১।
দিনের শুরুটা খুব একটা ভালো ছিলোনা। ছোট্ট একটা ব্যপার নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে নিলুর সাথে। মিসডকল পেয়েও ফোন করতে দেরী করাতেই বিপত্তি। আজকের দিনে বাকি কাজগুলতেও যে ঘাপলা হবে সেটা বোঝা উচিৎ ছিল তখনি।
এই মুহূর্তে আমরা যেই ঘরটায় বসে আছি, সেটা বিশ ফিট বাই পনের ফিট। আসবাব বলতে বেতের তৈরি কয়েকটি সোফা। দেয়ালে থাক থাক করে সাজান বইয়ের সংখা নিদেনপক্ষে হাজারের কাছা কাছি হবে। পর্যাপ্ত আলো নেই ঘরটিতে। মনে হয় ইচ্ছে করেই একটু আলো আধারি তৈরি করা হয়েছে।
ঘরটিতে আমরা চারটি প্রাণী। আমি আর আমার বন্ধু রাশেদ একপাশে; অন্যপাশে বাড়ির মালিক আবুল হোসেন তার পোষা বেড়ালটি কোলে নিয়ে বসে আছেন।
-আমি ভেবেছিলাম আপনাদের বয়স আরেকটু বেশি হবে। You two look so young!!
আমরা একটু বিব্রত হাসি দিলাম। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের কিছুটা উপরে হবে।
জুলফিতে পাক ধরেছে। চোখের নিচের ভাঁজটা বুঝিয়ে দিচ্ছে উনার মদ্যপানে আসক্তি রয়েছে। ভদ্রলোক আলতো ভঙ্গিতে আদর করছেন বেড়ালটিকে। বনানীর এই বাসাটি আবুল হোসেন নিরবিলি নাম দিয়েছেন।
-আমরা আসলে শখের সাংবাদিকতা করি।
দুজনেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি; ফাইনাল ইয়ার।
-হুম। আমার ছোট ছেলেটা আপনাদের সমবয়সী হবে বোধ করি।
আবুল সাহেব বাংলাদেশের অন্যতম সফল ব্যবসায়ীদের একজন। আমি আর রাশেদ ‘একজন সফল ব্যবসায়ীর দিনলিপি’ নামে একটা ফিচার করবো একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায়।
তারই ফলশ্রুতিতে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে আজকের এই সাক্ষাতের আয়োজন করতে পেরেছি। কিন্তু আবুল হোসেন সাহেবের রাশভারী মেজাজের কারণে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা কিভাবে শুরু করবো সাক্ষাৎকার পর্বটা।
রাশেদ একটু গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করল; ‘স্যার, আপনার শৈশব সম্পর্কে কিছু বলুন। ‘
আবুল সাহেব স্মিত হাসলেন। তারচেয়ে বরং তোমাদের একটা গল্প বলি?
আমি আর রাশেদ একে অপরের মুখ চাইলাম।
ভদ্রলোক আমাদের নার্ভাস বোধটাকে বেশ উপভোগ করছেন। একটু বিরক্ত লাগলো, এভাবে চললে আর সাংবাদিকতা করতে হবে না। একটু নড়ে চড়ে বসলাম। মুখে একটা সাংবাদিক সুলভ কপট হাসি ঝুলিয়ে বললাম, ‘অবশ্যই স্যার, আপনার গুল্প শুনতেই তো এসেছি আমরা। “
মুখে একটা আত্মপ্রসন্নের হাসি ফুটিয়ে আবুল সাহেব বললেন, গল্পটা একটু ভৌতিক, তবে একশ ভাগ সত্যি।
ভুত প্রেতে আমার কোন কালেই বিশ্বাস ছিলোনা। তবে ভুতের গল্প শুনতে বেশ ভালো লাগে। কিছু কিছু মানুষ খুব সুন্দর করে ভূতুড়ে আবহ তৈরি করতে পারেন। তাদের বর্ণনায় গায়ে কাঁটা দেয়। মনে হয় এই বোধ হয় মাথা কাঁটা একটা মূর্তি পর্দার আড়াল থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পরবে ঘাড়ের ওপর।
আবুল হোসেন সাহেবের চাহুনিতে মনে হল ইনি ‘ভৌতিক’ গল্পটি করে আনন্দ পান। আমি আর রাশেদ বত্রিশ দন্ত বিকশিত করে বললাম, ‘স্যার, আপনি শুরু করুন, আমরা আপনাকে বিশ্বাস করছি’
-ঠিক আছে, তাহলে চা খেতে খেতে শুরু করি।
ভদ্রলোকের কথা শেষ হবার আগেই দেখি চায়ের কাপ নিয়ে পালোয়ান সদৃশ একজন দাঁড়িয়ে। পাকান শরীর। চাকর ভাবতে একটু কষ্ট হচ্ছে।
চায়ের পাত্রটা চিনামাটির, তাতে আবার নকশা কাঁটা। চুমুক দিতে গিয়ে হটাত চোখ পড়ল আবুল হোসেনের দিকে। শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বুড়ো আমার দিকে। আমি চোখ নামিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। চায়ের স্বাদটা বেশ।
রাশেদও চায়ের কাপ নিয়ে তাকিয়ে আছে আগ্রহী চোখে। ভদ্রলোক শুরু করলেন।
আজ থেকে ২৭ বছর আগের কথা। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। ভার্সিটির একটি হলে সীট পেয়েছি অনেক কষ্টে।
আমার বন্ধু বান্ধব বিশেষ ছিল না। আমার রুমটা ছিল একটু কোনার দিকে। কেউ এদিকটায় সহজে আসতে চাইত না। আমার জন্য অবশ্য ভালো ছিল। নিরিবিলিতে একটু পড়াশোনা করার সুযোগ মিলত।
ছাত্র হিসেবে খারাপ ছিলাম না। ক্লাশের সহপাঠীরা একটু আলাদা চোখে দেখত। তবে আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মীরা নামের একটি মেয়ে। মীরা বেশ রূপবতী ছিল। অনেক ভাবে চেষ্টা করতাম ওর দৃষ্টি আকর্ষণের।
কিন্তু আমি মনে হয় তার চোখে অদৃশ্য ছিলাম। বেশ কয়েকবার চিঠিও লিখেছিলাম। লাভ হয় নি। শেষ মেশ একদিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। জোর করেই রাজি করাব ওকে, বাধ্য করবো আমাকে ভালোবাসতে।
গল্পের এই পর্যায়ে একটু বিরতি দিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন আবুল হোসেন সাহেব। আমি বুঝতে পারছিলাম না ভদ্রলোক নিজের ব্যর্থ প্রেমের পাঁচালী কেন আমাদের শোনাচ্ছেন, তাও আবার পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। আমি বললাম, কি করলেন তারপর?
কি আর, তুলে নিয়ে এসে বাধ্য করলাম আমাকে ভালো বাসতে!
দুই
ঘরের ভেতর অস্বস্তিকর নিরবতা। আমি বা রাশেদ কেউই বুঝতে পারছিনা এই মুহূর্তে আমাদের করনীয় কি। একজন মানুষ আমাদের সামনে কি অবলীলায় একটি ধর্ষণের স্বীকারোক্তি করছে! আমার নিজের কানকে এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।
হো হো শব্দে কেঁপে উঠল ঘরটা। আবুল হোসেন সাহেবের হাসিতে সম্বিৎ ফিরল আমার। ভদ্রলোক প্র্যাক্টিকাল জোক করছেন আমাদের সাথে। উনার রসবোধের তারিফ করতে হয়। প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম যে...
আমিও একটু হেসে জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে করলেন সেটা, আমাদের বিস্তারিত বলুন।
আবুল হোসেন সাহেব একটু গম্ভীর হলেন। আমার কাছ থেকে এই উত্তর আশা করেননি বোধ হয়।
-চা টা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেতে থাক, আমি বলছি।
দিন রাত মাথায় কেবল ঘুরছে কিভাবে করবো কাজটা। কিভাবে বাধ্য করবো একজন মানবীকে আমাকে ভালোবাসতে।
স্বপ্নে দেখতাম, মীরার হাত ধরে হাঁটছি একটা সবুজ ঘাসে মোড়া মাঠে। পাশে একটা নদী। পড়াশোনার অবস্থা তথৈবচ। হলে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি বাইরে। চোখের নিচে পুরু হয়ে জমতে থাকল কালি।
এমনি এক দুপুর বেলা কাঁধে আলতো স্পর্শে পেছন ফিরে দেখি, মীরা দাঁড়িয়ে আমার পেছনে। লাল রঙের ডুরে শাড়িতে নতুন বউএর মত লাগছে ওকে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইলাম। অস্ফুটও স্বরে বলে উঠলাম, তুমি এখানে?
-হু
-আমি মনে হয় স্বপ্ন দেখছি, তাই না।
-স্বপ্ন মনে করলে তোমারই লোকসান।
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি মীরার ঠোঁটে।
আমি মীরার হাত ধরলাম। মীরা হেসে উঠল; আমার পৃথিবী যেন দুলে উঠল।
আমি রাশেদের দিকে তাকালাম। বেচারা কেমন যেন হা করে শুনছে আবুল হোসেনের কাহিনীটা।
আমার একটু হাসি পেল।
-স্যার, স্বপ্নই তো ছিল, তাই না?
আবুল হোসেন হাসলেন মৃদু। বেশ জাঁদরেল গল্প বলিয়ে মনে হচ্ছে। গুল্পের শেষটা শোনার ইচ্ছে তৈরি হচ্ছে। তীব্র ইচ্ছে হচ্ছে।
স্বপ্ন ছিলোনা। স্বপ্ন কখনও এমন হয়না। আমার ব্যপারে মীরার একটা কৌতূহল ছিল, যেটা সে আগে কখনও দেখায় নি। মূলতও সেই কৌতূহল থেকেই আমাদের প্রেমের সূত্রপাত। তোমরা কি মীরার ছবি দেখতে চাও?
আমরা হাঁ সুচক মাথা নাড়লাম।
কিছু বুঝে উঠবার আগেই দেখলাম, সেই পালোয়ান চাকরটা বেশ বড় একটা ছবি নিয়ে আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আসলেই রূপবতী একজন মানবী। আমার কেমন যেন একটু অস্বস্তি লাগছে। সাক্ষাৎকার পর্বটা কেমন যেন বিদঘুটে ঠেকছে। আবুল হোসেন খুব সুক্ষ ভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে মনে হচ্ছে।
-আপনি বলেছিলেন, গল্পটা ভৌতিক?
-হুম, আমার গল্প এখনও শেষ হয়নি।
আমার আর মীরার সম্পর্কটা ওদের বাসা থেকে মেনে নেয়নি। নানা ভাবে তারা মীরাকে নিরুৎসাহিতও করতে থাকে। মীরা বলল, চল আমরা পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি। আমার তখন চাল চুলো নেই।
আমি সময় চাইলাম মীরার কাছে। মীরা অদ্ভুত ভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল। আমি বুঝিনি এটাই ওর শেষ যাওয়া। এক সপ্তাহের মাথায় মীরার বিয়ের কার্ড হাতে পেলাম। মাথায় কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে গেল।
মীরাকে কোনভাবেই হারাতে প্রস্তুত ছিলাম না আমি। শেষ বারের মত চেষ্টা করলাম ওকে ফেরাতে, লাভ হল না। তাই বাধ্য হয়ে...
পিনপতন নিরবতা ঘরটায়। আমার মাথাটা হটাত কেমন যেন ভারী লাগতে শুরু করেছে।
-কি করলেন আপনি?
-ওকে তুলে নিয়ে এসে বাধ্য করলাম আমাকেই ভালবাসতে।
বোকার মত একটু হেসে আমি বললাম, আবার জোক করছেন আপনি।
আবুল সাহেব বাঁকা হাসি হেসে বললেন, না আমি জোক করছিনা!
তিন
আমি শুকনো ঢোঁক গিললাম। মাথাটা পুরো ফাঁকা। রাশেদ এখনও হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ওর ব্যপারটা বুঝতে পারছিনা।
-আপনি কি বলতে চাইছেন?
আবুল হোসেন বলে চললেন,
মীরাকে ওর বাসা থেকে ডেকে নিয়ে আসলাম শেষবার দেখা করবার কথা বলে। আমার হলের রুমটাতে বসলাম দুজন সামনা সামনি। নিজের হাতে চা বানিয়ে ওকে খেতে দিলাম। ও বুঝতেই পারেনি চা টাতে ঘুমের ওষুধ মেশান ছিল।
আমার হাত থেকে চায়ের কাঁপটা ছিটকে পড়ল।
মাথাটা পুরোই ফাঁকা। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পা টা টলমল করছে। রাশেদের দিখে চোখ ফেরালাম, ঝাপসা চোখে বুঝলাম ও ঠিক আগের মতই হাঁ করে তাকিয়ে আছে। মেঝেতে পড়ার সময় শুনলাম, আবুল হোসেন হাসছেন।
-সেটা আমার প্রথম খুন ছিল, এরপরে আর থামতে পারিনি। আমার ঘাড়ে ভুত চেপেছে। সেই ভুতের গল্পই বলছিলাম তোমাদের...হো হো হো হো
পরিশিষ্ট
২৯ জুলাই ২০১৮
গোয়েন্দা পুলিশের একটা দল আজ বনানীর নিরিবিলি বাড়িটা ঘিরে আছে। বাড়ির মালিক মারা গেছেন এক সপ্তাহ হল। ভদ্রলোক একটা ডাইরি পাঠিয়েছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের কাছে।
সেখানে শুধু কিছু মানুষের নাম পরিচয় লেখা। প্রত্যেকের নামেই নিখোঁজ হবার মামলা আছে। প্রথম নামটি লাল কালিতে লেখা...
মীরা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।