"ব্র্যাক হত্যাকারী, খুনি একে ঘৃনা করুন। ব্র্যাককে না বলুন। " - শিরোনামে ১১ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৩:৪৭ মিনিটে আবিদ ভাই একটি লেখা লিখেছেন যেখানে তিনি এনজিও সংস্থা ব্র্যাকের কুকীর্তির এক ভয়ানক চিত্র ফুটে উঠেছে। লেখাটির কমেন্টস সেকশনে কিছু কমেন্ট পড়ে চোখ আটকে যায়।
দু-একটা কমেন্টস এরকম:
---- "কী-বোর্ড ছাড়েন।
গড়িব দের পাশে এসে দাঁড়ান তার পর নতুন করে এই পোস্টের দেন। মনে রাখবেন, যে দেশের এম পি - মন্ত্রীরা টাকা দেখলে হা-হয়ে যায়, সে দেশের গড়ীব লোকরা যে আপনার টাকা মেড়ে দেবেন্ তার কোন গ্যাডান্টি আমি আপনাকে দেবনা। আর যদি আপনি হাতেমতাই হয়ে থাকেন তবেত কোন কথাই নাই। মনে রাখবেন ব্র্যাক হাতেম তাইনা। আর যদি অন্য কোন আর্থিক প্রথিষ্ঠানের কথা বলেন তাহলে বলব- এরা আসলে গড়ীব দের জন্য হসে থাকেনা।
এরা বসে থাকে বড় বড় ড়াগোব বোয়াল ধড়ার জন্য। " (এনার কি টাইপিং-এ প্রবলেম নাকি সত্যি সত্যি বাংলা ভালভাবে জানেন না এই ব্যপারে আমি সন্দিহান)
---- "আমার এখনই টাকা লাগবে, আপনি কি কিছু দিবেন? আপনার তো অঢেল আছে? আপনি কিন্তু একটাকাও দিবেন না। দিবে কিন্তু ঐ রক্ত চোষারাই। প্রয়োজনে যাদের কাজে লাগে কোন দিনই তাদের বাদ দেওয়া সম্ভব না। আপনি অসম্ভব এর পিছনে ছুটছেন।
ধন্যবাদ পোস্টের জন্য। "
আমার এই লেখা মূলত এরই প্রতিক্রিয়া।
প্রথমত "প্রয়োজনে যাদের কাজে লাগে" কথাটা পুরোপুরি ভুল।
এই "প্রয়োজন" তথা আমাদের দারিদ্র্য-অনটন রাতারাতি তৈরি হয় নি।
বাংলার মানুষ তাদের জীবন-সংগ্রামের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নানা গল্পে-কাহিনীতে সঞ্চিত করে রেখেছে।
এমনই একটি কাহিনী হল শিয়াল আর কুমিরের বন্ধুত্বের কাহিনী। গল্পে আছে, শিয়াল আর কুমিরের গলাগলি দোস্তি। তো একবার তারা টাকাপয়সা কামাইয়ের আশায় দুজনে মিলে চাষবাস করার সিদ্ধান্ত নিল। প্রথমবার তারা ধান চাষ করল। ভাগাভাগি করার সময় শিয়াল কৌশলে কুমিরকে দিল নিচের অংশ আর নিজে নিল ওপরের অংশ।
একদিন সে ধান কেটে নিয়ে গেল। কুমির নিজের ভাগ নিতে এসে দেখে জমিতে পড়ে আছে শুধু নাড়া। সে নাড়া চিবিয়ে দেখে ওতে কোনো স্বাদ নেই। সে বুঝতে পারে যে সে ঠকেছে। পরের বার তারা চাষ করল আলু।
এবার কুমির নিজ থেকে চেয়ে ওপরের অংশ নিয়ে নিল। বোকা কুমির জমি থেকে কেটে নিয়ে গেল শুধু আলুর গাছগুলো। আর মাটির নিচে থাকা আলু পেল শিয়াল।
এই গল্পের শিয়ালের সাথে তুলণা চলে বর্তমানে সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর "পরম হিতাকাঙ্ক্ষী" আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংকের।
বিশ্বব্যাংক এবং তার কাজকর্ম সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই।
এই সংস্থাটির দুটি ভিন্ন এবং বিপরীত ধরনের পরিচয় পাওয়া যায়। সাধারণভাবে বলা হয়, বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ ও গতিশীল করা এবং বিশ্ব অর্থনীতির সাথে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে সমন্বয় করাই এর উদ্দেশ্য। কথাটি বলা হয় বিশ্বব্যাংক, বিভিন্ন দেশের শাসকশ্রেণী এবং তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ এবং বুদ্ধিজীবীদের পৰ থেকে। অন্যদিকে, বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শে বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী মহল এবং বামপন্থিরা এ সংস্থাকে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার, বিশেষত বহুজাতিক কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর (এনজিও ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান) স্বার্থরৰাকারী হিসাবে চিহ্নিত করে থাকে। আমাদের দেশের বহু মানুষ, সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি শিক্ষিত মানুষও বিশ্বব্যাংকের আসল চেহারাটি সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে ভোগেন।
তাদের ধারণা, বিশ্বব্যাংক আগাগোড়াই আমাদের খারাপ চায় এমন নয়। আমরা তাদের পরামর্শ পুরোপুরি বাস্তবায়িত করতে পারি না বলেই কাঙিৰত উনড়বয়ন ঘটাতে পারছি না।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক তার কার্যক্রম শুর্ব করেছে। ওই সময় থেকে নানা খাতে তারা বিনিয়োগ করেছে, নানা পরামর্শ দিয়েছে।
কিন্তু কৃষি-সংশ্লিষ্ট কোনো খাতে তারা ঋণ বা অনুদান দেয়নি।
কৃষিখাত নিয়ে বিশ্বব্যাংক মাথা ঘামানো শুরু করে ২০০৪ সালে। সে সময় তারা কৃষিখাতে সরকার কত ভর্তুকি দিচ্ছে তার খোঁজখবর নেওয়া শুর্ব করে। এ সময় বিশ্বব্যাংকের পৰ থেকে বলা হয়, সরকার কৃষিখাতে প্রতিবছর যে ভর্তুকি দেয় তার পুরোটা কৃষক পায় না, বড় অংশই অপচয় হয়। আর ২০০৭ সালের শেষদিকে এসে তারা সরাসরি হস্তৰেপ করতে শুর্ব করে। কৃষি নিয়ে সরকারকে নানা বিষয়ে পরামর্শ দিতে শুরু করে।
একথা আজ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে আমাদের শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান দায় হচ্ছে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের। তাদের পরামর্শেই আমাদের শাসকগোষ্ঠি বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি গ্রহণ করে। একে একে পাট, চিনি, কাগজ প্রভৃতি স্থানীয় এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পগুলোর কোমর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ওই সময় আমাদের এই বলে বুঝ দেওয়া হয়েছিল যে এতে পাটশিল্প গতিশীল হবে, দুর্নীতি ও অপচয় কমবে। গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশের আশায় আমাদের দেশের বুর্জোয়াশ্রেণীও তাদের ওই শর্তে রাজি হয়েছে।
যদিও গার্মেন্টস খাতে দেশের বহু শ্রমিক কাজ করার সুযোগ পেয়েছে কিন্তু এর মতো বর্বর ও প্রকট শোষণ সম্ভবত আর দ্বিতীয়টি নেই। এক হিসাবে দেখা গেছে, পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি থেকে পাওয়া ১ ডলার গার্মেন্টস থেকে পাওয়া ৪ ডলারের সমান। কারণ, একটি পাটজাত পণ্যের সাথে যুক্ত পাটচাষী, ৰেতমজুর-দিনমজুর এবং সর্বোপরি পাট কারখানার শ্রমিক প্রত্যেকেই কোনো কোনোভাবে উপকৃত হতো। এখন একদিকে লাখ লাখ পাটচাষী এবং পাটশ্রমিক পথে বসেছে, আর অন্যদিকে গার্মেন্টস খাতের কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে বাইরে থেকে, তাতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে। উপরন' মুনাফার পুরোটা তো বটেই, সরকারের তহবিল থেকেও টাকা চলে যাচ্ছে গার্মেন্টস মালিকদের পকেটে।
পাটশিল্প ধ্বংস হওয়ায় আমাদের কৃষিরও ৰতি হয়েছে। কৃষিবিজ্ঞানে জমির উর্বরতা রৰায় শস্য-আবর্তনের বিষয়টি বিশেষভাবে গুর্বত্ব দেওয়া হয়, যা পাটচাষ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
একথা অনেকেই জানেন যে বাংলাদেশ, এবং গোটা বিশ্বের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি এক গভীর সংকটকাল পার করছে। আমাদের অর্থনীতির চাকা যে ঘুরছে না এটা পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা পর্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা আমদানি-নির্ভর দেশে পরিণত হয়েছি।
হাতে গোনা দুতিনটি পণ্য ছাড়া আমাদের রফতানি করার কিছু নেই। এখানে শিল্প-কারখানা তেমন বিকশিত হয়নি, বরং ৬০ ও ৭০-এর দশকে গড়ে ওঠা বহু শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক নানা কারণে কৃষিভিত্তিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও এ খাতের উনড়বয়ন ও আধুনিকায়ন নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আমাদের শাসকরা গ্রহণ করেনি। কৃষি এবং কৃষক কখনোই তাদের মনোযোগ পায়নি। কৃষির উন্নয়নের লক্ষে প্রতিষ্ঠিত বিএডিসিকে অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে।
যেখানে প্রয়োজন ছিল কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা, সেটি না করে কৃষিনির্ভর শিল্পগুলো একে একে অচল ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো যেখানে কৃষিতে বিনিয়োগ করে ১১ শতাংশ, উন্নত দেশগুলো করে আরও বেশি, সেখানে আমাদের দেশে বিনিয়োগ মাত্র ৪ শতাংশ। অথচ শাসকদের এত অযত্ন, অবহেলা ও পরিকল্পনাহীনতার পরও চূড়ান্ত অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে একমাত্র কৃষিখাতই অর্থনীতিতে যৎকিঞ্চিত গতি সঞ্চার করে রেখেছে। জিডিপিতে কৃষির সরাসরি অবদান ২২ শতাংশ, আর কৃষির সঙ্গে সংশিৱষ্ট অন্যান্য খাতের অবদান ৩৩ শতাংশ। আমাদের শ্রমশক্তির প্রায় ৬২ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত।
শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ কৃষির সাথে সম্পর্কিত। ফলে কৃষির উন্নতির সঙ্গে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন গভীরভাবে সম্পৃক্ত। আর এই কৃষিক্ষাতকে দিন দিন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুসরন করে চলার ফলে। আর অপরদিকে এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে যাদের উপর বীজ-সার প্রভৃতির জন্যে আমাদের কৃষকদের নির্ভর করতে হচ্ছে। এই সুযোগে তারা লুটে নিচ্ছে বিশাল অঙ্কের মুনাফা যার ফল আজ আমাদের এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চরম দুর্দশা আর ঋণপ্রদানকারী এনজিও-নির্ভরতা।
আমরা কি জানি এই রক্তচোষাদের পুঁজি কি?
আমাদের তথাকথিত গর্ব শ্রদ্ধেয় ড. ইউনুছকে নোবেল পুরষ্কার পাবেন নাই বা কেন?
ক্ষুদ্র ঋণ যে ঐ রক্তচোষাদের জন্যে যুগান্তকারী আবিষ্কার!
সর্বহারা দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাদের কাছ থেকে কিছুই শুষে নেবার মতো অবশিষ্ট নেই তাদের এই দারিদ্র্যকেই পুঁজি করে কিভাবে আরো বড় মুনাফার পাহাড় গড়া যায় তার কৌশল আবিষ্কার করেছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় এই গুণীজন। (কথাটা অনেকে হয়তো ভালোভাবে নিবেন না। কিন্তু তাদের বলতে চাই এটাই আজকের বাস্তবতা। )
এনজিও গুলোর তথাকথিত দারিদ্র্য-বিমোচনমুলক কর্মসূচীগুলোর উদ্দেশ্য কোনভাবেই যে দারিদ্র্য-বিমোচন নয় তা স্পষ্ট। কারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যই এই এনজিও গুলোর ব্যবসার সম্বল।
এরা কখনোই চায় না এদেশ থেকে দারিদ্র্য দূর হোক।
ইতোমধ্যে বহুজাতিক কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর স্বার্থরৰাকারী বিশ্বব্যাংক এবং তার অপর সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইএমএফ-ডব্লিউটিওর বিরুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে ব্যাপক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশেও এ আন্দোলন চলছে।
আমাদের আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে আজকের পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৯৫ ভাগই এই শোষিত জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই জনগোষ্ঠীকে সেই সার্কাসের সাদা হাতির সাথে তুলণা করা চলে, একটা বদ্ধ কাঠের তৈরি আস্তাবলে বন্দী থাকাই যে নিয়তি বলে ধরে নিয়েছে, নিজের শক্তি সম্বন্ধে যার কোন ধারণাই নেই।
যেদিন এই বোকা মানুষগুলো বুঝতে পারবে সেদিন এই রক্তচোষাদের নিস্তার নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।