রাজনীতি ও অর্থনীতি এই দুই সাপ পরস্পর পরস্পরকে লেজের দিক থেকে অনবরত খেয়ে যাচ্ছে
২৫শে মার্চ থেকে ৭ই এপ্রিলের মধ্যে নতুন দুই ডিভিশন সৈন্য - ৯ম এবং ১৬শ - আকাশপথে নিয়ে আসার পর এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ পূর্ব বাংলার প্রায় সকল অঞ্চলে পাকিস্তান নিজের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। ২৬শে মার্চ থেকে প্রথম এক সপ্তাহে পাকিস্তানী আক্রমণের মুখে যারা ভারতে প্রবেশ করে তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার-মূখ্যত আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও বিদ্রোহী সশস্ত্রবাহিনীর লোকজন। ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত যারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে, তাদের সংখ্যা ছিল এক লক্ষের অনধিক। পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণ সুদূর মফস্বল অবধি বিস্তৃত হওয়ায় এপ্রিলের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে আশ্রয় নেয় এগারো লক্ষ বিপন্ন মানুষ। মে মাসে আশ্রয় নেয় আরও একত্রিশ লক্ষ মানুষ।
৩০ এপ্রিলের শেষ দিকেই শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান স্রোত ভারতের সরকারী মহলে অপরিসীম উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে। অন্যদিকে পাকিস্তানী শাসকেরা ভারতের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রথম দিকে কিছুটা অনিশ্চিত বোধ করলেও অচিরেই বুঝতে পারে যে, পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্যক অপ্রস্তুতি এবং সংখ্যাল্পতার জন্য ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোন প্রকার সামরিক ব্যবস্হা গ্রহণে সক্ষম নয়। ভারত যদি পূর্বাঞ্চলে প্রকাশ্য সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়, তবে সেই সংঘর্ষ সীমিত ও অমীমাংসিত হওয়া একরূপ অবধারিত। উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে, কারণ কিছুটা আলাদা হলেও, সংঘর্ষের ফলাফল হত প্রায় অভিন্ন। এই পরিস্হিতিতে, ১৯৬৫ সালের মত, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হওয়া এবং ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ পূর্বতন স্হিতাবস্হা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ছিল।
অন্যদিকে এই অমীমাংসিত পাক-ভারত যুদ্ধের ডামাডোলে স্বাধিকারের জন্য পূর্ব বাংলার দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, ’৭০-এর নির্বাচনের ঐতিহাসিক রায়, অন্যায় ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে আইন পরিষদের অধিবেশন স্হগিতকরণ, অসহযোগ আন্দোলন, সামরিক শাসকদের বিশ্বাসঘাতক আক্রমণ, গণহত্যা, বাঙালী সেনাদের বিদ্রোহ, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার ঘোষণা এই সব কিছুই অন্তত বেশ কিছু কালের জন্য চাপা পড়ত।
অনুরূপ বিবেচনা থেকেই সঙ্কটের একদম গোড়ার দিকে বাংলাদেশের গৃহযুদ্ধে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপের এক প্রস্তাব দিল্লীর সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকমহল কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। ৩১ প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে সম্ভবত তাজউদ্দিনই প্রথম উপলব্ধি করেন, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে, যদি এই পর্যায়েই পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কোন যুদ্ধ শুরু হয়, তবে তার ফলে সব চাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম। অবশ্য এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে দিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি আলোচনার সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। ৩২ পরে পরিস্হিতির জটিলতা অনুধাবনের সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে তিনি যথোচিত সতর্কতা অবলম্বন করেন।
তাজউদ্দিন দেখতে পান, অমীমাংসিত পাক-ভারত যুদ্ধ এবং সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নই কেবল বেশ কিছুকালের জন্য চাপা পড়বে তা নয়, অধিকন্তু বিশ্ববাসীর কাছে এই স্বাধীনতা সংগ্রাম নিছক ‘ভারতীয় চক্রান্তের অংশ হিসাবে পরিগণিত হবে। তা ছাড়া বিঘোষিত স্বাধীনতা অর্জন ও সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশের নিজস্ব সংগঠন গড়ে তুলতে হলেও বেশ কিছু সময়ের প্রয়োজন-তার আগে কোন হঠকারিতা নয়। জাতীয় প্রস্তুতির এই অন্তর্বর্তীকালে ভারতের স্বীকৃতির প্রশ্নকে তাজউদ্দিন কেবল দাবী হিসাবে জীবিত রাখাই যুক্তিযুক্ত মনে করেন-উপযুক্ত সুযোগ ও সময়ের প্রতীক্ষায়। তাজউদ্দিনের এই উপলব্ধি অবশ্য তাঁর অধিকাংশ সহকর্মীর কাছে গৃহীত হয়নি-যাঁদের দাবীই ছিল ভারতের তৎদণ্ডেই কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবিলম্বে যুদ্ধ যাত্রা।
সামরিক ও রাজনৈতিক কারণে ভারত যে সেই সময় কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে অক্ষম, এই উপলব্ধির ভিত্তিতে পাকিস্তানী শাসকেরা ভারতের সকল প্রতিবাদ ও সতর্কবাণী উপেক্ষা করে দেশের আনাচে কানাচে ‘পরিষ্করণ অভিযান’(clearing operation) চালিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষকে ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করে চলে।
নিধন ও নির্যাতনের পাশাপাশি বাঙালী জাতীয়তাবাদ সমর্থক সকল মানুষ এবং ব্যাপকতম অর্থে সংখ্যালঘু হিন্দুদের দেশ থেকে বিতাড়ন করে বাংলাদেশ সমস্যার ‘চূড়ান্ত সমাধানে’ নিযুক্ত হতে তাদের দেখা যায়। ৩৩
কিন্তু ব্যাপক সংখ্যায় শরণার্থী সৃষ্টিই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলির উপর অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ৩৪ ক্রমশ এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে। শরণার্থীদের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, জনসঙ্ঘ, স্বতন্ত্র ও হিন্দু মহাসভার মত ভারতের দক্ষিণপন্হী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলিও বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যথোচিত ‘বলিষ্ঠতা’ প্রদর্শনের দাবীতে ততবেশি সোচ্চার হতে থাকে।
কাজেই যথাশীঘ্র সকল শরণার্থীকে স্বদেশে ফেরৎ পাঠাতে না পারলে গোটা পরিস্হিতি যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের জন্য এক মারাত্মক রাজনৈতিক ফাঁদে পরিণত হতে পারে, সে ইঙ্গিত তখন মোটামুটি স্পষ্ট। সম্ভবত এক অমীমাংসিত যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিয়ে কংগ্রেস সরকারকে রাজনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত করা ছিল এই সব চরম দক্ষিণপন্হী ভারতীয় দলগুলির বাংলাদেশ প্রীতির অন্যতম মূল উদ্দেশ্য।
অন্যদিকে পাকিস্তানের উপর প্রভাব আছে এমন সব রাষ্ট্রের চাপে বা সৎপরামর্শে পাকিস্তান যে সামরিক নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে রাজনৈতিক সমাধানের পথ ধরবে, এমন আশা বজায় রাখাও ভারতের জন্য ক্রমশ কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। সরকারী পর্যায়ে একমাত্র সোভিয়েট ইউনিয়নের জোরাল নিন্দা ও প্রতিবাদ ছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের অথবা গোপন সমর্থকের। অবশ্য চীনের ভূমিকা ছিল প্রকাশ্য এবং মূলত তা পাকিস্তানের শাসকদেরই পক্ষে।
৩০ ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত Bangladesh Documents, Vol. II, পৃ. ৮২।
৩১ Pran Chopra: India’s Second Liberation, পৃ. ৭৭-৭৮।
৩২ পি. এন. হাকসার, একান্ত সাক্ষাৎকার, ২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮২।
৩৩ আক্রমণের প্রথম থেকে শুরু করে এই বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের প্রবণতা বরাবরই তাদের অব্যাহত থাকে। ১৮ই জুলাই, ’৭১ ঢাকা থেকে পাঠানো রিপোর্টে Washington Post -এর সংবাদদাতা গোটা অঞ্চল সরজমিনে দেখার পর জানান: ‘As the special targets of the army almost all (Hindus) have fled to India, gone into hiding in rural villages or been killed. The army attacks on Hindus have been so widespread that few have doubt that they were ordered by Pakistan Government, an order that many West Pakistan officers and soldiers appear to have obeyed with enthusiasm....’ (Congressional Records 1971, p. 25850)
৩৪ ‘ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’-এর ১২ই জুনের প্রতিবেদন অনুযায়ী: ‘As the special targets of the army almost all (Hindus) have fled to India, gone into hiding in rural villages or been killed. The army attacks on Hindus have been so widespread that few have doubt that they were ordered by Pakistan Government, an order that many West Pakistan officers and soldiers appear to have obeyed with enthusiasm....’ (Congressional Records 1971, p. 25850)
আগের পর্ব: Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।