নীতির প্রতি আনুগত্য, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা
ফকির ইলিয়াস
=========================================
পাশ্চাত্যের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে একটি প্রথা খুব জোরালোভাবে চালু আছে। কোনো রাজনীতিক, সরকারি দায়িত্ব নেয়ার আগে তার ব্যক্তিগত জীবনের কোনো অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন কিংবা ছিলেন কি না। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নতুন কেবিনেটের যারা সদস্য হয়েছেন, তাদের ব্যাপারেও এই পর্যবেক্ষণটি কাজ করেছে খুব শক্তভাবে। প্রেসিডেন্ট ওবামা যাদের তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন তাদের প্রত্যেককেই যেতে হয়েছে এসব ব্যাপক তল্লাশির মধ্যদিয়ে। অর্থবিষয়ক সেক্রেটারি মি. থিমোথি গেইথনারের নিয়োগের বিষয়টি ঝুলে আছে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। তিনি একবার তেতাল্লিশ হাজার ডলার ট্যাক্স প্রদান করেননি।
নিয়োগপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হন্ডারের বিষয়টিও ঝুলে আছে। তার বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একইভাবে স্বাস্থ্য ও মানবকল্যাণবিষয়ক সেক্রেটারি টম ডেশেলের বিরুদ্ধেও কর প্রদানে গড়িমসির বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজনে তার নিয়োগ কনফার্ম করতে দেরি হচ্ছে।
সব আনুষঙ্গিক তদন্ত রিপোর্ট সম্পন্ন হলে এরা সবাই নিজ নিজ পদে নিয়োগের নিশ্চয়তা পেতে পারেন মার্কিন সিনেট-কংগ্রেস দ্বারা। অর্থাৎ বিষয়টি হচ্ছে এরকম, প্রেসিডেন্ট তার পছন্দের ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবেন। তবে তার কনফার্ম করবে সিনেট এবং কংগ্রেস।
হিলারি রডহাম ক্লিনটন সেক্রেটারি অব স্টেটস হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। সিনেট তা কমফার্ম করেছে।
তিনি ৯৪-২ ভোটে এই নিশ্চিতি পেয়েছেন। যে দু’জন সিনেটর এই মনোনয়নের বিরোধিতা করেছিলেন- এরা হচ্ছেন, লুজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান সিনেটর মি. ডেভিড ভিটার এবং সাউথ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান সিনেটর মি. জিম ডেমিন্ট। তারা তাদের বিরোধিতার ব্যাখ্যায় বলেছেন, হিলারি ক্লিনটন সাবেক ফার্স্টলেডি। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একটি আন্তর্জাতিক চ্যারিটি সংগঠন চালান। ‘ক্লিনটন ফাউন্ডেশন’ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বড় বড় ডোনেশন পেয়ে থাকে।
আর এর প্রভাব পড়তে পারে হিলারি ক্লিনটনের কর্মকান্ডে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্বার্থ বিভিন্নভাবে ক্ষুন্ন হতে পারে।
হিলারি ক্লিনটন তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেছেন এই যুক্তি। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রের কোনো কাজে তার ব্যক্তিগত জীবনের কর্মকান্ড প্রভাব ফেলবে না। তিনি সে শপথ নিয়েই সেক্রেটারি অব স্টেটের দায়িত্ব নিচ্ছেন।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, ওবামা প্রশাসনের সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে হিলারিকে পেতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন সিনেটর জন ম্যাককেইন। অথচ রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন ছিলেন বারাক ওবামার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট প্রতিদ্বন্দ্বী। সিনেটর ম্যাককেইন জোর দিয়ে বলেন, ‘আমেরিকান জাতি সব সময়ই ঐক্যবদ্ধ। জাতীয় প্রয়োজনে, আন্তর্জাতিক প্রয়োজনে আমরা আমাদের ঐক্যের শক্তি প্রদর্শন করেই যাবো। ’
দুই.
একটি পরিশুদ্ধ জাতি গঠনে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নাই।
মূলধারার পক্ষে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার প্রয়োজনে সব রাজনীতিককে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নামই প্রকৃত রাজনীতি। এই যে মার্কিন মুল্লুক, তা গড়ে উঠেছে বহুজাতিক, বহুভাষিক মানুষের সমন্বয়ে। বারাক ওবামা তার শপথ অনুষ্ঠানের ভাষণে সে কথা আবারো মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, এই দেশ খ্রিস্টান-মুসলিমদের। এই দেশ জুইশ-হিন্দুদের।
এই দেশ তাদেরও, যারা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না।
বারাক ওবামার ভাষণে একটি বিষয় খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, তিনি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বে সন্ত্রাস দমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে চান। তিনি চান, মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত পারস্পরিক সৌহার্দ্যতার উন্নয়ন ঘটাতে। তার এই যে প্রত্যয়, তা আমরা শুরুতেই দেখছি। তিনি বহুল বিতর্কিত গুয়ান্তানামো বে-এর সামরিক প্রিজন সেলটি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন।
ফলে আগামী ১২০ দিন সেখানের সব বিচার কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে এবং ক্রমশ তা বন্ধ করা হবে। এই প্রিজন সেলটিতে অত্যন্ত অমানবিকভাবে বন্দিদের নির্যাতন করা হতো বলে বিভিন্ন মিডিয়া সংবাদ করেছে। কিন্তু বুশ প্রশাসন এতে মোটেই কর্ণপাত করেনি।
মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নিরসনে প্রথম কর্ম দিবসেই মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্ট, জর্ডানের বাদশাহ কিং আব্দুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে কথা বলেছেন বারাক ওবামা। মধ্যপ্রাচ্যে আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য প্রেসিডেন্ট ওবামা সাবেক ডেমোক্রেটিক লিডার সিনেটর জর্জ মিশেলকে দায়িত্ব দিয়ে একটি মিশন পাঠাবার প্রস্তাবও করেছেন।
যা আপাতদৃষ্টিতে বেশ শুভ লক্ষণ বলেই মনে হচ্ছে।
মানব সভ্যতার প্রথম শর্ত হচ্ছে শান্তি। আর বিশ্বে যদি শান্তি প্রতিষ্ঠা করা না যায় তবে ক্রমশ হানাহানিই হয়ে উঠবে মানবজাতির প্রধান নিয়ন্ত্রক। শান্তি প্রতিষ্ঠার কর্মপরিধির সঙ্গে আরেকটি অন্যতম ধাপ হচ্ছে, পরিশুদ্ধ নেতৃত্বের বিকাশ। কোনো রাষ্ট্রের নেতারা যদি দুর্নীতিবাজ হন, তবে সে রাষ্ট্রের প্রজন্মের ভবিষ্যৎ দীর্ঘকাল আঁধারেই নিমজ্জিত থেকে যায়।
অখন্ড পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের গাদ্দারির কারণেই গণতন্ত্রের পথে এগুতে পারেনি। বারবার সামরিক দানবেরা এসেছে, গণতন্ত্র আসেনি। সবশেষে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়েই স্বাধীন হতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশেও যদি প্রত্যেক নেতার ব্যক্তিগত জীবনাচার, তাদের কর্মকা- গভীরভাবে বিচার করার উদ্যোগ গৃহীত হতো, তবে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ দুর্নীতি প্রথমেই লোপ পেতো। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নই রাষ্ট্রে দেউলিয়াপনা টেনে আনে।
যিনি কর দেবেন না, যিনি স্বজনপ্রীতি-দুর্নীতি করবেন তিনি গণপ্রতিনিধি হবেন কেন? রাষ্ট্রে কি সৎলোকের অভাব আছে?
এই যে দখল করে রাখার মানসিকতা সেটি একটি উন্নয়নশীল দেশের অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয়। ব্যাহত করে মানুষের পথচলা। সৎ নীতির প্রতি আনুগত্য না থাকলে রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয় না।
বাংলাদেশে গেল সাঁইত্রিশ বছরে শুধুই রাজনৈতিক তস্কর তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক কচ্ছপও তৈরি হয়েছে।
যারা সময়ে সময়ে বুলি পাল্টায়, সব সময় সরকারি দলই তাদের দল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসার পর এখন দেশে অনেকেই নব্য আওয়ামীলীগার। এরা শুধু দলের শত্রুই নয়, সমাজেরও শত্রু। এদের উচ্চাভিলাষের কাছেই পরাজিত হয় গণস্বপ্ন। এদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারলেই বাংলাদেশ একটি শুদ্ধ সমাজের মুখ দেখবে, সন্দেহ নেই।
নিউইয়র্ক / ২৩ জানুয়ারি ২০০৯
-------------------------------------------------------------
দৈনিক ডেসটিনি । ঢাকা। ২৫ জানুয়ারি ২০০৯ রোববার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।