মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল!
হংকংয়ের বিশাল আর্ন্তজাতিক এয়ারপোর্টের অভ্যান্তরে হাটছিতো হাটছিই,যদিও একটু পরপর চলন্ত পথ আছে তবুও ক্লান্ত হয়ে পড়লাম,কিন্তু পথ যেন ফুরায় না।
হ্যান্ড ব্যাগটা যতেষ্ট ভারী থাকায় কস্ট বেশী হচ্ছিল।
অবশেষে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দেখা পেলাম,কিন্তু কনভেয়ার বেল্ট কোথায়? আশেপাশের সাইনবোর্ড খুটে দেখলাম সেখানে কোন ইঙ্গিত নেই-চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে ইতি উতি খুজলাম না দেখা মিলছে না।
সামনে তাকিয়ে দেখি দুজন পুলিশ অফিসার নিজেদের মধ্যে যেন কি নিয়ে আলাপ করছে। আমি খুশী মনে তাদের সাহায্য পাবার আশায় এগিয়ে গেলাম।
‘এক্সিউজ মি । ’ বলতেই তারা গল্প বন্ধ করে আমার দিকে ফিরে তাকাল ।
‘দয়া করে কি বলবেন কনভেয়ার বেল্টটা কোন দিকে?’
তারা কিছু না বলে সরু চোখে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভাল করে পরখ করল। তারপর তন্মধ্যে একজন আমাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কোত্থেকে এসেছেন?’
‘বাংলাদেশ থেকে। ’
‘হংকংয়ে এই প্রথম?’
‘ হ্যা’।
‘কেন এসেছেন?’
তাদের এমনতর প্রশ্নে আমি উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছি!
কাউন্টার ছেড়ে কি এখানে তারা ইন্টারভিউ নিচ্ছে? আর আমার প্রশ্নের উত্তরে তাদের একটু ইশারাই যথেস্ট -এ্যাতো প্যাচাচ্ছে কেন?
‘এখানকার লেদার ফেয়ারে আমি একজন পার্টিসিপেন্ট। ’
‘ও..। দেখি তোমার পার্টপোর্ট?’
আমি একবারে পাসপোর্ট, টিকেট ,ইনভাইটেশন লেটার, ভিসার কপি সব তাদের হাতে তুলে দিলাম।
সেগুলো উল্টেপাল্টে দেখে দুজনে নিজেদের মধ্যে আমার অবোধ্য ভাষায় কি নিয়ে যেন আলোচনা করল। যার হাতে পাসপোর্টছিল সে আমার দিকে ফিরে বলল,‘তুমি আমার সাথে আস।
’
‘কি গ্যাড়াকলে পড়লামরে বাবা! কোন কুক্ষনেই যে ওদের সাহায্য চাইতে গিয়েছিলাম?
কি আর করার অগত্যা তার পিছু নিতেই হল। সে আমাকে যেখানে নিয়ে গেল-সেখানটাকে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম কোন ক্লাসরুম হবে হয়ত।
কিন্তু পরক্ষনেই ভুল ভাঙ্গল!
টেবিল পেতে তার ওপাশে একজন পুলিশ অফিসার বসে আছেন তার ঠিক সামনে সারি সারি চেয়ারে প্রচুর লোক বসে আছে তাদের বেশীর ভাগই ভারতীয় নয় পাকিস্থানী। সবার চেহারাই গম্ভীর-বিষন্ন।
চেয়ারে বসা পুলিশ অফিসারটির কাছে আমাকে ও আমার কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে সে বিদায় নিল।
তিনি আমাকে গম্ভীর কন্ঠে আমাকে বসতে বললেন। আমি গিয়ে পিছনের সারিতে বসলাম। কিছুক্ষন পরে আরেকজন অফিসার এসে আমাকে ইঙ্গিতে তার সাথে আসতে বলল।
তিনি আমাকে সাথে করে নিয়ে একটা কাউন্টারের সামনে দাড় করিয়ে বিদায় নিলেন। কাউন্টারের ভিতরে বসা ভদ্রলোক আমার আবার জেরা শুরু করলেন -কেন এসেছি? কোথায় থাকব ? ক’দিন থাকব?কত টাকা এনেছি? ক্রেডিট কার্ড আছে কিনা? এসব ।
সব প্রশ্নের সদুত্তর দেযার পর তিনি পাসপোর্টটা নিজের কাছে রেখে আবার আমাকে ভিতরে গিয়ে বসতে বললেন।
এবার মেজাজ বিগড়ে গেল। কন্ঠে উস্মা এন বললাম‘ কি পেয়েছ অ্যা? একবার এখান থেকে ওখানে,ওখান থেকে এখানে চরকির মত ঘোরাচ্ছ ? আমি কি তোমাদের দেশে থাকতে এসেছি? বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে আমি তোমাদের একজন সন্মানিত অতিথি। আর অতিথির সাথে তোমাদের এ ব্যাবহার?’
সে একটুখানি হেসে দুঃখ প্রকাশ করে বলল তার কিছুই করার নেই। আমি যেন দয়া করে ভিতরে গিযে বসি।
’
মেজাজ খারাপ করে আবার ওখানে গিয়ে বসলাম। মিনিট পাচেক পরে দ্বীতিয় অফিসারটি ভিতরের রুম থেকে বের হয়ে আমাকে হাত ইশারায় ডাকল-কাছে যেতেই বলল ‘তুমি কি ভারতীয় বা পাকিস্থানী ভাষায় কথা বলতে পার?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম ‘পারি। ’
ধন্যবাদ আমার সাথে একটু আস বলেই সে ওই রুমের দরজা খুলে ভিতরে যেতে বলল।
ভিতরে ঢুকে দেখি ছোট্ট রুমটাতে আরো দুজন বসে আছে। তন্মধ্যে একজন অফিসার তবে এদের মত পাতি নয় একটু উচুদরের বলে মনে হল।
আর তার সামনে শীর্ন চেহারার জীর্ন পোষাক পরা এক মহিলা বসে আছে । অফিসার ভদ্রলোক আমাকে বসতে বললেন।
আমি বসতেই তিনি সামনে উপবিস্ট মহিলাকে দেখিয়ে বললেন,
ইনি পাকিস্থান থেকে এসেছেন। সমস্যা হল এই মহিলা নিজের ভাষা ছাড়া আর কোন ভাষায়ই কথা বলতে পারেন না। আপনি দয়া করে তার কথাগুলো একটু ইন্টারপ্রেট করে দিবেন?
উত্তরে বললাম ‘যথা আজ্ঞা”
‘উনাকে জিজ্ঞেস করুন উনি কেন এদেশে এসেছেন?’
আমি আমার সাধ্যমত ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দুতে তাকে প্রশ্নটা করলাম।
‘প্রতিউত্তরে মহিলা নিচু স্বরে কিযে বলল কিছুই মালুম হলনা!
প্রমাদ গুনলাম একোন ভাষারে বাবা! প্রশ্নটা আবার করতেই সে এবার একটু উচু গ্রামে স্পস্ট করে বলল। উর্দুই তবে গ্রাম্যটানে। এই সুরে উর্দু কখনো শুনিনি বলে প্রথমে বুঝতে পারিনি। তার কথার পুরো ব্যাখ্যা করলে দাড়ায়- ‘মাস কয়েক আগে আমার এক আত্মীয় এখানে এসেছে চিকিৎসার জন্য। এতদিন ভদ্রলোকের গিন্নীই দেখাশুনা করেছেন, কিন্তু এখন তিনিও অসুস্থ হয়ে পরেছেন তাই উনি ওদের সাহায্যার্থে এখানে এসেছেন।
’
আমার বিশ্বাস হল না। তার আত্মীয় তাও আবার আপন বোন জামাই চিকিৎসা করতে এসছে হংকংয়ে? অসম্ভব! তার পোষাক চেহারা বলে দেয় অর্থনৈতিক ভাবে তারা কতটা সচ্ছল!
অফিসার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাসপাতের নাম কি কোথায়? সে কোন ঠিকানায় উঠবে?’
তাকে জিজ্ঞেস করতেই তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল! প্রতিউত্তরে মাথা নিচু করে বলল ‘জানিনা । ’
বুঝে ফেললাম এ কিজন্য এখানে এসেছে ! তবুও তার জন্য মায়া হল । বললাম ‘এরকম উত্তর দিলেতো অপনি আটকে যাবেন। ’ ভদ্র মহিলা এবার আমার দিকে টলমল চোখে চেয়ে বাস্পায়িত কন্ঠে বললেন ‘ভাই আমাকে বাচান।
দেশে পিরে গেলে আমার বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। ’
‘তার মানে আপনি যা বলেছেন তার সবই বানানো?’
এবার তিনি মাথাটা নিচু করে বুকের কাছে থুতনি ঠেকিয়ে বলললেন ‘হ্যা। ’
কি করব ?
(জীবনের প্রথম এধরনের বড়সড় অপরাধ করলাম,হউক সে পাকিস্থানী তবুও মুসলিম এক মহিলাকে সাহায্য করলাম পরবাসে পতিতাবৃত্তি করার জন্য!)
অফিসারটিকে মিথ্যে বললাম‘ উনি নাম জানতেন এমুহুর্তে ভুলে গেছেন। ওনার আত্মীয় এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষা করছেন। অতএব ঠিকানার আনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেননি।
’
ভদ্রলোক তার দিকে সন্দিগ্ম চোখে চেয়ে বললেন‘ উনি কাদছেন কেন ’
সেরেছে! ফের প্রমাদ গুনলাম!
‘উনি ভাবছেন উনার দুলাভায়ের আর সেবা করার সুযোগ পাবেন না। সেই দুঃখে। ’
‘ধন্যবাদ । ’ ভদ্রলোক আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমিও হাত বাড়াতেই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি কোত্থেকে এসছেন?
‘বাংলাদেশ থেকে।
’
‘আপনাদের ভাষা কি পাকিস্থানী। ’
‘জ্বীনা আমাদের নিজস্ব ভাষা আছে। বাংলা। ’
উনার কন্ঠে এবার বিস্ময়ের সুর ’ তাহলে ওই মহিলার কথা বুঝলেন কি করে?’
এবার একটু ভাব নিলাম। ‘আমি শুধু পাকিস্থানি না আরো অনেকগুলো ভাষায় কথা বলতে পারি।
’
বুঝে গেছি এর দৌড় আধ ভাঙ্গা ইংরেজী পর্যন্ত। আমাকে যাচাই করার সুযোগ এর
নেই।
‘তাই ! এখানে এসেছেন কেন?’
‘লেদার ফেয়ারে । আমি একজন পার্টিসিপেন্ট। ’
উনি এবার কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলেন ,‘ আপনাকে এখানে কিজন্য এনেছে?’
‘আমি জানিনা।
ওখানে একজনকে প্রশ্ন করলাম ‘কনভেয়ার বেল্টটা কই উনি আমাকে এখানে ধরে আনলেন। ’
এবার তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে দাড়ানো নিন্মপদস্থ কর্মকর্তকে ধমকে উঠে কি যেন বললেন।
প্রতিউত্তরে সে কি বলেছিল আমি জানিনা বা বুঝিনি তবে তার অপরাধী অপরাধী চেহারা দেখে ভাল লেগেছিল।
ভদ্রলোক এবার তাকে আরো কিছু একটা বলতেই সে দ্রুত গিয়ে আমার পাসপোর্ট নিয়ে এল। তিনি পাসপোর্টখানা হাতে নিয়ে একটু উল্টে পাল্টে ।
আবার ওর হাতে ফেরত দিয়ে ‘কিছু ডিকটেশন দিয়ে-আমার কাছে দুঃখ প্রকার করে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন।
হাফ ছেড়ে বাচলাম!
লাভের মধ্যে হল এই এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়াতক আমার সাহায্যকারী হিসেবে একজনকে পেলাম! আর কোন সমস্যা হয়নি।
ফেরার পথে আবার সেই বিমান ভ্রমন। তবে এবার যাত্রী সংখ্যাছিল যথেস্ট কম। হেসে খেলে হাতপা ছড়িয়ে বসলাম।
আকাশে একজনের সাথে পরিচয় হল। লাগেজ পার্টি তবে উচু দরের। দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। যথেস্ট শিক্ষিতও। গল্পচ্ছলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘বাংলাদেশের সব এয়ার হোস্টেজই এমনতর?’
সে আমার দিকে তাকিয় হেসে বলল ‘ না ভাই।
শুধু এই রুটেই। ’
‘কেন কেন ? শুধু এই রুটে কেন ?’
‘এই রুটে যারা নিয়মিত যাতায়াত করে তাদের বেশীর ভাগই চোরাচালানী সহ বিভিন্ন বৈধ অবৈধ পথে অল্পদিনেই টাকার কুমির হয়েছেন। এরা একসময় নিজেদেরকে অসম্ভব ক্ষতাবান ভাবতে শুরু করে। অবৈধ পয়সায় এমন কোন অপকর্ম নেই যা এরা করে না। এমনকি সুন্দরী এয়ার হোস্টেজরাও এদের হাত থেকে রেহাই পেতনা।
বিমানে উঠে জোর করে এদের হাতে ভিজিটিং কার্ড ডলার গুজে দিয়ে বলত অমুক দিনে অমুক হোটেলে দেখা করতে সেই সাথে হুমকি ধামকি দিত না গেলে খবর আছে । শুধু অর্থ নয় রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি এদের যথেস্ট সেই সাথে সহযোগীতার জন্য একগাদা ক্যাডারও পালে। কে প্রতিবাদ করবে? সে জন্য সুন্দরী তন্বীরা এরুটে আসতে চায়না। ভয় পেয়ে দুএকজন চাকরীও ছেড়ে দিয়েছে । ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।