রাজনীতি ও অর্থনীতি এই দুই সাপ পরস্পর পরস্পরকে লেজের দিক থেকে অনবরত খেয়ে যাচ্ছে
দ্বিতীয় পর্ব
সীমান্ত অতিক্রম করার আগে কয়েকবারই তাজউদ্দিন মনে করেছিলেন হয়তবা এই আপৎকালীন পরিস্হিতি মোকাবিলার জন্য উচ্চতর পর্যায়ে কোন ব্যবস্হা ভারত সরকারের সাথে করা হয়েছে। তাঁর এ কথা মনে করার বিশেষ একটি কারণ ছিল। ৫ই অথবা ৬ই মার্চে শেখ মুজিবের নির্দেশে তাজউদ্দিন গোপনে সাক্ষাৎ করেন ঢাকাস্হ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কে. সি. সেনগুপ্তের সঙ্গে। উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানের শাসকেরা যদি সত্য সত্যই পূর্ব বাংলায় ধ্বংসতাণ্ডব শুরু করে, তবে সে অবস্হায় ভারত সরকার আক্রান্ত কর্মীদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান বা সম্ভাব্য প্রতিরোধ সংগ্রামে কোন সাহায্য-সহযোগিতা করবে কিনা জানতে চাওয়া। উত্তরের অন্বেষণে সেনগুপ্ত দিল্লী যান।
সারা ভারত তখন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে মত্ত। সেখানে সরকারী মনোভাব সংগ্রহ করে উঠতে উঠতে তাঁর বেশ কদিন কেটে যায় এবং ঢাকা ফেরার পর সেনগুপ্ত ১৭ই মার্চে ভাসাভাসাভাবে তাজউদ্দিনকে জানান যে, পাকিস্তানী আঘাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে ইসলামাবাদস্ত ভারতীয় হাইকমিশনার সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করেন; ‘তবু আঘাত যদি নিতান্তই আসে’, তবে ভারত আক্রান্ত মানুষের জন্য ‘সম্ভাব্য সকল সহযোগিতা’ প্রদান করবে। এই বৈঠকে স্হির হয়, তাজউদ্দিন শেখ মুজিবের সাথে পরামর্শের পর সেনগুপ্তের সঙ্গে আবার মিলিত হবেন এবং সম্ভবত তখন তাজউদ্দিন সর্বশেষ পরিস্হিতির আলোকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার প্রকার ও ধরন সম্পর্কে নির্দিষ্ট আলোচনা চালাতে সক্ষম হবেন। ২৪শে মার্চে এই বৈঠকের কথা ছিল। কিন্তু শেখ মুজিব এ বিষয়ে কোন আলোকপাত করতে না পারায় এবং নির্ধারিত সময়ে তাজউদ্দিনকে অসহযোগ আন্দোলন-সংক্রান্ত নির্দেশাবলী সংশোধনের মুসাবিদায় ব্যস্ত রাখায়, সেনগুপ্তের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।
সীমান্ত অতিক্রমের আগে তাজউদ্দিন ভেবেছিলেন, হয়তবা ২৪শে মার্চের আলাপ অন্য কারো মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে এবং সম্ভবত এই আপৎকালীন পরিস্হিতি মোকাবিলার কোন ব্যবস্হা ইতিমধ্যেই করা হয়েছে। ১১
সীমান্তে পৌঁছুবার পর তাঁর আশাভঙ্গ ঘটে। তিনি দেখতে পান, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে ভারতের সামরিক ইউনিটসমূহের হস্তক্ষেপ করার কোন ক্ষমতা নেই; এমনকি অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সরবরাহের কোন এখতিয়ারও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের হাতে নেই। স্হানীয় ভিত্তিতে দু’একটি জায়গায় ব্যতিক্রম থাকলেও সে সব ক্ষেত্রেও তাদের দেওয়া সাহায্য প্রয়োজনের তুলনায় ছিল অতি সামান্য। মুক্তিফৌজ গঠনের জন্য অস্ত্রশস্ত্র বরাদ্দ করার আবেদনের জবাবে সীমান্ত রক্ষী (বিএসএফ)-প্রধান রুস্তমজী প্রাঞ্জল ভাষায় তাজউদ্দিনকে জানান: মুক্তিফৌজ ট্রেনিং বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং এই ট্রেনিং সমাপ্ত হবার পরেই কেবল তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে; কিন্তু এই ট্রেনিং বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের দেওয়া হবে কিনা, সেই সিদ্ধান্তের সংবাদ এখনও তাঁর জানা নেই; এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার একমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এবং তাজউদ্দিন চাইলে তাঁকে দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার ব্যবস্হা করে দিতে পারেন মাত্র।
১২ তাজউদ্দিন বুঝলেন, ভারতের সঙ্গে কোন ব্যবস্হাই নেই, কাজেই শুরু করতে হবে একদম প্রথম থেকে।
৩রা এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা শুরু করার পূর্বে কয়েকটি মূল বিষয়ে তাজউদ্দিনকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তখনও তিনি দলের নেতৃস্হানীয় অপরাপর সহকর্মীদের সাক্ষাৎ পাননি। তাঁরা জীবিত কি মৃত, পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী কি সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টায় রত - এমন কোন তথ্যই তখন অবধি তাঁর কাছে পৌঁছায়নি। এই অবস্হায় তাঁকে স্হির করতে হয় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনাকালে তাঁর নিজের ভূমিকা কি হবে? তিনি কি শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের একজন ঊর্ধ্বতন নেতা হিসাবে আলাপ করবেন? তাতে বিস্তর সহানুভূতি ও সমবেদনা লাভের সম্ভাবনা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার উপযোগী পর্যাপ্ত অস্ত্র লাভের কোন আশা আছে কি? বস্তুত তাজউদ্দিনের মনে কোন সন্দেহই ছিল না যে, একটি স্বাধীন সরকার গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে সেই সরকারের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত হওয়ার আগে, ভারত তথা কোন বিদেশী সরকারের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট সাহায্য ও সহযোগিতা আশা করা নিরর্থক।
কাজেই, সামরিক বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যদি সরকার গঠন করে থাকেন তবে সেই সরকারের নেতৃস্হানীয় সদস্য হিসাবে তাজউদ্দিনের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সাহায্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দিল্লীতে আসা এবং সাহায্য সংগ্রহের চেষ্টা করা অপেক্ষাকৃত যুক্তিসঙ্গত ও সহজসাধ্য হবে বলে তাজউদ্দিন মনে করেন। অন্ততপক্ষে ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি অনিবর্তনীয় বিষয় হিসাবেই গণ্য হবে বলে তাঁর ধারণা জন্মায়।
ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের আগের দিন দিল্লীতে তাঁরই এক ঊর্ধ্বতন পরামর্শদাতা পি.এন. হাকসার তাজউদ্দিনের সাথে আলোচনাকালে জানতে চান, আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে কোন সরকার গঠন করেছে কিনা। এই জিজ্ঞাসা ও সংশ্লিষ্ট আলোচনা থেকে তাজউদ্দিন বুঝতে পারেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে কি হয়নি সে সম্পর্কে কোন প্রকৃত সংবাদ ভারত কর্তৃপক্ষের জানা নেই এবং সরকার গঠনের সংবাদে তাদের বিস্মিত বা বিব্রত হওয়ারও কোন আশঙ্কা নেই। বরং সরকার গঠিত হয়েছে জানতে পারলে ‘পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামকে সাহায্য করার’ জন্য ভারতীয় পার্লামেন্ট ৩১শে মার্চ যে প্রস্তাব গ্রহণ করে তা এক নির্দিষ্ট ও কার্যকর রূপ লাভ করতে পারে বলে তাজউদ্দিনের ধারণা জন্মায়।
১৩
এই সব বিচার-বিবেচনা থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দিন জানান যে পাকিস্তানী আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ২৫/২৬শে মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে একটি সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই (পরে ‘হাইকমান্ড’ নামে যাঁরা পরিচিত হন) মন্ত্রিসভার সদস্য। শেখ মুজিবের গ্রেফতারের খবর ছাড়া অন্যান্য সদস্যের ভাল-মন্দ সংবাদ তখনও যেহেতু সম্পূর্ণ অজানা, সেহেতু তাজউদ্দিন দিল্লীতে সমবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে উপস্হিত করা যুক্তিযুক্ত মনে করেন। ১৪
তাজউদ্দিনের এই উপস্হিত সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসামান্যভাবে শক্তি সঞ্চারিত হয়। ইন্দিরা গান্ধী ‘বাংলাদেশ সরকারের’ আবেদন অনুসারে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতা দানের প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করেন।
ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে। কিন্তু তাজউদ্দিনের এই একক ও উপস্হিত সিদ্ধান্ত মুক্তিসংগ্রামের জন্য যতই ফলপ্রসূ হয়ে থাকুক, এর ফলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও অনিবার্য হয়ে ওঠে। নেতৃত্বের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও দীর্ঘ সময় সমগ্র রাজনীতিকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করে রাখে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অনুকূল সাড়া দেবার প্রধান কারণ সম্ভবত ছিল তিনটি। প্রথম কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের নিরবচ্ছিন্ন বৈরী সম্পর্ক এবং তৎকারণে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব।
দ্বিতীয় কারণ আদর্শের ক্ষেত্রে, বিশেষত সংসদীয় গণতন্ত্র ও অসামপ্রদায়িকতার প্রশ্নে, আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় কংগ্রেস দলের দৃষ্টিভঙ্গিগত মিল। তৃতীয় কারণ ছিল মানবিক - পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরতায় সারা দুনিয়ার মানুষের মন আলোড়িত হয়েছিল, ভৌগোলিক নৈকট্য হেতু স্বভাবতই ভারতে মানবিক সহানুভূতি ও সমবেদনায় সাড়া পড়েছিল সব চাইতে বেশী। কাজেই ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করার রাজনৈতিক ও মানবিক কারণ ছিল সমভাবে বিদ্যমান।
যে কোন মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালনার জন্য প্রধান আবশ্যকীয় শর্ত তিনটি। এক, জনগণের ব্যাপক সমর্থন।
দুই, মুক্তিসেনাদের নিরাপদ আশ্রয়স্হল। এবং তিন, সমরাস্ত্রসহ বিভিন্ন উপকরণের নিয়মিত সরবরাহ। এই তিনটি শর্তের মধ্যে প্রথমটি, তথা ব্যাপক জনসমর্থন, বিপুলভাবেই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও পূর্ব বাংলার স্বল্প আয়তন এবং দখলদার সেনাদের ক্ষিপ্র চলাচল ও আক্রমণ ক্ষমতার দরুন পূর্ব বাংলার কোন অংশই মুক্তিসেনাদের জন্য নিরাপদ ছিল না। কাজেই মুক্তিবাহিনীর সম্প্রসারণ, প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য সীমান্তের ওপারে নিরাপদ ঘাঁটির প্রয়োজন ছিল সর্বাগ্রে।
প্রবাসী সরকারের জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় ও অবাধ কাজকর্মের অধিকার লাভের প্রশ্ন ছিল সম পরিমাণেই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও ছিল সাধারণ শরণার্থীদের আশ্রয় দানের মানবিক প্রশ্ন। নক্সাল আন্দোলনবিক্ষত জনবহুল পশ্চিম বঙ্গের সীমান্ত অগণিত বিদেশী শরণার্থীর জন্য, বিশেষত সশস্ত্র বিদ্রোহীদের জন্য, উন্মুক্ত করা অসামান্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আশ্রয়দানের ব্যাপারে প্রথম থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর সম্মতি ছিল দ্ব্যর্থহীন। এই সাহসিকতাপূর্ণ সিদ্ধান্তের পিছনে পশ্চিম বঙ্গের সাধারণ মানুষের অবদান সামান্য নয়। ইয়াহিয়ার গণহত্যার প্রতিবাদে ৩১শে মার্চ কোলকাতায় যে অভূতপূর্ব হরতাল পালিত হয়, তার রাজনৈতিক গুরুত্ব ও সম্ভাবনা কোনটিই নয়াদিল্লীর জন্য উপেক্ষণীয় ছিল না।
১১ তাজউদ্দিন আহমদ, একান্ত সাক্ষাৎকার, ৮ই মে, ১৯৭৩।
১২ ঐ, সেপ্টেম্বর, ১৯৭২।
১৩ ঐ।
১৪ ঐ এবং আমিরুল ইসলাম।
ভূমিকা সহ প্রথম পর্ব Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।