আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোহাম্মদ আব্দুল বাসিত : প্রখর মেধাবী এক সাংবাদিক



না , সিলেটে তাঁর সাথে কখনো আমার দেখা হয় নাই। দেখা হয়েছিল এই নিউইয়র্কে । আমি তখন ( ১৯৮৮ - ১৯৯০ ) একটা ধারাবাহিক লিখতাম দৈনিক সিলেটের ডাক এ যুক্তরাষ্ট্রের রোজনামচা শিরোনামে। এই ধারাবাহিকটি তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আমার সে লেখাটিই আমাকে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।

নিউইয়র্কে এসেই তিনি আমার সন্ধান করেন। বন্ধুবর আব্দুর রউফ খান মিষ্টুর মাধ্যমে দেখা হয়ে যায়। তারপর তুমুল আড্ডা। আমরা ক'জন মিলে তাঁকে নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ঠিকানা য় একটা চাকুরী যোগাড় করে দেই। তিনি সহযোগী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কৃতিত্বের সাথে।

তিনি আমার কাছে ছিলেন অগ্রজসম। গুরুতুল্য মানুষ। তাঁর কাছে শুনেছি, তাঁর অনেক চড়াই উৎরাই পেরোনো সাংবাদিক জীবনের কথা। একজন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক হিসেবে তিনি সুনীতির প্রতি ছিলেন সব সময় অবিচল। পরবাসে মন টিকে নি তাঁর।

মাত্র দেড় বছর পরই দেশে চলে যান। এরপর অবসর জীবনেই ছিলেন। ২০০৬ সালে বের হয় তাঁর লেখা স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ - সহস্র বিস্মৃতিরাশি । ১৮ জানুয়ারি ২০০৯ চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন আমাদের প্রিয় বাসিত ভাই। তাঁর মৃত্যসংবাদ শুনে আঁতকে উঠেছি।

বেদনাহত হয়েছি ,প্রিয় স্বজনের মহাপ্রয়াণে। তাঁর কর্মপ্রেরণা ,তাঁর আদর্শ পাথেয় হয়ে থাকবে যেকোন সৃজনশীল লেখক, সাংবাদিকের - চিরকাল। তাঁর আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক। --------------------------------------------------------------------------- তাঁকে নিয়ে এই লেখাটি লিখেছেন অগ্রজপ্রতিম সাংবাদিক , দৈনিক ইত্তেফাক এর সিনিয়র রিপোর্টার এডভোকেট তবারক হোসেইন। লেখাটি দৈনিক সমকাল- এ ২৫ জানুয়ারি ২০০৯ ছাপা হয়েছে।

এখানে যুক্ত করে রাখলাম। --------------------------------------------------------------------------- মোহাম্মদ আবদুল বাসিত শ্রবণ ও বাকশক্তিহীন হয়েও ছিলেন অদম্য তবারক হোসেইন ====================================== মোহাম্মদ আবদুল বাসিত সিলেটের বিয়ানীবাজারের ছোটদেশ নামে একটি গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে তার টাইফয়েড হয়েছিল। টাইফয়েড সেরেছিল; কিন্তু তিনি হারিয়েছিলেন শ্রবণশক্তি আর বাকযন্ত্রটিও হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্থ।

তিনি কানে মোটেও শুনতে পেতেন না আর কথাও ছিল অস্পষ্ট। অনেক চিকিৎসা করেও তার শ্রবণেন্দ্রিয়কে সচল করা যায়নি। তার সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করতে হতো কাগজে লিখে। ছোটবেলা থেকেই তার লেখার প্রতি ঝোঁক ছিল। বিয়ানীবাজার থেকে তিনি গল্প লিখে সিলেটের সাপ্তাহিক যুগভেরী পত্রিকায় পাঠাতেন, মাঝে মধ্যে সেখানকার খবরও।

এভাবেই তিনি হয়ে উঠলেন সাংবাদিক। সম্ভবত ১৯৬৬ সালে সিলেটের সাপ্তাহিক যুগভেরী পত্রিকায় চাকরি নিয়ে সিলেট শহরে চলে আসেন। আমি তখন তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সিলেটের প্রতিনিধি। সেই সুবাদে আমরা দু’জন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠি। ফলে তাকে ভালোভাবে জানার সুযোগ হয়েছিল।

প্রতিদিন আমাদের মধ্যে দেখা হতো। কোনো সময় দু’তিনদিনের মধ্যে দেখা না হলে তিনি আমার বাসায় চলে আসতেন আবার আমিও সেভাবে তাকে খুঁজে নিতাম। তিনি যুগভেরী পত্রিকায় যখন যোগদান করেন তখন হিমাংশু শেখর ধর (ঝর্ণা বাবু), সুধীন্দ্র বিজয় দাস প্রমুখ প্রবীণ সাংবাদিকও যুগভেরীতে কাজ করতেন। তাদের সান্নিধ্যে এসে তিনি সংবাদপত্রের প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে সম্পাদনা পর্যন্ত সব শাখায় সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন। এক সময় যুগভেরী পত্রিকাটি পরিচালনার একক দায়িত্ব তার ওপর বর্তায় এবং তিনি তা সুচারুরূপে পালন করেন।

ষাটের দশকে যুগভেরী পত্রিকা ছিল সিলেটের একমাত্র সংবাদপত্র। তিনি একজন কলমযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধেও বিপুল অবদান রেখেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমি এপ্রিল মাসে ভারতের করিমগঞ্জে যাই এবং সেখানকার যুব ক্যাম্পে কাজ করি। তখন করিমগঞ্জের একটি প্রেস থেকে ‘জয় বাংলা’ নামে মুক্তিযুদ্ধের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো। আমি সেখানে যাওয়ার পর ওই পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব আমার ওপর পড়ে।

সম্ভবত সে মাসে বাসিতও করিমগঞ্জ শহরে গিয়ে উপস্থিত হন। আওয়ামী লীগ নেতারা ‘জয় বাংলা’ পত্রিকাটির দায়িত্ব নিলে বাসিত এটি সম্পাদনা করতেন। তবে এ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে ‘সোনার বাংলা’ নামে আরো একটি কাগজ বের হয় এবং তিনি ওই পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা জোগানোর জন্য তাদের সাফল্যের খবরগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয় শিরোনামে প্রকাশ করতেন। তার সম্পাদকীয় লেখাগুলোও ছিল ভাষা নৈপুণ্যে চমৎকার অনুপ্রেরণাদায়ক।

স্বাধীনতার পর দেশে এসে বাসিত যুগভেরী পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশের দায়িত্ব নেন এবং ১৯৭৫ সালে মাত্র চারটি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া আর সব কাগজের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এ সাপ্তাহিক পত্রিকাটি তিনি চালিয়েছেন খুবই দক্ষতার সঙ্গে। তিনি একজন নিষ্ঠাবান সাংবাদিক ছিলেন। সংবাদ সম্পাদনায় তার হাত ছিল খুবই ভালো। নিউজ সেন্সও ছিল তীক্ষ্ণ। আর সাংবাদিকতার দায়িত্ববোধও ছিল গভীর।

পত্রিকাটির সম্পাদক ও মালিক মরহুম আমীনুর রশীদ চৌধুরী বাসিতকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং তার প্রতিভার প্রতি তার ব্যাপক শ্রদ্ধাবোধ ছিল। তিনি তার এই শ্রদ্ধা-মর্যাদা রেখেছেন যতদিন কর্মরত ছিলেন। ’৭৫-এর পর যুগভেরী পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হলে বাসিতের আর ওই পত্রিকায় ফিরে যাওয়া হয়নি। কারণ তিনি তখন জীবিকার জন্য অন্য পথ খুঁজছিলেন। আমেরিকায় চলে গিয়ে ওখানে থিতু হওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে সফল হননি।

যদিও যুগভেরী ছেড়ে দেওয়ার পর সংবাদপত্র জগতের স্থায়ী কর্মী হননি, কিন্তু সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল অবিচ্ছিন্ন। সিলেটের প্রায় প্রতিটি কাগজে তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন। মাঝে মধ্যে গল্পও লিখতেন। তার কলামগুলো ছিল প্রধানত রস রচনামূলক। সমাজের যত অনিয়ম-বিশৃংখলা আর অসততার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মকভাবে আক্রমণ করতেন তিনি।

তিনি সমাজে ন্যায়বিচার, দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে তার কলমযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন কর্মক্ষম থাকা পর্যন্ত। মোহাম্মদ আবদুল বাসিত ছিলেন একজন মনেপ্রাণে বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তো বটেই, তারও আগে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলনে যুগভেরী যে সাহসী ভূমিকা রাখে তাতে তার অবদানও ছিল। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে তিনি ছিলেন একজন আপসহীন যোদ্ধা। তিনি সর্বতোভাবেই ছিলেন বাঙালির জাতীয় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে একজন সচেতন ব্যক্তি।

শ্রবণ ও বাকশক্তিবিহীন, মফস্বল শহরে কাজ করতেন বলে জাতীয় পর্যায়ে তার পরিচিতি ছিল কম, তাই তিনি দেশের বৃহত্তর মানুষের কাছে অচেনাই রয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন সত্যিকারের একজন জনদরদি, সমাজের কল্যাণকামী, সৎ, দেশপ্রেমিক ব্যক্তি, একজন অত্যন্ত দক্ষ সাংবাদিক ও চমৎকার মানুষ। মৃত্যুকে সবাই আলিঙ্গন করতে হবে । বাসিতকেও করতে হয়েছে। তার বিদেহী আত্মাকে বলি, ‘তুমি চলে গেছো বন্ধু, তবে শান্তিতে থেকো।

’ ## ## ########### ##

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.