তাকদীর (ভাগ্য!) পূর্ব নির্ধারিত - তথ্যটির প্রচলিত ও প্রকৃত ব্যাখ্যা
-প্রফেসর ডাঃ মোঃ মতিয়ার রহমান (এফ আর সি এস)
শুরুর কথা
‘তাকদীর পূর্বনিধারিত’ তথ্যটি কুরআন ও হাদীসে অনেকবার এসেছে। আবার তাকদীরে বিশ্বাস করা মুসলিমদের ঈমানের অংশ। তাই তাকদীর বলতে কুরআন ও হাদীসে কী বুঝান হয়েছে তা প্রতিটি মুসলিমের সঠিকভাবে জানা এবং তা বিশ্বাস করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘তাকদীর পূর্বনির্ধারিত’ তথ্যটি সম্বন্ধে বর্তমান বিশ্বের প্রায় সকল মুসলিমের ধারণা হচ্ছে
সকল কাজের ভাগ্য তথা ফলাফল আল্লাহ্ পূর্বে নির্ধারিত করে রেখেছেন,
মানুষের চূড়ান্ত ভাগ্য তথা বেহেশত বা দোযখ প্রাপ্তির বিষয়টিও পূর্বনির্ধারিত,
ঐ ভাগ্য পরিবর্তন করার মতা মানুষের নেই।
তাকদীর সম্বন্ধে প্রচলিত এ ধারণার বাস্তব যে ফল মুসলিম সমাজে ঘটেছে বা ঘটছে তা হল
১. দুষ্ট লোকেরা খারাপ কাজ করার যুক্তি খুঁজে পেয়েছে।
তারা বলে আমাদের ভাগ্যতো আল্লাহ্ পূর্বে নির্ধারণ করে রেখেছেন। তাই আমরা খারাপ কাজ করলে ফল যা হবে ভাল কাজ করলেও ফল তাই হবে।
২. সাধারণ মুসলিমরা কষ্টসাধ্য বা ত্যাগ স্বীকার করা লাগে এমন কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। কারণ তারা মনে করে নিয়েছে- কষ্ট করে বা ত্যাগ স্বীকার করে একটি কাজ করার পরও আল্লাহ্ ঐ কাজের যে ফল নির্ধারণ করে রেখেছেন তাতো পরিবর্তন করা যাবে না। তাই অযথা কষ্ট করার বা ঝুঁকি নেয়ার দরকার কী?
৩. বিজ্ঞানের সকল দিকের এক সময়ের শ্রেষ্ঠ মুসলিম জাতি গবেষণা বন্ধ করে দিয়ে আজ বিজ্ঞানের সকল েেত্র বিশ্বের অন্য জাতিদের তুলনায় ব্যাপকভাবে পিছিয়ে পড়েছে।
যেমন-
ডাক্তারী বিদ্যায় গবেষণার ব্যাপারে তারা মনে করেছে কষ্ট করে গবেষণা করে নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি বা ঔষধ আবিষ্কার করার কী দরকার? রোগ ভাল হবে কি হবে না এটিতো আল্লাহ্ পূর্বে নির্ধারণ করে রেখেছেন।
কষ্ট করে গবেষণা করে উন্নতমানের যুদ্ধাস্ত্র তৈরী করা মুসলিমরা বেদরকারী মনে করেছে। কারণ যুদ্ধের ফলাফলতো পূর্বনির্ধারিত। তাই উন্নত মানের যুদ্ধাস্ত্র থাকলে ফলাফল যা হবে, না থাকলেও ফলাফল তাই হবে।
৪. কোন কোন মু’মিনের বুঝ তাকদীরের প্রকৃত অর্থ ও ব্যাখ্যার কাছাকাছি হলেও বিষয়টি তারা ভালভাবে বুঝে নেননি।
ফলে বিষয়টিকে যেমন তারা মনের প্রশান্তিসহকারে বিশ্বাস করতে পারেন না তেমনই অন্য মানুষকে তা যুক্তিগ্রাহ্য করে বুঝাতে পারেন না।
তাই, ইসলামের সকল মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং মানব সভ্যতার বর্তমান পর্যায়ের বিজ্ঞানের জ্ঞানের সহায়তায়, তাকদীরের প্রকৃত অর্থ ও ব্যাখ্যা বোধগম্য এবং যুক্তিগ্রাহ্য করে উপস্থাপন করা বর্তমান প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য। আশা করি এর মাধ্যমে তাকদীরের উপর মুসলমানদের বিশ্বাস দৃঢ় হবে এবং তাকদীরে বিশ্বাসের মাধ্যমে আল্লাহ্, মানুষ বা মুসলমানদের দুনিয়া ও আখিরাতে যে কল্যাণ দিতে চেয়েছিলেন তা পাওয়া সম্ভব হবে।
মূল বিষয়
তাকদীর সম্পর্কে নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হলে প্রথমে কুরআন ও হাদীসে উল্লিখিত তাকদীরের সঙ্গে প্রত্য (উরৎবপঃ) বা পরো (ওহফরৎবপঃ) ভাবে সম্পর্কযুক্ত নিুোক্ত বিষয়সমূহ জানতে, বুঝতে ও সম্পূরক ব্যাখ্যা করতে হবেÑ
১. মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর উদ্দেশ্য।
২. উদ্দেশ্যটির বাস্তবায়ন ইনসাফের ভিত্তিতে হওয়ার নিমিত্তে মানুষের জন্যে আল্লাহপ্রদত্ত নিম্নোক্ত সুযোগ সুবিধাসমূহÑ
ক. করণীয় বা নিষিদ্ধ (সঠিক বা ভুল) বিষয়সমূহ নির্ভুলভাবে মানুষকে জানিয়ে দেয়া,
খ. করণীয় বা নিষিদ্ধ কাজ করতে প্রয়োজনীয় জিনিসসমূহ মানুষকে যোগান দেয়া বা মানুষ যাতে তা যোগাড় করে নিতে পারে তার ব্যবস্থা রাখা,
গ. করণীয় বা নিষিদ্ধ কাজ করার ইচ্ছা করা এবং সে ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার জন্যে চেষ্টা-সাধনা করার ল্েয মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া।
ঘ. জন্মগতভাবে বা বিনা প্রচেষ্টায় কেউ সুযোগ-সুবিধা বেশি বা কম পেয়ে থাকলে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার সময় তা হিসেবে আনা।
৩. কর্মফল বা পরিণতির জন্যে মানুষই দায়ী।
৪. তাকদীর, সৃষ্টির পূর্বে নির্ধারিত করে রাখা হয়েছে এবং তা অপরিবর্তনীয়।
৫. তাকদীর পরিবর্তন হওয়ার উপায় ও কারণ।
৬. মানুষের বা মহাবিশ্বের সকল কিছুর পরিণতি আল্লাহ সৃষ্টির পূর্বে একটি কিতাবে লিখে রেখেছেন।
সবকিছুর পরিণতি ঐ কিতাবে থাকা লিখা অনুযায়ী হবে।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর উদ্দেশ্য
তাকদীরের সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা বুঝার জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর উদ্দেশ্যটি নির্ভুলভাবে জানা ও বুঝা। তাই চলুন প্রথমে সে উদ্দেশ্যটি আল-কুরআন থেকে নির্ভুলভাবে জেনে ও বুঝে নেয়া যাকÑ
তথ্য - ১
اَلَّذِى خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَوةَ لِيَبْلُوَكُمْ اَيُّكُمْ اَحْسَنُ عَمَلأ.
অর্র্থ: তিনি (মহান আল্লাহ) মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যেন পরীা করে নিতে পারেন কে কাজে-কর্মে উত্তম (শ্রেষ্ঠ)। (মুলক : ২)
তথ্য - ২
وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلاَئِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ.
অর্র্থ: তিনি তোমাদের পৃথিবীতে তাঁর খলীফা করে পাঠিয়েছেন এবং একজনকে অন্য জনের উপর (বিভিন্ন দিক দিয়ে) শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন, যাতে তোমাদের যাকে যা দেয়া হয়েছে সে অনুযায়ী পরীা (যাচাই) করে নিতে পারেন।
(আন’আম : ১৬৫)
তথ্য - ৩
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُوْلُوْا آمَنَّا وَهُمْ لاَ يُفْتَنُوْنَ.وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ.
অর্থ: মানুষ কি মনে করেছে যে, ‘ঈমান এনেছি এটুকু বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে? আর তাদের (কর্মের মাধ্যমে) পরীা করা হবে না?’ অথচ আমিতো পূর্বে গত হওয়া সকলকে (কর্মের মাধ্যমে) পরীা করে নিয়েছি।
আল্লাহকে তো অবশ্যই (কর্মের মাধ্যমে) জেনে নিতে হবে কে ঈমান আনার দাবীর ব্যাপারে সত্যবাদী, আর কে সে ব্যাপারে মিথ্যাবাদী। (আন-কাবুত : ২,৩)
আল-কুরআনের এ সকল তথ্য এবং তথায় উল্লেখ থাকা এ ধরনের আরো অনেক তথ্য থেকে নিঃসন্দেহে জানা ও বুঝা যায় মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর উদ্দেশ্যটি হচ্ছেÑ‘মানুষকে কর্মের মাধ্যমে তথা করণীয় কাজ করা এবং নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে পরীা নিয়ে ইনসাফ সহকারে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া’।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যটি ইনসাফ ভিত্তিক বাস্তবায়ন হওয়ার নিমিত্তে বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী মানুষের যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া উচিত
সাধারণ বিবেক-বুদ্ধির আলোকে সহজেই বলা যায় যে, পরীা নেয়ার ভিত্তিতে দেয়া পুরস্কার বা শাস্তি যদি ইনসাফ ভিত্তিক হতে হয়, তবে সে পরীা নেয়া এবং পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার আগে নিুের সুযোগ-সুবিধা চারটি অবশ্যই পূরণ করতে হবেÑ
ক. সঠিক বা ভুল উত্তর কোন্টি তা সঠিকভাবে জানিয়ে দেয়া
কোন্ উত্তরটি সঠিক আর কোন্টি ভুল অর্থাৎ কোন্ কাজটি করণীয় আর কোন্টি নিষিদ্ধ, পরীা নেয়ার আগে সেটি পরীার্থীকে কোন না কোনভাবে অবশ্যই জানিয়ে দিতে হবে। কারণ কোনভাবেই জানতে না পারার দরুন যদি কেউ কোন সিদ্ধ কাজ না করে বা নিষিদ্ধ কাজ করে তবে তাকে শাস্তি দেয়া সাধারণ বিবেক-বিরুদ্ধ।
খ. উত্তর লিখার জন্যে প্রয়োজনীয় সকল জিনিস যোগান (ঝঁঢ়ঢ়ষু) দেয়া
সঠিক বা ভুল উত্তর দিতে তথা করণীয় বা নিষিদ্ধ কাজ করতে যে সকল উপায়-উপকরণ লাগে সেগুলো ব্যক্তিকে যোগান দিতে হবে বা সে যেন তা যোগাড় করে নিতে পারে তার সকল সুযোগ বা ব্যবস্থা থাকতে হবে।
কারণ তা না হলে সেতো সঠিক বা ভুল উত্তর লিখতে তথা করণীয় বা নিষিদ্ধ কোন কাজ করতে পারবে না।
গ. সঠিক বা ভুল উত্তর দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া ও বাস্তবে তা কার্যকর করার জন্যে চেষ্টা করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া
পরীা নিয়ে দেয়া পুরস্কার বা শাস্তি ইনসাফ ভিত্তিক হতে হলে পরীার্থীকে অবশ্যই সঠিক বা ভুল উত্তর দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া এবং সে অনুযায়ী উত্তর লিখার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। কারণ, কাউকে যদি সঠিক বা ভুল উত্তর লিখতে বাধ্য করা হয়, তবে সেটিকে পরীা নেয়া না বলে বাধ্য করা বলতে হবে। আর বাধ্য হয়ে করা কাজের ভিত্তিতে কাউকে পাস বা ফেল করানো তথা পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া কোন মতেই ইনসাফ সম্মত হতে পারে না। অর্থাৎ মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে থাকা আল্লাহর মহাপরিকল্পনাটি ইনসাফ ভিত্তিক হতে হলে করণীয় বা নিষিদ্ধ কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া ও সে অনুযায়ী চেষ্টা-সাধনা করার ব্যাপারে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে।
ঘ. জন্মগতভাবে বা বিনাপ্রচেষ্টায় কেউ সুযোগ-সুবিধা বেশী বা কম পেয়ে থাকলে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার সময় তা হিসেবে আনা
একটি পরীায় কিছু পরীার্থীর যদি এমন কিছু দুর্বলতা থাকে যেটি এড়ানো তাদের পে কোনমতেই সম্ভব ছিল না এবং কিছু পরীার্থী যদি ঐ বিষয়গুলোয় বিনা প্রচেষ্টায় শক্তিশালী হয়ে গিয়ে থাকেতবে সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি বলে ঐ সকল পরীার্থীকে একই মানদণ্ডে বিচার করে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া কোনমতেই ইনসাফ হবে না। অর্থাৎ বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী ঐ বিষয়গুলো যথাযথভাবে পর্যালোচনায় এনে ফলাফল নির্ণয় করে পুরস্কার বা শাস্তি দিলেই শুধু সে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া ইনসাফ ভিত্তিক হবে।
মানুষের জীবনে এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো মানুষের নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টা অনুযায়ী হয় নাই, অর্থাৎ যেগুলো পরিবর্তন করা মানুষের কর্তৃত্বের বাইরে, যেমন
জন্মের স্থান, কাল, বংশ;
লিঙ্গ,
শারীরিক মূল গঠন, চেহারা ও রং,
মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মূল গঠন।
এ বিষয়গুলো মানুষ নিজ ইচ্ছা বা চেষ্টা ছাড়া তথা জন্মগতভাবে (ঐবৎরফরঃধৎরষু) পেয়ে থাকে। আবার তা পরিবর্তন করাও তার সাধ্যের (মতার) বাইরে।
এ বিষয়গুলোর উপস্থিতি বা অভাবকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন না করে, কর্মের জন্যে সকল মানুষকে একই ল্েয (এড়ধষ) পৌঁছানো নির্দিষ্ট করে দিলে এবং তাতে সফল হওয়া বা না হওয়ার জন্যে একই ধরনের পুরস্কার বা শাস্তি দিলে, সে পুরস্কার বা শাস্তি ইনসাফের ভিত্তিতে দেয়া হবে না। অর্থাৎ কর্মের মাধ্যমে পরীা নিয়ে মানুষকে ইনসাফের ভিত্তিতে পুরস্কার বা শাস্তি দিতে হলে জন্মগতভাবে যে সকল বিষয় সে পেয়েছে বা পায় নাই, তা খেয়াল রেখেই সফল হওয়া না হওয়াকে বিচার করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পুরস্কার বা শাস্তি নির্ধারণ করতে হবে। দুনিয়ায় পরীা নিয়ে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে সাধারণত এটি হিসেবে আনা হয় না।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে থাকা আল্লাহর উদ্দেশ্যটি ইনসাফ ভিত্তিক বাস্তাবায়ন হওয়ার জন্যে সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি নির্ণিত সুযোগ-সুবিধা তিনটি আল্লাহ্ মানুষকে দিয়েছেন তার প্রমাণ
ক. করণীয় ও নিষিদ্ধ কাজ (সঠিক ও ভুল উত্তর) কোন্গুলো তা নির্ভুলভাবে মানুষকে জানিয়ে দেয়া
তথ্য- ১
لآاِكْرَاهَ فِى الدِّيْنِ قَدْ تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَىِّ فَمَنْ يَّكْفُرْ باِلطَّاغُوْتِ وَيُؤْمِنْ باِللهِ فَقَدِاسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثقَى.
অর্র্থ: ইসলামে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। কোন্টা সত্য (করণীয়) আর কোন্টা মিথ্যা (নিষিদ্ধ) তা স্পষ্ট করে (জানিয়ে) দেয়া হয়েছে।
এখন যে ব্যক্তি খোদাদ্রোহী শক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর ওপর ঈমান আনলো, সে একটা নির্ভরযোগ্য আশ্রয় গ্রহণ করলো। (বাকারা : ২৫৬)
ব্যাখ্যা: এ আয়াতে মহান আল্লাহ পরিষ্কারভাবে বলেছেন কোনটি ন্যায় ও কোনটি অন্যায় অর্থাৎ কোন্টি করণীয় ও কোন্টি নিষিদ্ধ তা মানুষকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
তথ্য - ২
وَهَدَيْنهُ النَّجْدَيْنَ.
অর্র্থ: আর উভয় (সঠিক ও ভুল) পথ কি তাকে (মানুষকে) দেখাই নাই?
(বালাদ : ১০)
ব্যাখ্যা: এখানেও আল্লাহ প্রশ্ন করার মাধ্যমে স্পষ্ট করে বলেছেন তিনি মানুষকে সঠিক ও ভুল উভয় পথ তথা উভয় ধরনের বিষয়ই জানিয়ে দিয়েছেন।
তথ্য - ৩
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىْ اُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِِّلنَّاسِ وَبَيِّنتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ.
অর্থ: রমযান মাস। এ মাসেই কুরআন নাযিল হয়েছে।
তা গোটা মানব জাতির জীবন-যাপনের পথনির্দেশ (দানকারী গ্রন্থ)। তা স্পষ্ট পথনির্দেশ এবং (সত্য ও মিথ্যার) পার্থক্যকারী (গ্রন্থ)। (বাকারা : ১৮৫)
ব্যাখ্যা: এখানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে আল-কুরআন গোটা মানব জাতির জন্যে স্পষ্ট পথনির্দেশ ও সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী। অর্থাৎ কুরআনের মাধ্যমে মানুষকে সকল মূল করণীয় ও নিষিদ্ধ তথা সকল প্রথম স্তরের মৌলিক করণীয় ও নিষিদ্ধ বিষয় জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
অনেক আল-কুরআনের এ ধরনের তথ্য থেকে পরিষ্কারভাবে জানা ও বুঝা যায়, মহান আল্লাহ মানুষকে করণীয় ও নিষিদ্ধ কাজ কোন্গুলো তা জানিয়ে দিয়েছেন।
আর তা জানিয়েছেন বা জানার ব্যবস্থা করেছেন নিুোক্ত তিনটি উৎসের মাধ্যমে Ñ
ক. আল-কুরআন,
খ. সুন্নাহ বা হাদীস এবং
গ. মানুষের বিবেক-বুদ্ধি
কুরআনের মাধ্যমে সকল মূল তথা প্রথম স্তরের মৌলিক, অনেক দ্বিতীয় স্তরের মৌলিক ও কিছু অমৌলিক বিষয় জানানো হয়েছে। সুন্নাহের মাধ্যমে সকল প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের মৌলিক ও অনেক অমৌলিক বিষয় জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আর মানুষের প্রয়োজনীয় যে সকল অমৌলিক বিষয় কুরআন-সুন্নাহের মাধ্যমে স্পষ্ট করে জানানো হয়নি সে গুলিকে বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে, আল্লাহর তৈরী করে রাখা প্রাকৃতিক নিয়ম হতে, কুরআন ও সুন্নাহের আলোকে বের করে নেয়ার জন্যে মহান আল্লাহ কুরআন ও সুন্নাহের মাধ্যমে বারবার তাগিদ দিয়েছেন।
খ. করণীয় বা নিষিদ্ধ কাজ করতে (সঠিক বা ভুল উত্তর লিখতে) প্রয়োজনীয় সকল জিনিস মানুষকে যোগান দেয়া বা মানুষ যাতে তা যোগাড় করে নিতে পারে তার ব্যবস্থা রাখা
বাস্তব জগতে দেখা যায় ইসলাম সিদ্ধ বা নিষিদ্ধ যে কোন কাজ করার জন্যে যত জিনিসের প্রয়োজন, প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহ তা তৈরী করে রেখেছেন অথবা তৈরী করার সকল উপাদান সৃষ্টি করে রেখেছেন। মানুষ বিবেক-বুদ্ধি বা জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে তা তৈরী করে নিতে পারে।
আর এ বিষয়টি মহান আল্লাহ আল-কুরআনের মাধ্যমে নিুোক্তভাবে জানিয়ে দিয়েছেন Ñ
তথ্য - ১
هُوَ الَّذِىْ خَلَقَ لَكُمْ مَافِى الْاَرْضِ جَمِيْعًا.
অর্থ: তিনি (আল্লাহ) পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সবই তোমাদের (ব্যবহারের) জন্যে সৃষ্টি করেছেন (করে রেখেছেন)। (বাকারা : ২৯)
তথ্য - ২
وَسَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّموَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا مِنْهُ.
অর্র্থ: মহাকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার সবকিছুকে তিনি (আল্লাহ) নিজের প থেকে (নিজ ইচ্ছায়) তোমাদের (কল্যাণের জন্যে) কর্মে নিয়োজিত করে রেখেছেন। (জাসিয়া : ১৩)
তথ্য - ৩
أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّموَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً.
অর্র্থ: তুমি কি ল্য করনি নভোমণ্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহতায়ালা তোমাদের কল্যাণের জন্যে নিয়োজিত করে রেখেছেন এবং নিজ থেকে প্রকাশ্য ও গোপন নিয়ামতসমূহ (কল্যাণকর জিনিসসমূহ) তোমাদের জন্যে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন? (লোকমান : ২০)
আল-কুরআনের উল্লিখিত তথ্যসমূহ এবং তথায় উল্লেখ থাকা এ ধরনের আরো অনেক তথ্য এবং বিবেক-বুদ্ধির আলোকে নির্দ্বিধায় বলা যায়Ñ
মহাবিশ্বের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সকল কিছু আল্লাহ মানুষের ব্যবহারের জন্যে সৃষ্টি বা তৈরী করে রেখেছেন,
ঐ জিনিসগুলি হয় ব্যবহার করার উপযোগী করে আল্লাহ তৈরী করে রেখেছেন অথবা আল্লাহর সৃষ্টি করে রাখা উপাদান ব্যবহার করে তা তৈরী করে নেয়ার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি মানুষকে তিনি দিয়েছেন,
ঐ জিনিসগুলি মানুষ ইসলাম সিদ্ধ বা নিষিদ্ধ যেকোন কাজ করার জন্যে ব্যবহার করতে পারে।
গ. করণীয় বা নিষিদ্ধ কাজ করার ইচ্ছা করা এবং সে ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার ল্েয চেষ্টা-সাধনা করার ব্যাপারে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা
বাস্তবে আমরা দেখি ইসলাম সিদ্ধ বা নিষিদ্ধ যেকোন কাজ করার ইচ্ছা করা বা সিদ্ধান্ত নেয়া এবং সে ইচ্ছা বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্যে চেষ্টা-সাধনা করার ব্যাপারে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন। আর মহান আল্লাহ যে মানুষকে এ স্বাধীনতা দিয়েছেন তা তিনি আল-কুরআনের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন নিুোক্তভাবেÑ
ঈমান আনার ব্যাপারে মানুষ স্বাধীন
তথ্য - ১
وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ قف فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَّمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ.
অর্থ:বলে দাও এ মহাসত্য এসেছে তোমাদের রবের নিকট থেকে।
এখন যার ইচ্ছা ঈমান আনতে পার, আর যার ইচ্ছা অস্বীকার করতে পার। (কাহাফ : ২৯)
তথ্য - ২
وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيْعًا أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّى يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ.
অর্থ: তোমার রব যদি ইচ্ছা করতেন তবে পৃথিবীর সকলেই ঈমান আনত। তুমি কি লোকদের মু‘মিন হওয়ার জন্যে জবরদস্তি করবে? (ইউনুস:৯৯)
আল-কুরআনের এ সকল তথ্য এবং এ ধরনের আরো অনেক তথ্য থেকে নিঃসন্দেহে জানা ও বুঝা যায় ঈমান আনার ব্যাপারে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন। অর্থাৎ ঈমান আনা বা না আনা সম্পূর্ণ মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
সিদ্ধ বা নিষিদ্ধ উভয় ধরনের কাজ করার ব্যাপারে মানুষ স্বাধীন
তথ্য - ১
اِنَّا هَدَيْنَ السَّبِيْلَ اِماَّ شَاكِراً وَّ اِماَّكَفُوْراً.
অর্র্থ: আমি তাদের (মানুষদের) সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছি।
এখন ইচ্ছা করলে তারা (তা অনুসরণ করে কল্যাণপ্রাপ্ত হয়ে) শোকরকারী হতে পারে, অথবা তা অস্বীকার করতে পারে (অস্বীকার করে ভুল পথ অনুসরণ করতে পারে)।
(দাহার:৩)
তথ্য - ২
اِنَّ هَذِهِ تَذْكِرَةٌ ج فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ اِلَى رَبِّهِ سَبِيْلاً.
অর্র্থ: এটা (আল-কুরআনের বক্তব্য) একটি নসিহত বিশেষ। এখন যার ইচ্ছা নিজের রবের পথ অবলম্বন করুক। (দাহার : ২৯)
তথ্য - ৩
فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ اِلى رَبِّهِ سَبِيْلأ.
অর্র্থ: যার ইচ্ছা হয় আপন প্রতিপালকের পথ অবলম্বন করবে। (মুজাম্মেল : ১৯)
তথ্য - ৪
إِنَّ اللهَ لاَ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ.
অর্র্থ: আল্লাহ অশ্লীল কার্যকলাপ করার নির্দেশ দেন না।
(আরাফ : ২৮)
ব্যাখ্যা: মহান আল্লাহ এখানে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন ইসলামের কোন নিষিদ্ধ কাজ তাঁর নির্দেশে হয় না। অর্থাৎ মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী তা সংঘটিত হয়।
তথ্য - ৫
وَمَااُمِرُوْا اِلاَّ لِيَعْبُدُوااللهَ.
অর্র্থ: আল্লাহর ইবাদাত করা ছাড়া তাদেরকে আর কিছু করতে নির্দেশ দেয়া হয়নি। (বাইয়েনা : ৫)
ব্যাখ্যা: এখান থেকেও স্পষ্টভাবে জানা ও বুঝা যায় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত (দাসত্ব) তথা ইসলাম বিরুদ্ধ কাজ আল্লাহর নির্দেশে হয় না, মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী হয়।
তথ্য - ৬
وَلَوْشَاءَ اللهُ ماَاَشْرَكُوْا.
অর্র্থ: আল্লাহ যদি চাইতেন কেউ শিরক করতো না।
(আনয়াম : ১০০)
ব্যাখ্যা: এখানেও আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি চাইলে মানুষ শিরক করতে পারতো না। অর্থাৎ শিরক (ইসলামের নিষিদ্ধ কাজ) আল্লাহর ইচ্ছা বা আদেশ অনুযায়ী হয় না। তা মানুষের ইচ্ছা ও চেষ্টা অনুযায়ী সংঘটিত হয়।
তথ্য - ৭
وَيَهْدِى اِلَيْهِ مَنْ اَنَابَ.
অর্র্থ: আর যে (ইচ্ছা করে) তাঁর (আল্লাহর) দিকে ফিরে যেতে চায় তাকে তিনি পথ দেখান। (রা’দ : ২৭)
তথ্য - ৮
اِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتَّى. فاَماَّ مَنْ اَعْطَى وَاتَّقَى. وَصَدَّقَ بِالْحُسنَى. فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسرَى. وَاَمَّامَنْم بَخِلَ وَاسْتَغْنَى. وَكَذَّبَ بِالْحُسنَى. فَسَنُيَسِّرُهُ لِلعُسْرَى.
অর্র্থ: আসলে তোমাদের (মানুষের) চেষ্টা বিভিন্ন ধরনের।
তাই যে ব্যক্তি (নিজ ইচ্ছায়) সম্পদ দান করল, (আল্লাহর নাফরমানী হতে) আত্মরা করল এবং ন্যায়কে সত্য বলে মেনে নিল, তাকে আমি সঠিক পথে (ইসলামের পথে) চলা সহজ করে দেই (তার ইসলামের পথে চলা সহজ হয়ে যায়)। আর যে (স্বেচ্ছায়) কৃপণতা করল, (আল্লাহ হতে) বিমুখ হল এবং কল্যাণ ও মঙ্গলকে মিথ্যা মনে করল, তাকে আমি বক্র (ভুল) পথে চলা সহজ করে দেই (তার অনৈসলামিক পথে চলা সহজ হয়ে যায়)। (লাইল:৪-১০)
ব্যাখ্যা: আল্লাহ এখানে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন সঠিক বা ভুল পথে চলার সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন। আর মানুষ যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজ ইচ্ছামতো কাজ আরম্ভ করে তখন মহান আল্লাহ মানুষকে তার ইচ্ছাকৃত পথে চলা সহজ করে দেন।
আল-কুরআনের এ সকল তথ্য এবং তথায় উপস্থিত থাকা এরকম আরো অনেক তথ্য থেকে পরিষ্কারভাবে জানা ও বুঝা যায় ঈমান আনা বা না আনা এবং ইসলাম সিদ্ধ বা নিষিদ্ধ কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া (ইচ্ছা করা) ও বাস্তবে সে অনুযায়ী চেষ্টা-সাধনা করার ব্যাপারে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন।
ঘ. জন্মগতভাবে বা বিনা প্রচেষ্টায় কেউ সুযোগ-সুবিধা বেশী বা কম পেয়ে থাকলে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার সময় তা হিসেবে আনা
পরকালে মানুষের কর্ম বিচার করে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার সময় আল্লাহ যে এ বিষয়টি হিসেবে আনবেন তা তিনি জানিয়ে দিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাবে-
وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلاَئِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ.
অর্থ: তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন এবং একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন; যেন যাকে যা দেয়া হয়েছে সে অনুযায়ী পরীা নিতে পারেন। (আন আম : ১৬৫)
ব্যাখ্যা: মহান আল্লাহ এখানে প্রথমে এ তথ্য জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি জন্মগতভাবে (ঐবৎরফরঃধৎরষু) বিভিন্ন দিক দিয়ে (পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) একজন মানুষকে অন্য একজন মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। এরপর তিনি জানিয়ে দিয়েছেন মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে থাকা তাঁর উদ্দেশ্যটি বাস্তবায়ন (কর্মের মাধ্যমে পরীা নিয়ে সকলকে ইনসাফের ভিত্তিতে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া) ইনসাফভিত্তিক হওয়ার জন্যে জন্মগতভাবে যাকে যে যে বিষয় তিনি বেশী বা কম দিয়েছেন সেগুলোকে অবশ্যই যথাযথভাবে বিবেচনায় রাখবেন।
আল-কুরআনের অনেক জায়গায় আল্লাহ বলেছেন তিনি একজন ন্যায় বিচারকারী সত্তা। আর তিনি যে কতবড় ন্যায় বিচারকারী তা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় উপরের আয়াতখানি হতে।
কর্মফল বা পরিণতির জন্যে মানুষই দায়ী হবে কিনা?
বিবেক-বুদ্ধি
বাস্তব জগতে আমরা দেখতে পাই উল্লিখিত তিনটি সুযোগ-সুবিধাসহকারে যে সকল পরীা নেয়া হয় সেখানে ফলাফল তথা পরিণতির জন্যে পরীার্থীই দায়ী থাকে। পরীা গ্রহণকারী কর্তৃপ নয়। আর এটি ১০০% যুক্তিসঙ্গতও।
মহান আল্লাহ যেহেতু কর্মের মাধ্যমে পরীা নেয়ার নিমিত্তে উল্লিখিত সুযোগ-সুবিধা তিনটি যথাযথভাবে মানুষকে দিয়েছেন, তাই ঐ পরীার ফলাফল বা পরিণতির জন্যে মানুষ দায়ী থাকবে- এ কথাটি ১০০% বিবেক বা যুক্তি সংগত। অর্থাৎ কৃত কাজের ফলাফল তথা পুরস্কার বা শাস্তির জন্যে মানুষ দায়ী হবে বা দায়ী থাকবেÑ এ কথাটি ১০০% বিবেক বা যুক্তিসংগত।
আল-কুরআন
তথ্য - ১
وَمَااَصَابَكُمْ مِّنْ مُّصِيْبَةٍ فَبِمَاكَسَبَتْ اَيْدِيْكُمْ.
অর্র্থ: তোমাদের ওপর যে বিপদ আসে, তা তোমাদের নিজ হাতের অর্জন (নিজ কর্মের দোষেই আসে)। (শুরা : ৩০)
তথ্য - ২
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ.
অর্র্থ: জলে ও স্থলে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে মানুষের নিজেরই কর্মের দোষে।
(রুম : ৪১)
তথ্য - ৩
وَمَا اَصَابَكَ مِنْ سَيِّئَةٍ فَمِنْ نَفْسِكَ.
অর্র্থ: যা কিছু অশুভ )অকল্যাণ( তোমার হয় তা তোমার নিজের কারণেই (কর্মদোষেই) হয়। (নিসা : ৭৯)
তথ্য - ৪
اِنَّ اللهَ لاَيَظْلِمُ النَّاسَ شَيْئاً وَّلَكِنَّ النَّاسَ اَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُوْنَ .
অর্র্থ: আল্লাহ কখনো মানুষের ওপর জুলুম করেন না বরং মানুষ নিজেই নিজের উপর জুলুম করে (নিজের কর্মদোষেই নিজের উপর জুলুম ডেকে আনে)। (ইউনুস : ৪৪)
তথ্য - ৫
اِنَّ اللهَ لاَيُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوْا مَا بِاَنْفُسِهِمْ.
অর্র্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতণ পর্যন্ত জাতির লোকেরা (কর্মের মাধ্যমে) নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন না করে।
(রাদ : ১১)
আল-কুরআনের এ সকল এবং তথায় উল্লেখ থাকা এ ধরনের আরো অনেক তথ্য এবং বিবেক-বুদ্ধির আলোকে তাহলে নিশ্চয়তা দিয়েই বলা যায়, কর্মফল বা পরিণতির জন্যে (দুনিয়ায় ও আখিরাতে) মানুষই দায়ী। আর সে দায়ী করা ১০০% যুক্তিসংগত।
সুধী পাঠক
এ পর্যন্ত আমরা আল-কুরআনের যে তথ্যসমূহ জানলাম তা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ বিবেক-বুদ্ধিগ্রাহ্য। আল-কুরআনের এ তথ্যগুলোর একটিরও উল্লিখিত অর্থ বা ব্যাখ্যা যদি পাল্টিয়ে দেয়া হয় বা অন্যরূপ করা হয় তবেÑ
ইসলামী জীবন বিধান সম্পূর্ণ উল্টে যাবে,
মহান আল্লাহর কর্মের মাধ্যমে মানুষকে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া
ইনসাফ ভিত্তিক হবে না,
মানুষসহ মহাবিশ্ব খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত
দেয়া হবে।
তাই তাকদীরের সাথে প্রত্য বা পরো ভাবে সম্পর্কযুক্ত অথবা অন্য যে কোন কুরআনের আয়াত বা হাদীসের অর্থ ও ব্যাখ্যা অবশ্যই এ পর্যন্তকার উল্লিখিত আল-কুরআনের আয়াতসমূহের অর্থ ও ব্যাখ্যার সম্পূরক হতে হবে, বিরোধী হওয়া চলবে না।
অর্থাৎ আল-কুরআনের কোন আয়াত বা কোন নির্ভুল হাদীসের অর্থ বা ব্যাখ্যা অবশ্যই এমন হওয়া চলবে না যেখান থেকে এ ধারণা হয় যে, কৃত কাজের ফলাফল বা পরিণতির ব্যাপারে Ñ
মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার কোন গুরুত্ব নেই বা
মানুষ দায়ী নয়।
অন্য কথায় আল-কুরআনে অন্য সকল আয়াত বা সকল নির্ভুল হাদীসের অর্থ ও ব্যাখ্যা এমন হতে হবে যেন কৃত কাজের ফলাফল বা পরিণতির জন্যেÑ
মানুষের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার যথাযথ গুরুত্ব থাকে এবং
সে জন্যে মানুষকে দায়ী করে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া যুক্তিসঙ্গত হয়।
‘তাকদীর সৃষ্টির পূর্বে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে এবং তা অপরিবর্তনীয়’Ñকুরআন ও হাদীসের এ ধরনের বক্তব্য এবং তার সরল অর্থ
চলুন প্রথমে কুরআন ও হাদীসের এ ধরনের বক্তব্য এবং তার সরল অর্থ সরাসরি জেনে নেয়া যাক Ñ
আল-কুরআন
তথ্য - ১
وَخَلَقَ كُلَّ شَىْءٍ فَقَدَّرَه تَقْدِيْرًا.
সরল অর্র্র্থ: এবং তিনি সকল জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং তার তাকদীর নির্দিষ্ট করেছেন। (ফোরকান : ২)
তথ্য - ২
وَالَّذِىْ قَدَّرَ فَهَدَى.
সরল অর্থ: তিনি কদর (তাকদীর) নির্দিষ্ট করেছেন। পরে পথ দেখিয়েছেন (জানিয়ে দিয়েছেন) (আল’আলা : ৩)
তথ্য - ৩
إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ.
সরল অর্থ: আমি প্রতিটি জিনিসকে কদর (তাকদীর) সহ সৃষ্টি করেছি।
(কামার:৪৯)
তথ্য - ৪
اِنَّ اللهَ بَالِغُ اَمْرِهِ , قَدْ جَعَلَ اللهُ لِكُلِّ شَىءٍ قَدْراً .
সরল অর্থ: আল্লাহ স্বীয় কাজকে সম্পন্ন না করে ান্ত হন না। আল্লাহ সকল জিনিসের কদর (তাকদীর) নির্ধারিত করে রেখেছেন। (তালাক: ৩)
তথ্য - ৫
وَلَكِنْ يُنَزِّلُ بِقَدَرٍ مَا يَشَاءُ.
সরল অর্থ: এবং তিনি (রিজিক) নিজ ইচ্ছামত তৈরী করা কদর (তাকদীর) অনুযায়ী অবতীর্ণ করেন। (শুরা:২৭)
তথ্য-৬
وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ. وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّى عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ. لاَ الشَّمْسُ يَنْبَغِي لَهَا أَنْ تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلاَ اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ.
সরল অর্থ: সূর্য স্বীয় গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে চলেছে। এটি মহাপরাক্রান্ত মহাজ্ঞানীর নির্ধারিত তাকদীর।
চাঁদের কদরের মনজিলও আমি ঠিক করে দিয়েছি; এক সময় সে আবার তার প্রথম বক্র দশায় প্রত্যাবর্তন করে; সূর্যের সাধ্য নেই যে চাঁদকে ধরে। রাতেরও সাধ্য নেই সে দিনের আগে চলে আসে। সকলেই পরিক্রম করছে একই শূন্যলোকে। (ইয়াসিন:৩৮-৪০)
আল-হাদীস
তথ্য - ১
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ كَتَبَ اللهُ مَقَادِيْرَ الْخَلاَئِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ قَالَ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ.
(رواه مسلم)
সরল অর্থ: আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির পাঁচ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ তাঁর সকল সৃষ্টির ‘তাকদীর’ লিখে রেখেছেন, হুজুর (সা.) বলেন তখন আল্লাহর আরশ ছিল পানির উপর। (মুসলিম)
তথ্য - ২
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ (ص) : اِنَّ اَوَّلَ مَا خَلَقَ اللهُ الْقَلَمَ، فَقَالَ لَهُ اُكْتُبْ ، قَالَ : مَااَكْتُبُ؟ قَالَ: اُكْتُبِ الْقَدَرَ، فَكَتَبَ مَا كَانَ وَماَ هُوَ كَائِنٌ اِلَى الْاَبَدِ. رواه الترمذى وقال هَذا حديثٌ غريبٌ اِسنادًا.
অর্থ: হজরত উবাদা বিন ছামেত (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন আল্লাহ তায়ালা প্রথমে যে বস্তু সৃষ্টি করেছেন তা হল কলম।
এরপর তিনি কলমকে বললেন, লিখ। কলম বলল, কী লিখব? আল্লাহ বললেন, ‘কদর’ (তাকদীর) লিখ। সুতরাং কলম যা ছিল এবং যা অনন্তকাল ধরে হবে তা লিখল। (তিরমিজী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন হাদীসটি গরীব)
তথ্য - ৩
وَعَنْ اِبْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ (ص) كُلُّ شَىْءٍ بِقَدَرٍ حَتَّى الْعَجْزَ وَالْكَيِّسَ . رواه مسلم.
সরল অর্থ: ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন- সকল জিনিস কদর (তাকদীর) সহকারে (সৃষ্টি) হয়েছে, এমনকি বুদ্ধি দুর্বল ও প্রখর হওয়ার বিষয়টিও। (মুসলিম)
তথ্য - ৪
وَعَنْ اَبِىْ خُزَامَةَ عَنْ اَبِيْهِ قَالَ قُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! اَرَأَيْتَ رُقَىً نَسْتَرْقِيْهَا وَدَوَاءً نَتَدَاوَى بِهِ وَتُقَاةً نَتَّقِيْهَا هَلْ تَرُدُّ مِنْ قَدَرِ اللهِ شَيْئًا؟ قَالَ: هِىَ مِنْ قَدَرِ اللهِ. رواه احمد والترمذى وابن ماجة.
সরল অর্থ: হজরত আবু খোজামা তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন।
আমি একদিন রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম : হুজুর, আমরা যে মন্ত্র পাঠ করে থাকি, ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করে থাকি বা বিভিন্ন উপায়ে আমরা যে আত্মরার চেষ্টা করে থাকি, তা কি তাকদীরের কিছু প্রতিরোধ করতে পারে? হুজুর বললেন, তোমাদের ঐ সকল চেষ্টাও আল্লাহ (নির্ধারিত) তাকদীরের অন্তর্গত।
(আহমদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)
তথ্য - ৫
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا تَسْأَلِ الْمَرْأَةُ طَلاَقَ أُخْتِهَا لِتَسْتَفْرِغَ صَحْفَتَهَا وَلْتَنْكِحْ فَإِنَّ لَهَا مَا قُدِّرَ لَهَا.رواه البخارى
সরল অর্থ: আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, নিজে বিয়ে করার জন্যে কোন নারী যেন তার বোনের (অপর নারীর) তালাক না চায়। কেননা তার জন্যে তাকদীরে যা নির্ধারিত আছে তাই সে পাবে। (বুখারী)
তাকদীর বা কদর শব্দ ধারণকারী এধরনের আরো অনেক বক্তব্য কুরআন ও হাদীসে থাকতে পারে বা আছে।
কুরআন ও হাদীসের তাকদীর বা কদর শব্দ ধারণকারী বক্তব্য- সমূহের প্রচলিত অসতর্ক অর্থ ও ব্যাখ্যা এবং তার পর্যালোচনা
প্রচলিত অর্থ বা ব্যাখ্যায় তাকদীর বা কদর শব্দের অর্থ ধরা হয়েছে ভাগ্য, ফলাফল, নিয়তি বা পরিণতি।
আর এ অর্থ ধরে বক্তব্যসমূহের যে ব্যাখ্যা মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে চালু হয়েছে তা হল, মানুষের ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।