আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংবেদনশীল মূর্ত ক্যানভাস

বাংলাদেশের যেসব শিল্পী নিরন্তর সাধনা ও সৃষ্টিশলীলতার মাধ্যমে বিশ্বপরিসরে সম্মানের আসন করে নিয়েছেন মনিরুল ইসলাম তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছেন।

চার দশক ধরে স্পেনে প্রবাসী এই শিল্পী যেন স্পেনের মাদ্রিদে থেকেও বাংলাদেশের চাঁদপুরেই বাস করেন। তার বুকের মধ্যে যেন ধরা আছে চাঁদপুরের মেঘনা নদী। শুধুই কি মেঘনা? না স্পেনও আছে, আছে আন্দালুসীয় মাল্লাদের গান। দুই ভুবনের প্রকৃতির রূপ, রস, ঘ্রাণ তার বুকের ভেতরে আলুথালু মিশে গেছে।

সৃষ্টি করেছে এক অনির্বচনীয় অনুভূতির। সেই অনুভূতিই যেন আঁকিয়ে নিয়েছে তাঁকে দিয়ে অসাধারণ সব চিত্রকর্ম। চিত্র-সমালোচক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর যেমন বলেছেন_ 'তিনি একইসঙ্গে চাঁদপুর ও মাদ্রিদের বাসিন্দা। মনির ইউরোপীয় টেকনিক প্রয়োগ করে এশীয় সংবেদনশীলতাকে তার চিত্রকর্মে সিদ্ধহস্তে ফুটিয়ে তোলেন। রঙে ও রেখার মধ্যদিয়ে তিনি তার আবেগকে প্রস্ফুটিত করেন।

'

একেবারে সাম্প্রতিক এবং সমসাময়িক বিশ্ব-চিত্রকলার সঙ্গে রয়েছে তার নিবিড় যোগাযোগ। ছাপচিত্রী হিসেবে মনির স্পেনের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান পেয়েছেন। বাংলাদেশেও তিনি সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।

বাংলার এই শিল্পী তার মেধা, মনন ও নিরলস শ্রমে শুধু ইউরোপেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি অর্জন করেছেন। নিরন্তর সাধনার মধ্যদিয়ে ছাপচিত্রে টেকনিকে দক্ষতা অর্জন করেছেন।

তিনি মাধ্যম হিসেবে ছাপচিত্রকে বেছে নিয়েছেন। তার প্রথমদিকের তাম্রতক্ষণের কাজে ছিল সহজ স্বাভাবিক এক ছন্দ। ক্রমে তিনি এক্ষেত্রে উত্তরোত্তর সিদ্ধি অর্জন করেছেন। ছাত্রজীবনে তার অসাধারণ দক্ষতা ছিল জলরঙে। ছাপচিত্র আঁকতে গিয়ে তিনি এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়েছেন।

ছাপচিত্রে তার এই দক্ষতার পাশাপাশি তিনি তেলরং ও মিশ্র মাধ্যমেও অনেক কাজ করেছেন।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী মনিরুল ইসলামের জন্ম ১৯৪৩ সালে জামালপুর জেলার ইসলামপুর গ্রামে। তিনি ঢাকা আর্ট কলেজে [বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়] থেকে ১৯৬৬ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বিএফএ ডিগ্রি লাভ করে তিন বছর আর্ট কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৯ সালে স্প্যানিশ মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের বৃত্তি নিয়ে মাদ্রিদ যান। তারপর থেকে তিনি স্পেনে বসবাস করছেন।

তবে প্রতিবছরই একবার তিন দেশে আসেন। কারণ স্বদেশ তাকে টানে। কথা বলেন চাঁদপুরের ভাষায়।

বুকে তার মেঘনার বিস্তার। আর তার চিত্রকর্মেও যেন সেই নদীর বিস্তার, তাই কখনো কখনো মূর্ত হয়ে ওঠে।

এ ছাড়া তার চিত্রকর্মে প্রধান হয়ে ওঠে রেখা ও রঙ। মনির রেখা ও রঙের এমন এক ভুবন সৃষ্টি করেছেন, যে ভুবনে নদীর বিস্তারকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। নিসর্গকে দেখেছি ভিন্ন এক মাত্রায়। নদী ও নিসর্গকে তিনি ভাঙেননি। সে জন্য প্রথম দৃষ্টিপাতে তা সহজেই শনাক্ত করা যায়।

মনিরুলের আবেগ, সংবেদন ও ব্যক্তিত্বের ধরন প্রতিফলিত হয়েছে তার বিভিন্ন এচিং ও চিত্রকর্মে। তার ছবিতে রঙ ও রেখা দুই-ই প্রধান্য পেয়েছে। রেখায় যেমন তার নিজস্বতা আছে, তেমনি রঙে আলাদা বিভাব তার ছবির প্রাসঙ্গিকতাকে মূর্ত করে তুলেছে। বর্ণ ও রেখার মধ্যদিয়ে মনিরের এক বিশিষ্ট চিত্রভাষা তৈরি হয়েছে। এ চিত্রভাষাকে আমরা খুব সহজভাবে উপলব্ধি করি।

প্রকৃতির ঐক্য ও সামঞ্জস্য অন্বেষণ করার বিরামহীন তাগিদ তাকে এক অতৃপ্ত চিত্রকরে পরিণত করেছে। তার আঁকিবুঁকির ভেতর নিজের অন্তর্মুখীন তাগিদ যেন ভিন্ন এক জগতের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের এই প্রবাসী শিল্পী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, পাখি নীড় থেকে যত দূরেই থাকুক না কেন, তার প্রাণ পড়ে থাকে শেকড়ে; শেকড় থাকে বলেই শিল্পিত সুষমা বৃহৎ জীবনের ছন্দকে উন্মোচিত করে। মনিরের মধ্যে যেন এক কবি বাস করে। তার এচিংয়ে যেন মূর্ত হয়ে ওঠে কবিতার ব্যঞ্জনা।

তিনি যেন কবিতা লেখার আবেগে ছবি আঁকেন। রং আর রেখায় তিনি আঁকেন তার নিজস্ব জগৎকে যা আবার প্রকৃতিরই প্রতিচ্ছবি। অবচেতনার অনিঃশেষ জগৎকে শিল্পী ধরতে চান তার রেখা, রং আর বিন্দু দিয়ে। দৃশ্যগত কোনো কিছুর সঙ্গে এর মিল নেই। তবু যেন আছে।

এই মিলটি খুঁজে নিতে হয় মানুষের মনের চির রহস্যময় অনুভব ও বোধের ভেতরে। আকাশের মতো বিস্তৃত বিশাল সেই বোধ।

শিল্পীর চিত্রকর্মগুলো দেখতে দেখতে মনে হয়, আশা, আনন্দ, দুঃখ, নৈরাশ্য অথবা গোলাপের গন্ধের মতো বিমূর্ত অনুভূতিগুলোই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে তার এচিংয়ে। কখনো ধূসর, কখনো উজ্জ্বল রং ব্যবহার করেছেন তিনি, তার এসব এচিংয়ে। তবে ধূসরের প্রতিই যেন তার বেশি পক্ষপাতিত্ব।

পুঙ্খানুপুঙ্খতা, ছোট ছোট কাব্যিক ও মাধুর্যময় শৈলী তার ছবিকে অনন্য বৈশিষ্ট্যময় করে তুলেছে। মনের অতল গহন থেকে তুলে আনা আনন্দ-বেদনাকে তিনি তার চিত্রকর্মে মূর্ত করে তুলেছেন। এ যেন গোলাপের গন্ধের মতো সেই অধরাকে ধরার সাহসী প্রয়াস। সেই সাহস কোথায় পান তিনি? হৃদয়ের গভীর গহন থেকে উৎসারিত এক আবেগ থেকে উৎপন্ন হয় এ সাহস। এভাবেই লাইনের পর লাইন সাজিয়ে তিনি বিমূর্তকে মূর্ত করে তোলেন।

ক্যানভাসে আঁকেন অথবা লেখেন কবিতা। একইসঙ্গে শিল্পী এবং কবি। তার চিত্রকর্মে যেন ধরা পড়ে সময় এবং অনন্ত কাল। গৃহী হয়েও তিনি এক সন্ত যেন। মনিরুলের চিত্রকর্মে রং ও রেখার আশ্চর্য সমন্বয় এমন এক আবেগ তৈরি করে, যেন তা দর্শককে টানতে থাকে।

এখানেই শিল্পীর শক্তি। দর্শক আরও অভিনিবেশ নিয়ে ছবিটি দেখেন। দেখেন ও ভাবেন। শিল্পী মনিরুল ইসলাম তার কাজে রং ও রেখাকে বহুমাত্রিক ছন্দে প্রস্ফুটিত করেন। সেখানে জীবনের উদ্ভাস, প্রকৃতির ঐক্য, সমুদ্রের রহস্যময় দিগন্ত, পর্বতের এবং মরুভূমির নিঃসঙ্গতা নিজস্ব এক জগৎ সৃষ্টি করে।

যে জগতে মনিরুল এক আধুনিক চিত্রকর এবং সর্বতো অর্থেই আমাদের সময়ের অনন্য চিত্রকর।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।