যে নদীর গভীরতা বেশি, তার বয়ে চলা স্রোতের শব্দ কম।
দৈত্যটা খালি কাঁদে।
কারণে অকারণে কাঁদে।
আকাশে মেঘ হলে কাঁদে।
রোদ হাসলে কাঁদে।
বাগানে ফুল ফুটলে কাঁদে।
ফুল ঝরলে কাঁদে।
তারপর ধরো, আমাদের ছোট্টমনি প্রজাপতিটা ?
তাকে দেখলেই হাউমাউ কান্না শুরু করে দেয় বোকা দৈত্যটা। কীযে কান্ড !
প্রজাপতিটা বলে
- ও দৈত্য আঙ্কেল, তুমি এত কাঁদো কেন ?
জবাবে অারো জোরে হাউমাউ কেঁদে ওঠে দৈত্য।
- তোমার মন খারাপ? আমি নেচে গেয়ে মন ভাল করে দেই ?
দৈত্যটা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ায়।
না।
- তোমার কি দাঁতে ব্যাথা ? পেপসোডেন্ট দিয়ে দাঁত মাজবে ?
- নাহ।
- তবে কি তোমার পেটে ব্যাথা ? ওরস্যালাইন খাবে ?
- ওরে না ! চেচিয়ে ওঠে দৈত্য।
-তবে কাঁদছো কেন ?
-এমনি।
- এমনি এমনি কেউ কাঁদে ?
- তোর তাতে কী ? বিরক্ত কণ্ঠ দৈত্যের।
আমি আমার ইচ্ছেমত একটুৃ কাঁদতেও পারবো না ? আমার কি স্বাধীনত্া বলে কিছু নেই ?
দৈত্যের রাগী স্বর শুনে ভয়ে চুপসে যায় ছোট্ট প্রজাপতি। পাছে আবার গুতোটুতো দিয়ে বসে দৈত্যটা। যা শিংরে বাবা !
দৈত্য তখনো রাগে গজগজ করছে।
-আমার যদি একটু স্বাধীনতাই না থাকবে, তবে কিসের এত স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে চেচামেচি ? এ কারণেই কি আমরা যুদ্ধ করেছিলাম ?
প্রজাপতিটা তখন আস্তে করে বলে
- দৈত্য আঙ্কেল, তুমি যুদ্ধ করেছিলে ?
- আলবৎ করেছি। একশ বার করেছি।
গরিলা বাহিনীর মত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
-আঙ্কেল গরিলা না- গেরিলা।
-ওই হল। লাউ আর কদু।
- আঙ্কেল
- কী ?
- এবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলো।
- না না । আজ না। এমনিতেই আমার মন খারাপ !
- আহা বল না দৈত্য !
- ঠিক আছে ছোট্ট করে বলি। সে এক করুƒণ ইতিহাস ! বিরাট করুণ। উফফফফ !
বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে দৈত্য।
- বল আঙ্কেল।
- বলছি। সেই দিনের স্মৃতি মনে পড়ায় এই দেখ আমার চোখে পানি নেমে এসেছে। আমার কান্না নেমে আসছে।
- কী সেই ঘটনা ?
দৈত্য ঘটনা বলবে কী ? আবার হাউমাউ কান্না তার।
মহান মুক্তিযুদ্ধা দৈত্য কাঁদছেন। প্রজাপতি থামাল না। কাঁদুক। কেঁদে টেদে হালকা হোক দৈত্যেও দুঃখ।
এসময় রুমের বাইরে মানুষের পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ শুনতে পেল প্রজাপতি।
-শিশশশশশ ।
দৈত্যকে থামাল সে।
বাইরের পায়ের আওয়াজ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। একসময় মনে হল ঘরে এসে ঢুকছে আওয়াজটা।
দৈত্য আর প্রজাপতি দুজনেই চুপ মেরে লেখার খাতায় আটকে রইলো।
মোজাম্মেল প্রধান রুমে পায়চারি করছেন। একবার লেখার টেবিলের কাছে যাচ্ছেন আবার সরে যাচ্ছেন। আবার যাচ্ছেন আবার আসছেন। স্থির হতে পারছেন না। একবার টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেলেন।
টিভিতে সেভেন আপের বিজ্ঞাপনচিত্রে এরকম ঢকঢক আওয়াজ হয়।
- মোজাম্মেলের মাথা সম্ভবত নষ্ট হয়ে গেছে।
লেখার পাতার ভাজ থেকে ফিসফিসিয়ে বললো দৈত্য।
- আস্তে। চুপ।
সতর্ক করলো প্রজাপতি।
- আঙ্কেল মোজাম্মেল শুনে ফেলবেন।
- ধ্যাত। শুনবে না। আমি যে এতক্ষণ তোকে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী বলেছি, সে টের পেয়েছে ?
- না।
- আস্ত একটা উল্লুক।
- কেন ?
- কেন নয়? চিন্তা করে দেখ, আমি একটা দৈত্য! আমার ভাবভঙ্গিই আলাদা থাকতে হবে। আমি হুঙ্কার দিলে পৃথিবী কেঁেপ উঠবে। আর আমাকে নিয়ে কী সব আবোল তাবোল লিখছে বেকুবটা।
- হুম।
তাইতো দেখছি।
- আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। এই প্রেক্ষাপট নিয়ে সে একটা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মত ছোটগল্প লিখতে পারতো- যা শেষ হয়েও হইলো না শেষ টাইপের হতো। এসব না লিখে কীসব ছাইপাশ দুই পৃষ্ঠা লিখে রেখেছে! তাও এখন আবার কনসেপ্ট পাচ্ছে না দেখে রুমের ভেতর দৌড়াদৌড়ি করছে।
- দৌড়াদৌড়ি না দৈত্য আঙ্কেল।
পায়চারি করছে।
- অই হল। তুই এই পাগলা লেখকের পক্ষ নিচ্ছিস কেন ? সেতো তোর উপরও অবিচার করেছে !
- অবিচার ! আমার উপর ?
- অফকোর্স। কেন ? সেকি জানে না প্রজাপতিরা একসময় পরী ছিল ? শিম্পাঞ্জী যেভাবে কালের বিবর্র্তনে মানুষ হয়ে গেল, তেমনি পরী হয়ে গেল প্রজাপতি।
- কিন্তু আঙ্কেল, মানুষের বিবর্তন নিয়েতো বিতর্ক আছে।
- তা থাকুক। পরীদের বিবর্তন নিয়েতো বিতর্ক নেই। তাহলে ? এটা নিয়ে সে লিখবে না কেন ?
- উনি হয়তো ব্যাপারটা জানেনইনা !
- হুম । জানে না। মুর্খ লেখক !
মোজাম্মেল প্রধান হন্তদন্ত হয়ে আবার লেখার টেবিলের কাছে আসেন।
ভয় পেয়ে দৈত্য আর প্রজাপতি চুপ করে যায়। একেবারে নো নো সাউ›ড, নট নড়নচড়ন।
মোজাম্মেল প্রধান প্রজাপতি আর বোকা দৈত্যকে নিয়ে গল্পটা আবার লেখা শুরু করলেন। বইমেলা চলে আসছে। একটা সুন্দর যুৎসই গল্পের বই না হলে তার চলে না।
রাতের ঘটনা।
সম্ভবত মধ্যরাতই হবে।
মোজাম্মেল প্রধান এর হাতে ঘড়ি নেই বলে সঠিক সময় দেখতে পারছেন না। মধ্যরাত বুঝতে পারলেন বাইরের আকাশে আস্ত একটা পূর্ণিমার চাঁদ দেখে। মস্ত চাঁদ।
তার চারপাশে কত কত নাম না জানা তারকারাশি।
মাঝে মধ্যেই মোজাম্মেল প্রধান আকাশের তারাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। তিনি শুনেছেন- মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়। তার অতিপ্রিয় একজন মানুষ আকাশে তারা হয়ে আছে।
কোন তারাটা ?
খুঁজে বেড়ায় মোজাম্মেল প্রধান।
-আঙ্কেল ! আঙ্কেল মোজাম্মেল!
অদ্ভূত বাচ্চা মেয়ের কণ্ঠ শুনে চমকে ওঠে মোজাম্মেল প্রধান। মাঝ রাতে বাচ্চা মেয়ে আসলো কোত্থেকে ?
-আঙ্কেল !
- কে ক্কে কে ?
হন্তদন্ত হয়ে চারপাশে তাকায় মোজাম্মেল প্রধান। কেউ নেই ।
- আঙ্কেল, আমি তোমার লেখা গল্পের ছোট্ট প্রজাপতি।
- প্রজাপতি !
মোজাম্মেল প্রধান গল্পের খাতাটা হাতে নেয়।
কয়েকটা পাতা উল্টাতেই সেখান থেকে ছোট্ট প্রজাপতিটার ছবি ভেসে ওঠে।
মোজাম্মেল প্রধান অস্ফুট কণ্ঠে বলেন
- প্রজাপতি ! আমার ছোট্ট পরী মা !
- ও আল্লাহ ! আমরা যে পরী তুমি সেটা জানো ?
- বাহরে ! জানবো না কেন ?
- যাক। আমি ভাবলাম ব্যাপারটা তুমি জানই না। এ নিয়ে দৈত্যের কী অভিমান !
- তাই ?
- হুম । আচ্ছা তোমার মন খারাপ নাকি ?
- হুম।
ছোট্ট করে জবাব দেয় মোজাম্মেল প্রধান।
- আমি নেচে গেয়ে তোমার মন ভালো করে দেই ?
- নাহ। দরকার নেই।
- তুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে কী খুঁঝছো ?
- কই ? কিছু নাতো !
- ওহোঁ। তুমি অবশ্যই কিছু খুঁজছো।
আমাকে বল প্লিজ !
মোজাম্মেল প্রধান একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
- কিছু নারে পরী- কিছু না। একটা তারা খুঁজি।
- কোন তারাটা ?
- জানি না।
এরপর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।
নীরবতা ভাঙলেন মোজাম্মেল প্রধান।
- পরী।
- জী আঙ্কেল।
- মানুষ মারা গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়। তুমি এটা বিশ্বাস কর ?
- আমার কোন বিশ্বাস নেই আঙ্কেল মোজাম্মেল।
আপনার বিশ্বাসই আমার বিশ্বাস।
- অহ।
- আপনার কে মারা গেছে আঙ্কেল ?
চুপ করে রইল্নে মোজাম্মেল প্রধান। অনেকক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন
- আমার স্নেহময়ী মা।
পরিশিষ্ট
কী করে যেন বোকা দৈত্যটার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
সে আড়মোড়া দিয়ে উঠলো। তারপর কিছুক্ষণ চোখ কচলে অবাক হয়ে দেখলো- প্রজাপতিটা লেখক মানুষটার হাতের উপর বসা।
মোজাম্মেল প্রধান নামের লেখকটা বলছে
- পরী, বলতে পারিস- আল্লাহ তায়ালা মানুষকে কেন এত কষ্ট দেন ?
- পারি না আঙ্কেল। পারি না।
- কেন পৃথিবীতে এত সীমাহীন শূণ্যতা ? কীসের অভাব ? কীসের ?
- জানি না আঙ্কেল।
আমি কিছুই জানি না। কারণ আমি আপনার কল্পনা মাত্র।
- তাই ?
- আঙ্কেল মোজাম্মেল, আপনি যা জানেন আমিও তা জানি। আপনি যা জানেন না তা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
- অহ।
মোজাম্মেল প্রধান খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে দূর আকাশের তারাদের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। তার চোখে পানি চলে আসছে।
দৈত্যটা দেখলো, ছোট্ট প্রজাপতির চোখও চিকচিক করছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।