mahbub-sumon.com
প্র: মুজিব বাহিনী সম্পর্কে আপনি কি জানেন ?
উ: মুজিব বাহিনী সম্পর্কে তখন শুনেছিলাম তোফায়েল আহমদ নাকি কর্নেল ওসমানীকে প্রস্তাব দেন যে,যদি তাঁকে অনুমতি দেয়া হয় তাহলে তিনি ভালো ভালো ছেলে যোগাড় করে তাদেরকে ট্রেনিং-য়ের ব্যবস্হা করবেন এবং একটি বাহিনী গড়ে তুলবেন। এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কর্নেল ওসমানী বিষয়টিতে সম্মতি জানান এবং তোফায়েল আহমদকে এ কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য তাঁকে পর্ণ কর্তৃত্ব দিয়ে একটি চিঠিও ইস্যু করেন। সেই চিঠিতে মুজিব বাহিনী গঠনের কথা ছিলো না। কিন্তু ঐ চিঠিটাকে কাজে লাগিয়ে তোফায়েলরা মুজিব বাহিনী গঠন করে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত ছিলো না।
একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি,এই বাহিনীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবার ছাড়া কোনো গরীব কিংবা চাষী পরিবারের ছেলেদের নেওয়া হয়নি। কোনো শ্রমজীবী মানুষকেও এই বাহিনীতে নেওয়া হয়নি। তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিলো যে,এই আন্দোলন বা যুদ্ধ যাতে বামপন্থীদের হাতে চলে না যায়। বোধহয় সে জন্যই কোনো গরীব,মজদুর,চাষী বা সাধারণ ঘরের ছেলেদের মুজিব বাহিনীতে নেওয়া হয়নি। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধে যে এফ. এফ. বা গণবাহিনী ছিলো,যারা প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং যাদের সংখ্যায় ছিলো সর্বাধিক তাদের ৭০ ভাগই ছিলো কৃষক শ্রেণীর বা কৃষক পরিবারের।
আমি বেশ কিছুসংখ্যক মুজিব বাহিনীর সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছি- তারা সবাই বেশ ভালো,শিক্ষিত,স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে।
বিভিন্ন এলাকা থেকে মুজিব বাহিনীতে যে সব ছেলেকে নেওয়া হয়- সে সম্পর্কে প্রথমে আমরা কিছুই জানতে পারিনি বা আমাদের জানতে দেয়া হয়নি। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গেই এ কাজটি করা হয়। প্রথমে আমি যুব শিবিরগুলির পরিচালক এবং পরে মহাপরিচালক ছিলাম তথাপি আমাকে কিছুই বলা হয়নি বা এর রিক্রুট প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রাখা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও মুজিব বাহিনীর ব্যাপারটা পরে জানতে পারেন।
আমার মনে হয়েছে যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্পে রির্পোট করার আগেই ঐসব ছেলেদের রিক্রুট করা হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাম্পে এম. পি.,এম. এন. এ. গণ নিয়মিত যাচ্ছেন, থাকছেন। কিন্তু তাঁরা বা তাঁদের কেউ মুজিব বাহিনীর জন্য সদস্য রিক্রুট করছেন- এমন কথা তাঁরা কোনো দিন বলেননি। এ বিষয়টি জেনেছি অনেক পরে,যখন মুজিব বাহিনীর ছেলেরা প্রশিক্ষণ শেষ করার পর সেক্টরের মাধ্যমে তাদেরকে Induct করা শুরু হলো। এ কাজটিও করা হলো সেক্টর কমান্ডারদের না জানিয়ে।
এ সময়ই আমরা বিভিন্ন সেক্টর থেকে মুজিব বাহিনী সম্পর্কে খবর পাওয়া শুরু করলাম। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে আমি প্রথম জানতে পারলাম যখন আমাদের সেক্টর কমান্ডারদের কাছ থেকে এই বাহিনী সম্পর্কে নানান অভিযোগ ফোর্সেস হেড কোয়ার্টারে আসতে লাগলো। তাঁরা জানালেন,এরা কারা,কেন-ই বা তারা এখানে এসেছে,আমরাই তো যুদ্ধ করছি,আমাদের গেরিলা যোদ্ধাও রয়েছে, রেগুলার ফাইটারও আছে- তাহলে তাদের ভূমিকা কি ? তাদের কার্যক্রম বন্ধ করা দরকার। মুজিব বাহিনী নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনাও অনেক ঘটেছে। ৮ নম্বর সেক্টরের অন্যতম সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা আমাকে বলেছিলেন, এক রাতে যখন মুজিব বাহিনীর একটি গ্রুপ বাংলাদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো- তখন বি. এস. এফ. তাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বন্দি করে রাখে সারা রাত।
এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছিলো। যাহোক,শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর হস্তক্ষেপে মুজিব বাহিনীর তৎপরতা যুদ্ধের শেষ দিক থেকে সীমিত হয়ে পড়ে।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই যে,এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। কারণ এটা ছিলো জনযুদ্ধ। সুতরাং এর মধ্যে আলাদা কোনো বাহিনী গঠনের যৌক্তিকতা আমি দেখি না।
পরে এই বাহিনী যে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে সেটাও আমার মনে হয়েছিলো। যদি এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় তাহলে যুদ্ধের নেতৃত্ব হয়তো বামপন্থীদের হাতে চলে যাবে- এই ভীতি হয়তো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কারো কারো মধ্যে ছিলো। আওয়ামী যুব নেতাদের মধ্যেও এই ভীতি ছিলো। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের একটা অংশের মধ্যেও এমন আশঙ্কা ছিলো। নেতৃত্ব যাতে বামপন্থীদের হাতে না চলে যেতে পারে মূলত সে জন্যই হয়তো মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি।
আমি অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে শুনেছি যে,মুজিব বাহিনীর অনেক সদস্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যারা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলো তাদের অনেককে হত্যা করেছে। এমন কি বাম রাজনীতি করে- এমন সন্দেহ বশবর্তী হয়েও অনেককে হত্যা করা হয়।
জেনারেল ওবান ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন বিশেষজ্ঞ। How to suppress the Guerillas. He was an expert on that. এই ওবান-ই ট্রেনিং দিয়েছিলেন এই বাহিনীকে। তার অর্থ দাঁড়ালো যে,স্বাধীনতার পর যদি দরকার পড়ে তাহলে এই বাহিনীকে ব্যবহার করা হবে অন্য সব গেরিলাদের দমন করার জন্য।
প্র: ১৯৭১ সালের মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা কালে আপনি ঢাকায় ছিলেন। এ সময়ের কথা কিছু বলবেন কি ?
উ: এ কথা সত্য যে,১৯৭১ সালে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দিলেন- সেখানে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। তিনি স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য বাঙালিদের সংগ্রামে নামতে বলেছিলেন, যুদ্ধ করতে বলেছিলেন। বলা হয়,২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি হান্নান সাহেব পাঠ করেছিলেন। কিন্তু সেটা আমি শুনিনি।
এ সময় শ্যামলিতে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আমি ছিলাম। ২৭ মার্চ সন্ধ্যার দিকে পরিষ্কার শুনলাম বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। সেখানে পাকিস্তানিদের আক্রমণ,বৈদেশিক নীতি অবস্হান ইত্যাদি বিষয় ছিলো।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কোনো আলোচনা বা বিতর্ক আমি শুনিনি। এমন কি স্বাধীনতার পরও এ নিয়ে কোনো বিতর্ক শুনিনি।
বিতর্ক শুরু হলো দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে। শেখ মুজিব যতদিন বেঁচে ছিলেন- ততদিন পর্যন্ত এ নিয়ে কেউ কোনো কথা উত্থাপন করেননি বা বিতর্ক হয়নি। এটা শুরু হলো সম্ভবত: ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর। বিএনপি নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর যখন আওয়ামী লীগ মেজর জিয়াকে ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করলো- তখন থেকেই বিবাদটা প্রকট আকার ধারণ করলো।
চলবে........
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।