আমাদের মৌলিক খাদ্যসম্পদ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে দেশের হাওরগুলো। দেশের বহু অঞ্চলে হাওর-বিল-জলাশয় প্রভূতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও প্রকৃত হাওর অঞ্চল বলতে যা বোঝায় তা আমাদের দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলায় বিস্তৃত। এ সাতটি জেলার প্রায় ৫০টি উপজেলায় প্রধান হাওরগুলো রয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় নিচু সমতল ভূমি, বিল, জলাশয়, খাল প্রভৃতি জলাধারসহ বিসর্ত্দীর্ণ এক বৈচিত্র্যময় অঞ্চল হাওর। বর্ষকিালে চারদিকে অথৈ জলরাশি, সমুদ্রে েমতো বিশাল দিগনত্দ প্রসারিত হাওরের ঢেউ আজৎচড়ে পড়ে সুদুর চার পাশের গ্রাম এবং জনবসতিগুলোতে।
আবার শুষ্ক মৌসুমে বিস্কির্ণ মাঠ পানির অভাবে শত সমস্যায় দিন গুনতে হয় হাওরবাসীর। হাওর অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, এলাকার সমস্যা চিহ্নিত করণ ও সমাধানের উপায়সহ হাওর এলাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরা প্রয়োজন। হাওর অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা এবং মানুষের জীবযাত্রার মান উন্নয়নে সুদূর প্রসারী নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যনত্দ জরুরী।
বছরের অর্ধেক সময় হাওর ডুবে থাকে স্বচ্ছ মিঠাপানিতে। এখানে রয়েছে মৎস সম্পদ, বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ, লতা-পাতা, সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জনপদ।
প্রতিবার পানি নিয়ে আসে পলি, উবর্্বর করে জমি। গ্রীষ্মমন্ডলীয় উষ্ণতা ও প্রাকৃতিক খাদ্য ভান্ডার প্রতি শীতে আমন্ত্রণ করে আনে ঝাঁকে ঝাঁকে ভিনদেশী শীতার্ত পাখিকে। দেশের সমৃদ্ধ এই অঞ্চলের প্রাকৃতি ও মানুষের জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন।
বাংলাদেশের সাতটি জেলার ৪০ টি থানায় মোট ৪৭ টি ছোট বড় হাওর রয়েছে। হাওর এলাকায় আছে অসংখ্য খাল নদী এবং প্রায় ৬৩০০ টি বিল, যার মধ্যে ৩৫০০ টি স্থায়ী।
প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুযোর্গের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় হাওরের অধিবাসীদের। কৃষি ও মৎস আহরনই এই হাওর অঞ্চলের মানুষের মূল পেশা। তবে তাদের অধিকাংশই শুধু শ্রম বিক্রেতা। হাওর অঞ্চল সবদিক থেকে পশ্চাৎপদ যেমন: শিক্ষা, স্বাস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি। শিক্ষার হার কম।
এছাড়া প্রাথমিক সত্দরে ঝরে পড়ার হার, মাতৃ ও শিশু মৃতু্যর হার সর্বোচ্চ এখানে। রাসত্দাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা অবর্ণনীয়। চিকিৎসাসেবা দুষপ্রাপ্য। বর্ষার প্লাবনের সময়ে কোন কর্মসংস্থান থাকে না, আশ্বিন-কার্তিকে নিদান-অভাব-মঙ্গা নিত্য সহচর। এ রকম সময়ে এ হাওরের মানুষদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ ও খাদ্য সাহায্য প্রয়োজন।
এই হাওরকে রক্ষা করতে হবে আর সে জন্য জাগাতে হবে হাওরের মানুষকে। হাওর এলাকার মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং যোগােেযাগ ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে হবে।
পৃথিবীতে মোট যতো পানি আছে, তার ৯৭.৫ ভাগ লবণাক্ত অর্থাৎ ব্যবহারের অনুপযোগী। বাকি ২.৫ ভাগের ১ ভাগ মানুষের ব্যবহারের উপযোগী। ১.৫ ভাগ বরফ হিমবাহে আবৃত।
তাই ১ ভাগ মিষ্টি পানি আমাদের মানব জাতির জন্য কতো গুরুত্বপূর্ণ তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এ অফুরনত্দ মিষ্টি পানি আমরা কাজে লাগাতে পারি না, বরং বন্যায় প্রতিবছর ক্ষতিগ্রসত্দ হই। এ পানি আমাদের দেশের ওপর দিয়ে গিয়ে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এ পানি ধরে রাখা, সারা বছর ব্যবহার করার কোন পরিকল্পনা তো আমাদের নেই। অনত্দত বিল, খাল, নদী, জলাশয়গুলো কিছুটা হলেও খনন করে এ পানি ধরে রাখতে পারলে আমরা শুষ্ক মৌসুমে ফসল ফলাতে পারি, মাছ চাষ ও প্রাকৃতিক মাছ রক্ষায় তা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
হাওরের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত গুরুত্ব অপরিসীম। জাতীয় অথনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হাওর। প্রতি বছর গোটা জাতির জন্য যোগান দিচ্ছে বিপুল পরিমাণ বোরো ধান, স্বাদু পানির মাছ, রবিশস্য; অন্যদিকে জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বাউল, কিস্সা, গীত, পালা, কীর্তন সহ লোকায়ত শিল্পের এক জীবন্ত জাদুঘর হাওর জনপদ। বিপন্ন হাওরের বৃক্ষ, লতা-গুল্ম, মাছ, জল, পশু, পাখি, সরীসৃপ, কীট-পতঙ্গ, সর্বোপরি মানুষ-তার জীবন ও সংস্কৃতি জাতীর কাছে তুলে ধরতে হবে।
হাওর উন্নয়ন এবং এর প্রাকৃতিক পরিবেশ সহায়ক একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও কার্যকর করার কোন উদ্যোগ প্রকৃতপক্ষে আজো নেয়া হয়নি।
হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও বাসত্দবসম্মত পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা বাসত্দবায়ন প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ এবং একটি প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যমে অর্থ ব্যয়সহ সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি বহু পুরানো। ১৯৭৭ সালে হাওর উন্নয়ন বোর্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হলেও, এ বোর্ডকে কার্যকর করার লক্ষ্যে কোন ধরনের বাসত্দব সম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। অথচ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হলে এ বোর্ডের মাধ্যমে হাওর উন্নয়নের লক্ষ্যে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
যথাযথ নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে হাওর এলাকার উন্নয়ন করা হলে তা যেমন এই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করবে তেমনি জাতীয় উন্নয়নেও তা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। হাওর এলাকার প্রকৃতিক বৈশিষ্ট একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
দেশের সার্বিক উন্নয়নে এর পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেই সাথে হাওর এলাকার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও দেশবাসীর কাছ তুলে ধরতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।