অর্থ না বুঝে কুরআন পড়া সাওয়াব না গুনাহ?
-প্রফেসর ডাঃ মোঃ মতিয়ার রহমান (এফ আর সি এস)
ভূমিকা
অর্থ ছাড়া বা না বুঝে কুরআন পড়লেও প্রতি অরে দশ নেকি-কথাটা প্রায় সকল মুসলমান জানে এবং মানে। যারা অর্থসহ বা বুঝে কুরআন পড়ে তাদেরও প্রায় সবাই এটা বিশ্বাস করে যে, কুরআন না বুঝে পড়লেও প্রতি অরে দশ নেকি হয়।
না বুঝে কুরআন পড়লেও প্রতি অরে দশ নেকি-কথাটা কুরআনকে শুধুমাত্র অর্থ ছাড়া বা না বুঝে পড়ার অনুমতিই দেয় না বরং তা, না বুঝে কুরআন পড়াকে উৎসাহিত করে। আর এই কথাটার প্রভাবে বর্তমানে সারা বিশ্বে কোটি কোটি মুসলমান অর্থ ছাড়া বা না বুঝে কুরআন পড়ছে। আর তারা তা করছে এটা ভেবে যে-
১. অর্থ ছাড়া পড়লেই যখন প্রতি অরে দশ নেকি পাওয়া যায়, তখন আর কষ্ট করে অর্থ বুঝতে যাওয়ার দরকার কি ?
২. অর্থ পড়তে বা বুঝে পড়তে গেলে, না বুঝে পড়ার তুলনায় একই সময়ে কম অর পড়া হবে।
ফলে সওয়াবও কম পাওয়া যাবে।
আল-কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী সকল মুমিন বা মুসলমানের ১ নং আমল বা কাজ হচ্ছে কুরআনের জ্ঞান অর্জন করা এবং শয়তানের ১ নং কাজ হচ্ছে কুরআনের জ্ঞান থেকে মুমিন বা মুসলমানকে দূরে রাখা। অর্থাৎ ইসলামী জীবন বিধানে সকল মুমিন বা মুসলমানের জন্যে সব চেয়ে বড় সওয়াবের কাজ হচ্ছে কুরআনের জ্ঞান অর্জন করা এবং সব চেয়ে বড় গুনাহের কাজ হচ্ছে কুরআনের জ্ঞান অর্জন না করা বা কুরআনের জ্ঞান থেকে দূরে থাকা। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ’পবিত্র কুরআন, হাদীস ও বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী মুমিনের ১ নং কাজ কোনটি এবং শয়তানের ১ নং কাজ কোনটি’ নামক বইটিতে।
না বুঝে কুরআন পড়ার অর্থ হচ্ছে, কুরআন পড়া কিন্তু তার জ্ঞান থেকে দূরে থাকা।
তাই এ কথা বুঝা মোটেই কঠিন নয় যে, অর্থ ছাড়া বা না বুঝে কুরআন পড়লেও প্রতি অরে দশ নেকি কথাটা ইবলিস শয়তানের ১ নং কাজকে দারুণভাবে সাহায্য করছে। সুতরাং কথাটি সঠিক কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব বলে মনে করি।
বিষয়টি নিয়ে কুরআন ও হাদীস অনুসন্ধান করে যে তথ্য পেয়েছি, সেগুলো মুসলমান জাতির নিকট উপস্থাপন করাই এ পুস্তিকা লেখার উদ্দেশ্য। আশা করি তথ্যগুলো জানার পর সকল পাঠক জানতে পারবেন, অর্থ ছাড়া বা না বুঝে কুরআন পড়ার বিপে বা পে কী কী তথ্য কুরআন ও হাদীসে আছে। ফলে তারা অতি সহজে বুঝতে পারবেন, অর্থ তথা জ্ঞান অর্জনের ল্য ছাড়া কুরআন পড়লে গুনাহ হবে, না সওয়াব হবে।
আর এর ফলে একজন পাঠকও যদি অর্থ ছাড়া কুরআন পড়া ছেড়ে দিয়ে অর্থসহ বা বুঝে কুরআন পড়া আরম্ভ করে তবে আমার এ চেষ্টা সার্থক হয়েছে বলে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করব।
ইসলামী জীবন বিধানে করণীয় কোন কাজের ব্যাপারে গুনাহ হওয়ার কয়েকটি প্রধান কারণ ও শর্ত
ইসলামী জীবন বিধানে করণীয় কোন কাজের ব্যাপারে গুনাহ হওয়ার কয়েকটি প্রধান কারণ ও শর্ত হচ্ছে-
কারণ -
১. কাজটি না করা।
২. কাজটির বিপরীত কাজ করা।
৩. আল্লাহ এবং রাসূল (স.) যে পদ্ধতিতে করতে বলেছেন, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ক্রটি রেখে কাজটি করা। কারণ, পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ বা মৌলিক ত্র“টি থাকলে যে কোন কাজ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
শর্ত
১. ইচ্ছাকৃতভাবে উপরের তিনটি কারণ সংঘটিত হতে হবে।
২. ওজরের জন্যে তথা অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন আমল ছেড়ে দিলে বা তার বিপরীত কাজ করলে গুনাহ হয় না যদি নিম্নের শর্তগুলো পূরণ হয়-
ক. ওজরের গুরুত্ব ছেড়ে দেয়া আমলটির গুরুত্বের সমান হলে। অর্থাৎ মৌলিক আমল ছাড়তে হলে অত্যন্ত বড় বা মারাত্মক ওজর থাকতে হবে। আর অমৌলিক আমল ছাড়ার ব্যাপারে ছোট-খাট ওজরও গ্রহণযোগ্য হবে।
খ. মনে অনুশোচনা, অশান্তি, দুঃখ ইত্যাদি থাকতে হবে এবং তার পরিমাণ ছেড়ে দেয়া আমলটির গুরুত্বের সমান হতে হবে।
এই অনুশোচনা, অশান্তি, দুঃখই প্রমাণ করে যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বা খুশি মনে আমলটি ছাড়ছে না।
গ. যে অবস্থার জন্যে আমলটি ছাড়তে হচ্ছে বা পালন করতে পারা যাচ্ছে না তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টার পরিমাণ ছেড়ে দেয়া আমলটির গুরুত্বের সমান হতে হবে। আর চেষ্টাই প্রমাণ দিবে যে ব্যক্তি খুশী মনে বা ইচ্ছাকৃভাবে আমলটি ছাড়ছে না, ওজরের কারণে অনিচ্ছকৃতভাবে ছাড়ছে। কারণ, কোন বিষয়ের জন্যে ব্যক্তির মনে অনুশোচনা, অশান্তি, দুঃখ ইত্যাদি থাকলে তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা সে অবশ্যই করবে।
এই তিনটি শর্ত যথাযথভাবে পূরণ না করে এক বা একাধিক আমল যে ব্যক্তি ছেড়ে দিবে ইসলামী জীবন বিধানে তাকে গুনাহ্গার বলা হয়।
আর যে ব্যক্তি জানা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে, খুশি মনে ইসলামের কোন একটি আমলে সালেহ ছেড়ে দিবে, সে কাফির বা মুনাফিক হিসেবে গণ্য হবে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ’পবিত্র কুরআন, হাদীস ও বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী মু’মিন ও কাফিরের সংজ্ঞা ও শ্রেণী বিভাগ’ নামক বইটিতে।
না জানতে পারার কারণে কোন আমল না করলে গুনাহ্ হবে কিনা
ইসলামের করণীয় ও নিষিদ্ধ কাজ কোনগুলো, তা যেন কারো অজানা না থাকতে পারে সে জন্যে-
১. কুরআন ও সুন্নাহ ঘোষণা করেছে, সকলের জন্যে সব চেয়ে বড় সওয়াবের কাজ হচ্ছে কুরআনের জ্ঞান অর্জন করা এবং সব চেয়ে বড় গুনাহের কাজ হচ্ছে কুরআনের জ্ঞান থেকে দূরে থাকা।
২. যাদের কুরআন ও সুন্নাহের জ্ঞান আছে তাদের জন্যে-
ক. সে জ্ঞান অন্যের নিকট পৌঁছানোকে একটা বড় সওয়াবের কাজ হিসেবে কুরআন ও সুন্নাহ বারবার ঘোষণা করেছে।
খ. গুরুতর কোন কারণ ছাড়া সে জ্ঞান অন্যকে না পৌঁছালে বা গোপন করলে কঠিন শাস্তির ঘোষণাও কুরআন ও সুন্নাহ বারবার দিয়েছে।
তাই অজানা অবস্থায় ইসলামের করণীয় কোন কাজ না করলে বা নিষিদ্ধ কোন কাজ করলে প্রত্যভাবে গুনাহ না হলেও পরোভাবে গুনাহ হয়। কারণ ইসলামে কুরআনের জ্ঞান অর্জন না করাই সব চেয়ে বড় গুনাহের কাজ। এই পরো গুনাহ যাতে না হতে পারে সে জন্যেই-
১. পৃথিবীর প্রথম মানুষটিকে নবী করে পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ কোনটা করণীয় এবং কোনটা নিষিদ্ধ, তা তাঁকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
২. পৃথিবীর প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিকট আল্লাহ নবী বা রাসূল পাঠিয়েছেন
(নহল:৩৬)
৩. কোনটা করণীয় আর কোনটা নিষিদ্ধ, তা জানিয়ে কিতাব ও সহিফা পাঠানো হয়েছে।
তবে যে ব্যক্তি সুযোগের অভাবে লেখাপড়াই শিখতে পারেননি, তিনি যে এই পরো গুনাহ্ থেকে বেঁচে যেতে পারেন, আর যিনি বড় বড় বই পড়ে নানা বিষয়ে শিতি হয়েছেন কিন্তু কুরআনের জ্ঞান অর্জন করেননি, তিনি যে কোনভাবেই এই পরো (তবে মারাত্মক) গুনাহ থেকে বাঁচতে পারবেন না। তা সহজেই বুঝা যায়।
আল-কুরআনের জ্ঞান অর্জন করা ইসলামের সবচেয়ে বড় আমল বা কাজ। তাই আল-কুরআনের জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারেও উপরোক্ত কারণ ও শর্ত অনুযায়ী গুনাহ হবে বা হয়।
ইসলামের বিভিন্ন কাজ থেকে বিপথে নেয়ার শয়তানের কর্মপদ্ধতি
উপরের আলোচনার পর এ কথা অতি সহজে বলা ও বুঝা যায় যে, ইসলামের করণীয় কাজ থেকে মুসলমানদের বিপথে নেয়ার জন্যে শয়তানের ষড়যন্ত্রের প্রধান কৌশলগুলো হবে-
১. মুসলমানরা কাজটা যাতে না করে বা তার বিপরীত কাজ করে সে জন্যে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা।
এই পদ্ধতিতে মুসলমানদের বিপথে নেয়া একটু কঠিন। কারণ, আল্লাহ ও রাসূল (স.) যে কাজটি করতে বলেছেন, সেটা সরাসরি না করতে বললে বা তার বিপরীত কাজ করতে বললে, তা গ্রহণ করতে মুসলমানরা সাধারণত দ্বিধায় পড়ে যায়। তবুও শয়তান খুব সূক্ষ্মভাবে পদ্ধতিটা প্রয়োগ করেছে এবং অনেকাংশে সফলকামও হয়েছে। তাই তো দেখা যায়, আজ অনেক মুসলমান ইসলামের অনেক মৌলিক কাজও করা থেকে বিরত আছে বা অনেক মৌলিক কাজের বিপরীত কাজ করছে।
২. কাজটা আল্লাহ্ যে নিয়মে বা পদ্ধতিতে করতে বলেছেন এবং রাসূল সা. যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন, তা থেকে ভিন্নভাবে করানোর জন্যে সব ধরনের ষড়যন্ত্র করা।
শয়তানের প্রথম ষড়যন্ত্রের কৌশল উপো করে যে সকল মুসলমান ইসলামের কোনো কাজ করতে এগিয়ে যায়, এই দ্বিতীয় কৌশল খাটিয়ে সে তাদের বিপথে নেয়ার চেষ্টা করে। এ পদ্ধতিটা খুব কার্যকর হয়। কারণ, মুসলমানরা কাজটা করছে বলে খুশি থাকে। আর পদ্ধতিটা এমন সূক্ষ্মভাবে ঘুরিয়ে দেয়া হয় যে, ভালো জ্ঞান না থাকলে তা ধরাও যায় না। যে কোনো কাজের ফল (জবংঁষঃ) নির্ভর করে কাজটি করার পদ্ধতির উপর।
কাজটি যেহেতু আল্লাহর পদ্ধতি অনুযায়ী হয় না, তাই ঐ কাজের দ্বারা আল্লাহ যে ফল দিতে চেয়েছিলেন তাও ফলে না বরং শয়তান যে ফল চেয়েছিল, তাই ফলে।
শয়তানের এই সূক্ষ্ম পদ্ধতির শিকার হয়ে বিশ্ব মুসলমানদের অধিকাংশই বর্তমানে ইসলামের অনেক মৌলিক কাজও এমনভাবে করছে যেটা আল্লাহর বলা ও রাসূল সা. প্রদর্শিত পদ্ধতি নয়। তাই, তারা ঐ কাজগুলোর ইহকালীন অপূর্ব কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর এর ফলে মানব সভ্যতাও ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগুচ্ছে। ঐ কাজগুলোর পরকালীন কল্যাণ থেকেও যে তারা বঞ্চিত হবে,তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
কুরআনের জ্ঞান থেকে মানুষকে দূরে নেয়া হচ্ছে শয়তানের এক নম্বর কাজ। তাই এ কাজে সফল হওয়ার জন্যে সে তার ধোঁকাবাজির সকল পদ্ধতি খাটাবে, সেটাইতো স্বাভাবিক। আর এখানেও সে অবিশ্বাস্যভাবে সফলকাম হয়েছে, সেটাও তো অতি সহজে বুঝা যায়।
বিপথে নেয়ার পদ্ধতিগুলো সহজে গ্রহণ করানোর জন্যে শয়তানের সাধারণ কর্মকৌশল
মুসলমানরা যাতে বিভিন্ন ধোঁকাবাজি সহজে গ্রহণ করে তার জন্যে শয়তান এক অপূর্ব সাধারণ কৌশল প্রয়োগ করেছে। কৌশলটা কী তা সহজে বুঝতে হলে কুরআন থেকে সৃষ্টির গোড়ার কিছু কথা জানতে হবে।
আদম আ.কে সৃষ্টি করে আল্লাহ্ সকল ফেরেশতা ও জিন ইবলিসকে ডেকে আদম আ.কে সিজদা করতে বললেন। সমস্ত ফেরেশতা সিজদা করল কিন্তু ইবলিস নিজে আগুনের তৈরি তাই আদম আ. থেকে শ্রেষ্ঠ ভেবে অহংকার করে, সিজদা করল না। আদেশ অমান্য করার জন্যে ইবলিসের প্রতি আল্লাহ্ রাগান্বিত হলেন এবং তাকে অভিশপ্ত করে শয়তান হিসাবে ঘোষণা দিলেন। ইলিসের সমস্ত রাগ তখন যেয়ে পড়ল আদম আ. এর তথা মানুষের উপর। কারণ মানুষের কারণেই তাকে অভিশপ্ত হতে হল।
তাই মানুষকেও বিপথে নিয়ে অভিশপ্ত করার সব ধরনের চেষ্টা সে করবে বলে ঠিক করল। শয়তানের এই কথাটা কুরআনে এভাবে বলা হয়েছে-
অর্থ: সে (ইবলিস) বলল, হে আমার রব, তুমি (আদমের মাধ্যমে) আমার যে সর্বনাশ করলে, তার শপথ করে বলছি, পৃথিবীতে পাপ কর্মকে আমি মানুষের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলব এবং তাদের সকলকে অভিশপ্ত করে ছাড়ব।
(আল হিজর:৩৯)
ইবলিসের এ কথার জবাবে আল্লাহ তাকে বলে দিলেন, তুই কেবল ধোঁকা দিয়ে মানুষকে বিপথে নেয়ার চেষ্টা করতে পারবি। শক্তি খাটিয়ে তাদের বিপথে নিতে পারবি না। ইবলিস তখন নিশ্চিত হল যে, ‘ধোঁকাবাজির মাধ্যমে’ তাকে সকল কাজ করতে হবে।
আর এই ‘ধোঁকাবাজি’ মানুষ যাতে সহজে গ্রহণ করে তার জন্যে একটা সাধারণ কর্মপন্থাও তাকে বের করতে হবে। ইবলিসের সেই সাধারণ পন্থা (ঈড়সসড়হ ংঃৎধঃবমু) হচ্ছে, কল্যাণ, লাভ বা সওয়াবের লোভ দেখিয়ে ধোঁকা দেয়া। কুরআন পড়ার ব্যাপারেও ইবলিস মুসলমানদের সওয়াবের কথা বলে নানাভাবে ধোঁকা দিয়েছে।
শয়তানের ধোঁকা নামক কৌশলের প্রথম প্রয়োগ
ইবলিস তার ধোঁকার কৌশলের অর্থাৎ সওয়াব বা কল্যাণের কথা বলে ধোঁকা দেয়া কৌশলের, প্রথম প্রয়োগ করে বেহেশতে, হযরত আদম আ. এর উপর। পবিত্র কুরআনে বর্ণনাকৃত সে ঘটনাটি নিম্নরূপ-
আল্লাহ আদম আ. ও বিবি হাওয়াকে বেহেশতে থাকতে দিলেন এবং যেখানে ইচ্ছা যেতে ও যা ইচ্ছা খেতে বললেন।
তবে একটা বিশেষ গাছের ফল খেতে এমনকি তার ধারে কাছে যেতেও তাঁদের নিষেধ করে দিলেন। শয়তান তখন বুঝতে পারলো, আদম আ. কে যদি তি করতে হয় তবে তাকে যে কোনোভাবে ঐ নিষিদ্ধ গাছের কাছে নিতে বা তার ফল খাওয়াতে হবে। সে তখন তার সাধারণ কৌশল অর্থাৎ কল্যাণের কথা বলে ধোঁকা দেয়ার কৌশল প্রয়োগ করল। আদম আ. কে সে বলল, তুমি তো জানো না, আল্লাহ কেন তোমাদের ঐ গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছেন। ঐ গাছের ফল খেলে তোমরা ফেরেশ্তা হয়ে যাবে এবং চিরকাল বেহেশতে থাকতে পারবে।
তাই আল্লাহ্ তোমাদের ঐ গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছেন। আদম আ. ও বিবি হাওয়া কল্যাণ বা লাভের কথা শুনে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে গেলেন। তাঁরা নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে ফেললেন। ধোঁকায় পড়ে হলেও এতে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা হয়। তাই আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়ে বেহেশতের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন।
এভাবে শয়তান তার কল্যাণের কথা বলে ধোঁকা দেয়ার সাধারণ কৌশলের প্রথমপ্রয়োগ করে এবং তাতে সে কৃতকার্যও হয়।
উপরের তথ্যগুলো জানার পর চলুন এখন কুরআনকে, অর্থসহ বা অর্থ ছাড়া পড়ার ব্যাপারে বা জ্ঞান অর্জনের ল্যসহ বা ছাড়া পড়ার ব্যাপারে বিবেক-বুদ্ধি, কুরআন ও হাদীসের তথ্যগুলো পর্যালোচনা করা যাক।
মূল বিষয়
বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে অর্থ ছাড়া কুরআন পড়া গুনাহ্ না সওয়াব
তথ্য-১
আল-কুরআন, কোনো গল্প, কবিতা বা গজলের কিতাব নয়। আল-কুরআন হচ্ছে আল্লাহ্ প্রদত্ত একখানা ব্যবহারিক (অঢ়ঢ়ষরবফ) কিতাব। আর সওয়াব কথাটার অর্থ হচ্ছে কল্যাণ।
কোনো ব্যবহারিক কিতাব পড়ার স্বতঃসিদ্ধ উদ্দেশ্য হচ্ছে, তার জ্ঞান অর্জন করা এবং সে জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করে নিজে কল্যাণপ্রাপ্ত হওয়া এবং অপরকে কল্যাণপ্রাপ্ত করা। কেউ যদি কোনো ব্যবহারিক কিতাব এমনভাবে পড়ে, যাতে ঐ কিতাবের জ্ঞান অর্জন হয় না (অর্থাৎ অর্থ ছাড়া বা না বুঝে পড়ে) এবং তারপর ঐ কিতাবের বক্তব্যকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে যায়, তবে অবধারিতভাবে সে মারাত্মক মারাত্মক ভুল করবে। নিজের ওপর ঐ জ্ঞান প্রয়োগ করলে সে নিজে তিগ্রস্ত হবে। আর অন্যদের উপর তা প্রয়োগ করলে অন্যরা তিগ্রস্ত হয়ে তাকে পুরস্কার দেয়াতো দূরের কথা শাস্তি দিবে। তাহলে বিবেক-বুদ্ধির চিরসত্য (টহরাবৎংধষ ঃৎঁঃয) রায় হচ্ছে, জ্ঞান অর্জন হয় না এমনভাবে বা জ্ঞান অর্জনের ল্য ছাড়া কোনো ব্যবহারিক কিতাব পড়লে কোনো কল্যাণ বা সওয়াব হয় না।
বরং তি বা গুনাহ হয়। আল-কুরআন যেহেতু একখানা ব্যবহারিক কিতাব, তাই বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী এ কিতাবও ইচ্ছাকৃতভাবে, অর্থ বা জ্ঞান অর্জনের ল্য ছাড়া পড়লে, সওয়াব না হয়ে গুনাহ হওয়ার কথা।
তথ্য-২
কোন কাজ যদি এমনভাবে করা হয় যে, তাতে তার উদ্দেশ্যটি কোনভাবেই সাধিত হবে না, তবে যে সময়টুকু কোন ব্যক্তি ঐ কাজে ব্যয় করবে, সে সময়টা অবশ্যই নষ্ট হবে অর্থাৎ তার অন্তত সময় অপচয়ের তি হবে।
আল-কুরআন পড়ার প্রথম স্তরের উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান অর্জন করা এবং দ্বিতীয় স্তরের উদ্দেশ্য হচ্ছে সে জ্ঞান অনুযায়ী আমল করা। অর্থ ছাড়া কুরআন পড়লে কুরআন পড়ার প্রথম স্তরের উদ্দেশ্যই সাধিত হয় না।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থ ছাড়া কুরআন পড়া ব্যক্তির সময় অপচয়ের তি যে হবে, তা দৃঢ়ভাবে বলা যায়।
আল-কুরআন অনুযায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে অর্থ ছাড়া কুরআন পড়া গুনাহ্ না সওয়াব
কুরআন থেকে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটো নিয়ম-
১. ঐ বিষয়ে কুরআনে যতোগুলো আয়াত বা বক্তব্য আছে, সে সকল বক্তব্যকে পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা। কারণ, একটি আয়াতে বিষয়টির একটি দিক এবং অন্য আয়াতে তার আর একটি দিক বা একটি আয়াতে বিষয়টি সংপ্তিভাবে আর অন্য আয়াতে তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ জন্য ইবনে কাছির, ইবনে তাইমিয়াসহ সকল মনীষীই বলেছেন, কুরআনের শ্রেষ্ঠ তাফসীর (ব্যাখ্যা) হচ্ছে, কুরআন।
২. একটি বিষয়ে কুরআনের কোনো আয়াতের বক্তব্যের যদি অস্পষ্টতা থাকে এবং ঐ বিষয়ে যদি অন্য কোনো স্পষ্ট আয়াত থাকে, তবে অস্পষ্ট আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা স্পষ্ট আয়াতটির সাথে সামঞ্জস্য রেখে করতে হবে।
কারণ আল্লাহ বলেছেন, (পরে আসছে) কুরআনে বিপরীতধর্মী কোনো কথা নেই।
চলুন এখন কুরআন অর্থসহ বা ছাড়া অর্থাৎ বুঝে বা না বুঝে পড়ায় সওয়াব বা গুনাহ হওয়ার ব্যাপারে আল-কুরআনের তথ্যসমূহ আলোচনা করা যাক-
তথ্য-১
কুরআন পড়ার কথাটি বলতে বা বুঝাতে যেয়ে মহান আল্লাহ আল-কুরআনে মাত্র তিনটি শব্দ উল্লেখ করেছেন। শব্দ তিনটি হচ্ছে-
এ শব্দ তিনটির প্রত্যেকটির আরবী অভিধান অনুযায়ী একটি মাত্র অর্থ হয়। সে অর্থটি হচ্ছে, অর্থ বুঝে পড়া বা বুঝে বুঝে অধ্যয়ন করা। আরবী অভিধানে এ শব্দ তিনটির অর্থ, না বুঝে বা অর্থ ছাড়া পড়া অতীতে কখনই ছিল না, বর্তমানে নেই এবং ভবিষ্যতেও হবে না।
কুরআনের আয়াতের তরজমা করার সর্বসম্মত নিয়ম হচ্ছে একটি শব্দের যদি একটি মাত্র অর্থ আরবী ভাষায় হয়, তবে ঐ আয়াতের তরজমা ও ব্যাখ্যা করার সময় সে অর্থটিই গ্রহণ করতে হবে। অন্য কোন রকম অর্থ গ্রহণ করা যাবে না।
এ সর্বসম্মত ও ১০০% বিবেক-সিদ্ধ রায় অনুযায়ী তাহলে কুরআনের যে সকল আয়াতে শব্দ তিনটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে অর্থসহ বুঝে বুঝে পড়া বা অধ্যয়ন করা ধরে তরজমা ও ব্যাখ্যা করতে হবে। অন্য কথায় সেখানে অর্থ ছাড়া বা না বুঝে পড়া ধরে তরজমা বা ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগই উসুলে তাফসীরে নেই।
তথ্য-২
অর্থ: পড় তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।
ব্যাখ্যা: আয়াতে কারীমায় ব্যাখ্যা হিসেবে বুঝে বুঝে পড় তোমার রবের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন অথবা না বুঝে বুঝে পড় তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, এ দুটি কথা উপস্থান করে পৃথিবীর মানুষকে যদি কোনটি সঠিক ও কোনটি ভুল তা জিজ্ঞাসা করা হয়, তবে পৃথিবীর সকল বিবেকবান মানুষ বলবেন, প্রথমটি সঠিক এবং দ্বিতীয়টি ভুল। শুধুমাত্র ১০০% পাগল ব্যক্তি বলতে পারে দ্বিতীয়টি সঠিক এবং প্রথমটি ভুল। তাই নিশ্চয়তা সহকারেই বলা যায় আল-কুরআনের মাধ্যমে মানুষকে দেয়া মহান আল্লাহর প্রথম নির্দেশটি হচ্ছে, ‘বুঝে বুঝে পড় তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’।
আয়াতে কারীমার বক্তব্যটি আদেশমূলক। তাই যারা ইচ্ছাকৃভাবে অর্থ ছাড়া বা না বুঝে কুরআন পড়ছেন, তারা মহান আল্লাহর নাযিলকৃত প্রথম ও সরাসরি (উরৎপবঃ) আদেশটিই অগ্রাহ্য করছেন অর্থাৎ তারা বড় গুনাহের কাজ করছেন এটি নিশ্চয়তা সহকারেই বলা যায়।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, কুরআন নাযিল হওয়ার ১৪০০ বছর পর আজ সহজ একটা বাক্যের অত্যন্ত সহজ একটা ব্যাখ্যা আবার নতুন করে বিশ্ব মুসলমানদের জানাতে ও বুঝাতে হচ্ছে। আরো অবাক ব্যাপার, কুরআন যারা অর্থ ছাড়া পড়েন তারা কিন্তু অন্য কোন বই অর্থ ছাড়া বা না বুঝে পড়েন না। শয়তানের ধোঁকার কাছে কী বিস্ময়করভাবে তারা হেরে গেছেন, তাই না?
তথ্য-৩
الَّذِيْنَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلاَوَتِهِ أُوْلَئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِط
অর্থ: আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি (তাদের মধ্য থেকে) যারা তা ‘হক’ আদায় করে তেলাওয়াত করে, তারাই ঐ কিতাবকে বিশ্বাস করে। (বাকারা : ১২১)
ব্যাখ্যা: এই গুরুত্বপূর্ণ আয়াতটি থেকে সঠিক শিা নিতে হলে বা এর সঠিক ব্যাখ্যা বুঝতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে, ‘তেলাওয়াতের হক’ কী কী? অত্যন্ত সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝা যায়, কোন গ্রন্থ, বিশেষ করে আল্লাহর কিতাবের ন্যায় ব্যবহারিক (অঢ়ঢ়ষরবফ) গ্রন্থ পড়ার প্রধান চারটি হক হচ্ছে-
ক. শুদ্ধ করে পড়া,
খ. অর্থ বুঝা অর্থাৎ তার জ্ঞান অর্জন করা,
গ. সে জ্ঞান অনুযায়ী আমল বা কাজ করা,
ঘ. সে জ্ঞান অন্যকে জানানো তথা দাওয়াত দেয়া।
বাস্তবে দেখা যায়, কিতাবধারীদের অনেকেই ঐ হকসমূহ আদায় করে তাদের উপর নাযিল হওয়া কিতাব তেলাওয়াত করেন না।
অর্থাৎ কেউ তেলাওয়াতের হক আদায় করে, আর কেউ কেউ তা না করে তাদের কিতাব তেলাওয়াত করেন। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই মহান আল্লাহ্ এ গুরুত্বপূর্ণ আয়াতটিতে বলেছেন, যারা তেলাওয়াতের হক আদায় করে তাদের উপর নাযিল হওয়া কিতাব তেলাওয়াত করে, তারাই ঐ কিতাবের প্রতি ঈমান এনেছে অর্থাৎ তারাই মু’মিন। তাহলে যে সকল শর্ত অনুযায়ী কুরআনের কোন বক্তব্য আমান্য করলে গুনাহ হয় (১৭নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে), সেগুলোকে সামনে রাখলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে তেল্ওয়াতের হক আদায় না করে, কিতাব তেলাওয়াত করে, তারা ঐ কিতাবের প্রতি ঈমান আনে নাই। অর্থাৎ তারা কুফরীর গুনাহে গুনাহগার। সুতরাং আল্লাহ এখানে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, কিতাবধারীদের মধ্যে যারা (ইচ্ছাকৃতভাবে) উপরে উল্লেখিত চারটি হকের একটিও আদায় না করে, কিতাব তেলাওয়াত করে বা করবে, তারা কুফরীর গুনাহে গুনাহগার হবে।
এবার চলুন উল্লেখিত চারটি হকের পারস্পরিক গুরুত্বটা বিবেচনা করা যাক। সহজেই বুঝা যায় ঐ চারটি হকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণটি হচ্ছে অর্থ বুঝা বা জ্ঞান অর্জন করা। কারণ ভুল করে পড়লে অর্থ পাল্টে যায় বলেই শুদ্ধ করে পড়তে হয়। আর অর্থ না বুঝলে কোন গ্রন্থ তেলাওয়াত করে সে অনুযায়ী আমল করা বা তার দাওয়াত দেয়া কখনই সম্ভব নয়।
এখন চলুন দেখা যাক, আল্লাহর কিতাব আল-কুরআনধারী মুসলমানরা এই গুরুত্বপূর্ণ আয়াতটির বক্তব্যকে কীভাবে বা কতটুকু মানে বা অনুসরণ করে।
আল্লাহ এখানে বলেছেন, যারা উল্লেখিত চারটি হকের একটিও ইচ্ছা করে আদায় না করে কুরআন তেলাওয়াত করে বা করবে, তারা কুরআনের প্রতি ঈমান আনেনি অর্থাৎ কুফরীর গুনাহে গুনাহগার। আর এ ব্যাপারে মুসলমানদের বিশ্বাস হচ্ছে-
ক. ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআন ভুল পড়লে গুনাহ হয়। এ বিষয়ে সবাই একমত।
খ. ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআন অনুযায়ী আমল না করলে গুনাহ হয়। এ ব্যাপারেও কারো দ্বিমত নেই।
গ. ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআনের জ্ঞান অন্যকে না পৌঁছালে গুনাহ হয়। এ ব্যাপারেও সকলে একমত।
ঘ. ইচ্ছাকৃতভাবে অর্থ ছাড়া বা জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য ছাড়া কুরআন পড়লে গুনাহ নয় বরং সওয়াব হয়। এ বিষয়টি বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমান বিশ্বাস করেন এবং সে অনুযায়ী আমলও করেন।
সুধী পাঠক, চিন্তা করে দেখুন, কুরআন তেল্ওয়াতের সময় হক ইচ্ছাকৃতভাবে আদায় না করলে, গুনাহ্ হবে না সওয়াব হবে, এ বিষয়ে অপোকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ হকের ব্যাপারে আল্লাহর দেয়া রায়কে সকল মুসলমান মেনে নিয়েছেন কিন্তু সব চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হকটির ব্যাপারে, অধিকাংশ মুসলমান আল্লাহর রায়ের বিপরীতটা মেনে নিয়েছে এবং সে অনুযায়ী আমলও করছেন।
কী অবাক কান্ড, তাই না?
তথ্য-৪
অর্থ: কুরআন ‘রতল’ কর নিয়ম-কানুন মেনে, স্পষ্ট করে ধীরে ধীরে।
(মুয্যাম্মিল:৪)
ব্যাখ্যা: এ আয়াতটি বহুলপ্রচারিত। যারা কুরআন-হাদীস কিছু জানেন তাদের কুরআন পড়ার পদ্ধতির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে প্রায় সবাই এ আয়াতটিই উল্লেখ করবেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এ আয়াতখানিরও رَتَلَ শব্দের অর্থ না বুঝে পড়া বলে বহুলভাবে প্রচারিত হয়েছে এবং তার উপর ব্যাপকভাবে আমলও হচ্ছে। পূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি رَتَلَ শব্দের আরবী আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অর্থসহ বুঝে পড়া।
তাই رَتَلَ শব্দের সঠিক অর্থ ধরে এই আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে- কুরআন পড়তে হবে সঠিক (তাজবীদের নিয়ম অনুযায়ী) উচ্চারণ করে, অর্থ বুঝে যেখানে যে ভাব প্রকাশ করতে চাওয়া হয়েছে সেখানে সে ভাব প্রকাশ করে। কারণ পড়ার নিয়ম-কানুনের মধ্যে এ তিনটি বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত।
তাহলে এ আয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকেও ইচ্ছাকৃতভাবে অর্থ ছাড়া কুরআন পড়া হচ্ছে, ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর নির্দেশকে অমান্য করা অর্থাৎ বড় গুনাহের কাজ।
তথ্য-৫
সূরা ছোয়াদের ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন-
অর্থ: (হে মুহাম্মদ,) এই যে কিতাব (কুরআন) আমি তোমার উপর নাজিল করেছি, তা একটি বরকতময় কিতাব। মানুষেরা যেন এর আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে।
ব্যাখ্যা: আল্লাহ্ এই আয়াতে মানুষকে আল-কুরআনের বক্তব্য নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে বলেছেন। কোনো বক্তব্য নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা আর তা না বুঝে পড়া, সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কাজ। তাই যারা অর্থছাড়া বা না বুঝে কুরআন পড়ছেন তারা এ আয়াতের বক্তব্যেরও বিপরীত কাজ করছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর নির্দেশের বিপরীতধর্মী কাজ করা গুনাহ না সওয়াব এটি বোঝা কি কঠিন?
তথ্য-৬
সূরা বাকারার ২১৯ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলছেন-.
অর্থ: তারা তোমাকে মদ ও জুয়ার ব্যাপারে (আল্লাহর নির্দেশ সম্পর্কে) জিজ্ঞাসা করে। তাদের বলে দাও, এই দুটো জিনিসে রয়েছে কিছু উপকার ও অনেক তি এবং এদের তির দিকটা উপকারের দিক থেকে অনেক অনেক বেশি।
(নেক কাজে) কী কী খরচ করবে এ ব্যাপারেও তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে। বলে দাও, দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণের পর অতিরিক্ত যা থাকবে তাই খরচ করবে। এইভাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নির্দেশসমূহ কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বলে দেন, যাতে তা নিয়ে তোমরা চিন্তা-গবেষণা কর বা করতে পার।
ব্যাখ্যা: ল্য করুন, আয়াতটির প্রথম দিকে আল্লাহ্ মদ ও জুয়ার অপকারিতা ও উপকারিতা সম্বন্ধে কিছু মূল তথ্য উল্লেখ করার মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন, ঐ দুটোয় সামান্য কিছু উপকার আছে এবং অনেক অনেক তি বা অপকার আছে। এরপর আয়াতটির শেষাংশে তিনি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের নীতি এবং ঐ বিষয়ে মানুষের কী কর্তব্য হবে, তা জানিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে তিনি পরিষ্কারভাবে কোনো একটি বিষয় সম্বন্ধে চিরসত্য মৌলিক তথ্যগুলো জানিয়ে দেন। এরপর মানুষের কর্তব্য হচ্ছে, ঐ তথ্যকে মূল ধরে চিন্তা-গবেষণা করে ঐ বিষয় সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য বের করে নেয়া।
আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ মদ ও জুয়ার দোষ-গুণ সম্বন্ধে চিরসত্য মূল তথ্যটা (ইধংরপ রহভড়ৎসধঃরড়হ) মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মদ ও জুয়ার মধ্যে সামান্য কিছু উপকারিতা রয়েছে। কিন্তু তার চাইতে অনেক অনেক বেশি রয়েছে অপকারিতা।
এখন মানুষের কর্তব্য হচ্ছে মদ ও জুয়ার দোষ-গুণের ব্যাপারে ঐ তথ্যটাকে মূল ধরে আরো চিন্তা-গবেষণা করা অর্থাৎ ঐ দুটো জিনিসের দোষ-গুণ সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত জানা এবং তা মানুষকে জানানো। যাতে মানুষেরা ঐ দুটো জিনিসের মহাতিকর দিকগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারে এবং তার গুণটুকু শরীয়ত মত ব্যবহার করে উপকৃত হতে পারে। মদ ও জুয়ার বেশ কিছু অপকারিতা আমরা এখন জানি। তবে এই আয়াতের তথ্য থেকে আমার মনে হয়, মদ ও জুয়া সম্বন্ধে আরো চিন্তা-গবেষণা হওয়া দরকার। আর তা হলে ঐ দুটো জিনিসের আরো অনেক তিকর দিক মানুষ জানতে পারবে এবং তা থেকে ভবিষ্যত প্রজন্ম বাঁচতে পারবে।
সুধী পাঠক, চিন্তা করে দেখুন, কতো স্পষ্ট করে আল্লাহ্ এখানে কুরআনের আয়াত নিয়ে কী করতে হবে এবং কেন করতে হবে, তা বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কুরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে হবে। কারণ তাতে মানুষের কল্যাণ হবে।
না বুঝে পড়া হচ্ছে চিন্তা-গবেষণার সম্পূর্ণ উল্টো কাজ। এই আয়াতের দৃষ্টিতেও তাই কুরআনকে অর্থ ছাড়া বা না বুঝে পড়া হল কুরআন পড়ার ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশের ১০০% উল্টো কাজ।
অর্থাৎ তা বড় গুনাহের কাজ।
তথ্য-৭
অর্থ: তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না? (নিসা : ৮২)
ব্যাখ্যা: আল্লাহ্ এখানে কুরআনের বক্তব্য নিয়ে চিন্তা-গবেষণা না করার জন্যে তিরস্কার করেছেন। কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা না করা যদি আল্লাহর তিরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত কাজ হয় তবে চিন্তা-গবেষণার উল্টো কাজ অর্থাৎ উচ্ছাকৃতভাবে না বুঝে পড়া, অবশ্যই আল্লাহর আরো কঠিন তিরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত কাজ হবে। আল্লাহর কঠিন তিরস্কার পাওয়ার যোগ্য কাজ সওয়াবের কাজ, না বড় গুনাহের কাজ? প্রিয় পাঠক, আপনারাই বলুন।
তথ্য-৮
অর্থ: বল, অন্ধ ও চুষ্মান কি কখনও সমান হতে পারে? তোমরা কি (কুরআনের বক্তব্য নিয়ে) চিন্তা-গবেষণা কর না? (আন-আম : ৫০)
ব্যাখ্যা: এ আয়াতটিতেও মহান আল্লাহ্ কুরআনের বক্তব্য নিয়ে চিন্তা-গবেষণা না করার জন্য তিরস্কার করেছেন।
অর্থাৎ এই আয়াতটির দৃষ্টিকোণ থেকেও অর্থ ছাড়া বা না বুঝে কুরআন পড়লে আল্লাহর তিরস্কারের সম্মুখীন হতে হবে অর্থাৎ বড় গুনাহ্গার হতে হবে।
তথ্য-৯
সূরা মুহাম্মদের ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন: .
অর্থ: তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না? না তাদের অন্তরে তালা পড়ে গিয়েছে?
ব্যাখ্যা: এখানে আল্লাহ্ অন্তরে তালা পড়ে গিয়েছে বলার মাধ্যমে কুরআনের বক্তব্য নিয়ে চিন্তা-গবেষণা না করার জন্যে আরো কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেছেন। তাহলে এ আয়াতটির দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থ ছাড়া বা না বুঝে কুরআন পড়া আল্লাহর নিকট আরো কঠোরভাবে তিরস্কৃত হওয়ার যোগ্য একটি কাজ। আল্লাহর নিকট কঠোরভাবে তিরস্কৃত হওয়ার যোগ্য কোন কাজ কখনও সওয়াবের কাজ হতে পারে না। তা অতি বড় গুনাহের কাজ হবে।
তথ্য-১০
সূরা আল ইমরানের ৭নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন-
অর্থ: তিনিই আল্লাহ্ যিনি তোমার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছেন। এই কিতাবে আছে মুহকামাত আয়াত। ঐগুলোই কুরআনের ‘মা’। বাকিগুলো হচ্ছে ‘মুতাশাবিহাত’ আয়াত। যাদের মনে কুটিলতা আছে তারা ফেতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ‘মুতাশাবিহাত’ আয়াতের পেছনে লেগে থাকে এবং তার প্রকৃত অর্থ বের করার চেষ্টা করে।
অথচ তার প্রকৃত অর্থ আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না।
ব্যাখ্যা: আল্লাহ এখানে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে রাসূলকে সা. উদ্দেশ্য করে নিম্নোক্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছেন।
প্রথমে আল্লাহ্ পাক বলেছেন, এই কিতাব অর্থাৎ আল-কুরআন নাযিল হয়েছে তাঁর নিকট থেকে।
এরপর তিনি বলেছেন, আল-কুরআনে আছে দু’ধরনের আয়াত- ‘মুহকামাত’ ও ‘মুতাশাবিহাত’। এর মধ্যে মুহকামাত আয়াতগুলো হচ্ছে কুরআনের ‘মা’ অর্থাৎ আসল আয়াত।
আল-কুরআনে মূল মুহকামাত আয়াত আছে প্রায় পাঁচ শত। মূল মুহকামাত আয়াতের বক্তব্যের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় করার জন্যে বা তার বক্তব্য বুঝানোর জন্যে বিভিন্ন কাহিনী বর্ণনা করা বা উদাহরণ দেয়া হয়েছে। এই আয়াতগুলোকে বলা হয়, কেচ্ছা অর্থাৎ কাহিনীর আয়াত এবং আমছাল অর্থাৎ উদাহরণের আয়াত। এ আয়াতগুলো হল মুহাকামাত আয়াতের সাহায্যকারী আয়াত। আল-কুরআনে এ ধরনের আয়াতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী।
মুহকামাত আয়াতগুলোর বক্তব্য অত্যন্ত সহজ ও স্পষ্ট আরবী শব্দের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। মূল মুহকামাত আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে ইসলামের আকিদা (বিশ্বাস), উপাসনা, ফারয়েজ, চরিত্রগত বিষয় এবং আদেশ-নিষেধসমূহ।
শেষে আল্লাহ্ বলেছেন, যাদের মানে কুটিলতা বা শয়তানি আছে তারাই শুধু বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে ‘মুতাশাবিহাত’ আয়াতের পেছনে লেগে থাকে এবং তার প্রকৃত অর্থ বা তাৎপর্য বের করার চেষ্টা করে। কারণ ‘মুতাশাবিহাত’ আয়াতের প্রকৃত অর্থ তিনি (আল্লাহ্) ছাড়া আর কেউই জানে না।
‘মুতাশাবিহাত’ আয়াতগুলোকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায়।
যথা-
১. ঐ সকল আয়াত যার বক্তব্য বিষয়টি মানুষ কখনও দেখেনি, স্পর্শ করেনি বা আস্বাদ করেনি (অর্থাৎ মানুষের ইন্দ্রিয়ের অতীত বিষয়সমূহ)। যেমন আল্লাহর আরশ, ফেরেশতা, বেহেশত, দোযখ, সিদরাতুল মুনতাহা ইত্যাদি। এগুলোর প্রকৃত অর্থ বা অবস্থা মানুষের পে বুঝা সম্ভব নয়।
২. কিছু কিছু সূরার শুরুতে কয়েকটি অরবিশিষ্ট যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, সে শব্দগুলো। যথা- الم، المص، يس ইত্যাদি।
এগুলোর কোন অর্থ হয় না।
উপরের তথ্যগুলো জানার পর এ কথা স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, ‘মুতাশাবিহাত’ আয়াত সম্বন্ধে আল-কুরআনের প্রত্য বক্তব্য হচ্ছে-
১. এর প্রকৃত অর্থ বা তাৎপর্য শুধু আল্লাহই জানেন। মানুষের পে তা বুঝা সম্ভব নয়।
২. যে সকল মুতাশাবিহাত আয়াতের অর্থ হয়, সেগুলোতে আল্লা।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।