সাদ আহাম্মেদ
সকাল থেকে জাহানারার শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা। বাম চোখ লাফাচ্ছে প্রবল বেগে। এরমধ্যে হয়েছে সর্দি। কাজের মহিলাগুলোও হয়েছে চরম বজ্জাত। দুইদিন আগে নতুন বুয়া রাখা হইছে।
গ্রাম থেকে তার ছোট ভাই প্রায়ই বুয়া সংগ্রহ করে এবং প্রতিবারই বলে "বুবু এইটা ফাস কেলাস। এ দুইহাতেই কাম করে,অজুহাতের ইউজ জানেনা। "প্রতিবারই জাহানারা খুশিতে গদ্গদ হয়ে তার ভাইকে রসগোল্লা খাইয়ে বিদায় করে এবং পরবর্তীতে তাকেই রসগোল্লা খেতে হয়।
ভোরবেলা জাহানারা যখন ঘুম থেকে উঠেন তখন রান্নাঘরে যেয়ে দেখেন নতুন বুয়া চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। সাতসকালে এমনিতেই মেজাজ থাকে বিক্ষিপ্ত এরমধ্যে এমন কাজকর্ম রেখে বুয়ার শুয়ে থাকা দেখে জাহানারা স্বভাবতই রেগে গেলেন।
"কি ব্যাপার?রুটি সেকবানা?ঘরে কাজকর্ম নাই নাকি?এভাবে শুয়ে আছো কেন?"
প্রশ্ন শুনে বুয়া বিশাল জোরে হাই তুলে বললো "আম্মা গাটা ম্যাজম্যাজ করে। উঠতে যায়া একবার পইড়্যা গেছি। দুব্বল সলীল নিয়া কাম কইরাম কেম্নে?"
জাহানারা কিছুক্ষণ গরম দৃষ্টিতে বুয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে গটমট করে ভিতরে চলে গেল। আজকে দিনটাই কেমন যেন ভালো লাগছেনা। জুম্মাবারে সবাই বাসায় আছে।
ছুটির দিন বলে সবাই ঘুম কর্মে ব্যস্ত। শীতের দিনে সাধারণত বৃষ্টি হয়না,কিন্তু আজ নিয়ম ভঙ্গ করে সকাল থেকে হাল্কা পাতলা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু করেছে। জাহানারার কিছুই কেন যেন ভাল লাগছেনা। তবে রহমান সাহেব আজ বেশ আনন্দে আছেন। ছুটির দিন তার কাছে বেশ আনন্দের হ্য় সবসময়।
এদিন তিনি সকাল থেকে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পড়ে ঘরে বসে থাকেন আর স্ত্রী জাহানারা থেকে শুরু করে ছেলে বিলু আর মেয়ে নিলু যাকে কাছে পান তাকেই ডেকে নিয়ে গল্প করার চেষ্টা করেন। তবে জাহানারার সাথে গল্প করে মজা নাই। গল্প শেষে জাহানারা এমন একটা প্রশ্ন করে তখন মুডটাই খারাপ হয়ে যায়। আজ সকালেই গল্প করছিলেন ইবনে বতুতা নিয়ে "বতুতা লিখেছিল এদেশে আছে গোলা ভরা ধান,পুকুর ভরা মাছ আর সব কিছুই অনেক সস্তা ছিল। ওই দিন আর এই দিন,হায়রে..."।
গল্প করার পুরোটা সময় তার মনে হয়েছিল জাহানারা তার কথা খুব মন দিয়ে শুনছে। কিন্তু গল্পের মাঝে তাকে থামিয়ে দিয়ে জাহানারা অতিআবশ্যক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফেললো "ঘরে তো পাতিল ভরা চাল আর ফ্রিজ ভরা মাছ নাই,একটু বাজারে গেলে ভাল হয়না!!"কি আর করা,মেজাজ গরম করে বাজারের ব্যাগ আর বিশাল ফর্দ নিয়ে মুসলিম বাজার গমন। নাহ আজকে তারও দিনটা ভালো যাচ্ছেনা।
দুপুরের কিছু পর দরজায় ঠ্কঠক আওয়াজ শুনে জাহানারা নিজেই গেলেন দরজা খুলতে। দরজা খুলে দেখেন একটা ৩৪-৩৫ বছর বয়সী লোক দাঁড়িয়ে আছে।
কেমন যেন ইতস্তত ভাব।
"কাকে চাচ্ছেন?",একটু কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন জাহানারা। যদিও তার কোন দরকার ছিলোনা। লোকটাকে কেন যেন মনে হচ্ছে চেনা চেনা। কিন্তু এই সময় কারো উপস্থিতি আসলে ভাল লাগেছেনা।
গতকাল বিলুর এইচ.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। পরীক্ষার পর বিলু বলেছিল সবাইকে তাক লাগিয়ে দিবে। সত্যি সবাইকে তাক লাগিয়ে F গ্রেড নিয়ে ফেল করেছে। এই অবস্থায় বিলুর বাবা ছাড়া কারোই মেজাজ সুবিধার নেই।
অনেকক্ষণ পর লোকটি উত্তর দিলো “"জাহানারা বেগম এর বাসা এটা?”"
জাহানারা একটু অবাক হলেন।
তার কাছে কেউ আসেনা সাধারণত। অবাক ভাবটা লুকিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন “"আমি জাহানারা বেগম। আমার কাছে কেন?”"
লোকটা কেমন যেন ভয়ে ভয়ে বললো“"একটু ভেতরে আসি?আমার আপনার সাথে একটু দরকার ছিলো”। "
জাহানারা একবার ভাবলেন না করে দেন। তারপর মনে হলো দেখেতো উলটাপালটা মনে হচ্ছেনা।
কি মনে করে যেন বললেন “"আচ্ছা আসেন ভিতরে”"।
অন্য ঘর থেকে তখন রহমান সাহেব ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন ঘটনাটা। লোকটাকে দেখেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। কে হতে পারে??
লোকটা হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে একটু আশেপাশে তাকিয়ে বলে “"এক গ্লাস পানি পাওয়া যাবে?"”
জাহানারা মাথা নাড়িয়ে ভিতরে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলেন লোকটা তার দিকে কেমন ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।
তিনি কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভুতি বোধ করলেন। তার বাররার মনে হচ্ছিল কেন যেন চেনা চেনা লাগে। কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু মনে করতে পারলেননা। ডাইনিং রুমে পানি আনতে গালে তার মেয়ে নিলু প্রশ্ন প্রশ্ন ভাব করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে “"কে মা”?"
জাহানারা কিছু না বলে শুধু একবার মাথা নাড়লেন।
রহমান সাহেব অবশ্য কিছু বললেন না। সে এখনো সকালের ব্যাপারটা ভুলতে পারছেননা।
পানি নিয়ে জাহানারা ঘরে যেয়ে দেখেন লোকটা নেই আর টেবিলে একটা চিঠি রাখা। এবার জাহানারা খুব অবাক হলেন। দরজার বাহিরে যেয়ে তাকালেন,এদিক সেদিক উকি দিলেন।
নাহ! কেউ নেই। লোকটা এভাবে গায়েব হয়ে গেলো কেন?
ঘরের ভিতর ঢুকে তিনি চিঠিটা হাতে নিলেন। কোন সম্বোধন ছাড়া চিঠি। চিঠিটা খুলে তিনি পড়া শুরু করলেনঃ
“"আমার এমন আচরণের জন্য দুঃখিত। তবে আর কোন উপায় ছিলনা।
আপনার সামনে দাঁড়ানোর মত সাহস আমার ছিলোনা। আমি অনেকদিন পর গত মাসে বিশেষ কারণে দেশে এসেছি। এর আগে আমি কানাডার মনট্রিল এ ছিলাম। আসলে আপনার জন্যই দেশে আসা। গত একমাস আপনাকে অনেক খুঁজেছি।
ভাগ্য ভাল,তাই শেষপর্যন্ত আপনাকে পেয়েও গেলাম।
আমি বড় হয়েছিলাম কানাডার এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে। বড় হলে উনারা আমার কাছে আমার জন্ম ইতিহাস কিছুই লুকাননি। একসময় তারা আমাকে দেশে নিয়ে আসেন,আমাকে এই দেশের সুন্দর সুন্দর সবগুলো জায়গা ঘুরে দেখান। আমি দেখি আর ভাবি আমার মা তো এ দেশের,তাহলে কেন এই দেশটা আমাকে গ্রহন করলোনা?
আপনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমি কে।
শুনেছি ৭১-এ আমার জন্মের পর আপনি আমাকে একবার চোখের দেখাও দেখতে চান নাই। আমি বুঝতে পারি কেন আপনি আমাকে ঘৃণা করেছেন। তবে এজন্য আমার কোন দুঃখ নাই। ঈশ্বর আমার ভাগ্যে এমন রাখলে কি বা করার আছে বলেন!
জানেন প্রতিবছর আমি দেশে আসতাম আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম। যখনি কোন টোকাই গোছের ছেলেমেয়ে দেখতে পেতাম আমার মনে হতো এমন হলেও কীইবা ক্ষতি ছিল।
সারাদিন না খেয়ে গোসল করে টইটই করে ঘুরে বেড়িয়ে রাতের বেলা অন্তত সে তার মায়ের কাছে যায়। বলতে পারে "আম্মা ভাত দেও"।
তবে আমি কখনো আপনাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করিনি,তবে এবার দরকার হলো....
আপনি ভাববেন না যে আমার আপনার প্রতি কোন অভিযোগ আছে। সেই অধিকার তো আমার নেই।
গতবছর হঠাৎ করে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি।
পরে জানতে পারি রোগটা লিউকেমিয়া। নাহ আমার কোন কষ্ট হয়নাই। তাইতো দেশে আসা আর আপনাকে দেখতে চাওয়া।
দেখেন আমারও অন্য মানুষের মত দুইটা চোখ,দুইটা কান আর বাকি সব আছে। একটা মনও আছে।
জানি আমি যুদ্ধ শিশু,কিন্তু আমারও মানুষের মত হতে ইচ্ছা করতো। একবার মায়ের আদর বুঝতে ইচ্ছা করতো। যখন জানলাম আয়ু নেই,তখন মনটা আর মানলোনা।
আমি ওই ছোট্ট কাল থেকে আপনাকে কল্পনা করছি। মনে মনে আপনার উপর কত অভিমান করছি।
প্রায়ই স্বপ্নে বলে উঠতাম "আম্মু তুমি কখনো আমাকে ছোঁবেনা,কোনদিন না। । আমাকে না ফেলে দিয়েছিলে"। আমি তখন কল্পনা করতাম আপনি ছলছল চোখে দাড়িয়ে আছেন আর ভাবছেন কেন ছেলেটিকে দূরে রেখেছিলেন। পরে বড় হয়ে বুঝতে পারি আমি শুধুই একটা অপরাধ।
এই চিঠি লিখার সময় আমি জানিনা আপনি কেমন হবেন দেখতে। কিন্তু আমি জানি,আপনি হবেন এক মমতাময়ী মা। পৃ্থিবীর সবচেয়ে সুন্দর মা।
আপনাকে আমি কখনো দেখিনাই। তবুও আপনার কত ছবি আমি এঁকেছি।
কিন্তু যখনি সেই ছবি কল্পনা করছি প্রতিবার মনে হয়েছে আমার দিকে আপনি এমন ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছেন কেন?
যাই হোক,আপনাকে দেখা দেওয়ার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার প্রতি ক্ষোভ রাখবেন না। আসলে কি জানেন ছোট থেকে সকল অসুখে যন্ত্রণায় আমি একা একা নিজেকে দেখছি। কিন্তু আজকে যখন জীবনকে বিদায় জানাতে হচ্ছে তখন মনে হচ্ছে আর পারছিনা একা থাকতে। এবার একটু দেখে আসি আমার মা আসলে কেমন।
যদি অধিকার থাকতো তবে একটিবার শুধু একটি কথা বলতে চাইতাম
"মা আমি যুদ্ধশিশু হলেও তোমার শিশু। আমাকে ঘৃণা করোনা। একবার ছেলে ভাবতে পারো মা?ছেলে ভেবে মাথায় হাত রাখতে পারো মা?"
সত্যি কথা কি জানেন,আমার মত মা হারা যুদ্ধ শিশুর সবচেয়ে বড় বেঁচে থাকার আশা হলো নিজের মাকে একবার দেখতে পাওয়া। এইটুকুই আমাকে এতোদিন বাঁচতে শিখিয়েছে। আজ তাই আমার বড় আনন্দের দিন।
জানি আমি আর বাঁচবোনা। কিন্তু আজকে আপনার সাথে দেখা হওয়ার অল্প কিছু মুহূর্ত আমাকে যা দিয়েছে তাই আমার জন্য সবকিছু। আর কিছু আশা করিনা। ভাল থাকবেন। "
জাহানারা চিঠিটা পড়ে নীরবে তার ঘরে চলে গেলেন।
অনেকক্ষণ দরজা লাগিয়ে বসে বসে ভাবলেন সবকিছু,তার জীবনের সবকয়টি ঘটনা। গলায় কি যেন একটা আটকে গেছে। অনেকদিন পর তিনি কাঁদলেন,অনেকদিন পর।
গভীর রাত্রে তিনি মোনাজাত ধরে বললেন "আল্লাহ আমার ছেলেটিকে তুমি ভাল করে দাও। "
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।