আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও, পর্ব ২.৯ (একটি কথ্য ইতিহাস-উইং কমান্ডার (অব.) এস. আর. মীর্জা )

mahbub-sumon.com
প্র: আপনি বাংলাদেশ ফোর্সেস হেড-কোয়ার্টারের কর্মকান্ড সম্পর্কে কিছু বলবেন কি ? উ: যুব শিবির সূত্রে আমাকে ফোর্সেস হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হতো। এ ছাড়া আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগও ছিলো পুরনো সম্পর্ক সূত্রে। এই দু’টো সূত্রেই আমি হেড কোয়ার্টারের খবরা খবর জানতে পারতাম। ফোর্সেস হেড কোয়ার্টারে কর্মরত ডেপুটি চীফ অব স্টাফ এ. কে. খন্দকার সাহেব একবার আমাকে বলেছিলেন যে,২২টি নতুন ব্রিগ্রেড গঠন করা হবে। কিন্তু পরে এটা আর হয়নি।

এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে,প্রতি মাসে অন্তত: ১০ হাজার তরুণকে গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে ভেতরে পাঠানো হবে। এ লক্ষ্যে আমরা কাজও করেছিলাম। ওসমানী সাহেব প্রথম দিকে গেরিলা বাহিনীর ব্যাপারে তেমন উৎসাহী ছিলেন না। তিনি বলতেন,রেগুলার বাহিনী গঠন করে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। কর্নেল ওসমানী সাহেবের একটা সমস্যা ছিলো যে,তিনি গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন না।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি যে,গেরিলা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করেছে,এটা বোধহয় তিনি জানতেন না। তিনি একমাত্র কনভেনশনাল যুদ্ধেই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু সেই কনভেনশনাল যুদ্ধেও তাঁর যোগ্যতা নিয়ে সে সময় নানা প্রশ্ন উঠেছিলো। তাঁর জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ই চীফ অব স্টাফ কর্নেল রব কলকাতায় আমাকে একদিন বলেছিলেন,কর্নেল ওসমানীর কর্মজীবনের কথা।

আমি কর্নেল রবকে জানি ১৯৪৮ সাল থেকে। তখন তিনি ছিলেন একজন স্টাফ ক্যাপ্টেন। পাকিস্তান আর্মি হেডকোয়াটার্সের স্টাফ ক্যাপ্টেন ছিলেন। অমায়িক এক ভদ্র লোক। সে সময় আমিও আই. এস. সি. পাশ করে এয়ারফোর্সে যোগদান করি।

তখন থেকেই আমার সাথে তাঁর আলাপ। মাঝে অবশ্য তাঁর সাথে আমার অনেক দিন দেখা হয়নি। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসের কথা। কর্নেল রব তখন বাংলাদেশ আর্মির চীফ অব স্টাফ। আগরতলাতে বসতেন।

কলকাতা এসেছিলেন ওসমানী সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য। ওসমানী সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আমার অফিসে এসেছিলেন তিনি। আমি আর কর্নেল রব সাহেব এক সঙ্গে বসে কথা বলছিলাম আমার অফিসে। সেখানে রেজাও ছিলো। এক সময় রব সাহেব বললেন যে, আমাদের চাইনিজ খাওয়াবেন।

আমি আর রেজা এটা শুনে তো মহা খুশি। অনেকদিন আমরা ভালো খাবার বা চাইনিজ খাবার খাইনি। সন্ধ্যেবেলায় কলকাতার একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন। খাওয়া শুরু করার পরপরই রব সাহেব ওসমানী সম্পর্কে অনেক কথা বললেন। তিনি বললেন,জানো,কাশ্মীর যুদ্ধে ওসমানীকে একটা ট্রুপসের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো।

তাঁর সেনা ক্যাম্প যেখানে ছিলো,সেখানে একটা ট্রাইব ছিলো। এরা ছিলো অত্যন্ত যুদ্ধপ্রিয় জাতি। এই উপজাতি ওসমানীর সেনা অবস্হানের উপর আক্রমণ পরিচালনা করতে উদ্যত হয়। এটা শোনার পরপরই ওসমানী সাহেব তাঁর অবস্হান ছেড়ে পালিয়ে যান। পাকিস্তান সরকার এই বিষয়টির উপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

তদন্তে দেখা গেলো যে,সেখানে একজন সুবেদার মেজর তার বাহিনী নিয়ে স্হির ছিলেন। কিন্তু ওসমানী পালিয়ে যান। ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় ওসমানীকে পরে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপর তাঁকে স্টাফ বিভাগে বদলী করে দেয়া হয়। সামরিক বাহিনীতে চাকরি জীবনে তিনি আর কখনো কমান্ড পাননি।

মূলত: তিনি ছিলেন স্টাফ অফিসার। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি হন পেপার জেনারেল। শুধু অফিসে বসে অর্ডার দেয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো কাজ ছিলো না। আসলে কর্নেল ওসমানীর কারণেই বাংলাদেশ মিলিটারি হেড কোয়ার্টারে ওয়ার পরিকল্পনা বলতে তেমন কিছু ছিলো না। কর্নেল ওসমানী ছিলেন একগুঁয়ে।

এখানে তার একটি উদাহরণ দিই। বিষয়টি আমার আজো মনে আছে। বিষয়টি ছিলো,গেরিলা উইল হ্যাভ টু বি ইনডাকটেড অ্যাট ফরিদপুর। স্বাভাবিকভাবেই তাদেরকে সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত পথেই পাঠাতে হবে। অর্থাৎ যশোর সীমান্ত দিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশের ফরিদপুরের উদ্দেশে পাঠানোটাই ছিলো স্বাভাবিক।

কিন্তু তা না পাঠিয়ে কর্নেল ওসমানীর অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং তাঁর যে সেক্টর এলাকা আগরতলা, সেই আগরতলা দিয়েই গেরিলাদের পাঠাবার জন্য তিনি চাপ দিলেন। মেজর খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে এই কাজটি করতে হবে সে কথাও তিনি বললেন। সমস্যা দাঁড়ালো ঐ এলাকা থেকে ফরিদপুরে আসতে হলে তাদেরকে নদীপথে অনেকটা পথ ঘুরে আসতে হবে। গেরিলারা তাঁর নির্দেশ মেনে খালেদ মোশাররফের এলাকা থেকে নদী পথে রওয়ানা হলো। এ দিকে পাক আর্মি নদীপথে এ সময় পেট্রোল করছিলো।

পাক আর্মি তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে এবং তাদের গুলিতে গেরিলাদের সবাই নিহত হয়। এমন অনেক ঘটনা সে সময় ঘটেছিলো। কর্নেল ওসমানী অল্পতেই ভীষণ রেগে যেতেন এবং চিৎকার করতেন। এ বিষয়ে আর একটি ঘটনার উল্লেখ করতে পারি। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর এম. জি. তাওয়াব ছিলেন একজন সিনিয়র দক্ষ অফিসার।

তাওয়াবের ছিলো জার্মান স্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁকে পাকিস্তান থেকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। তাওয়াব তখন জার্মানী বা লন্ডনে অবস্হান করছিলেন। আমি ফোর্সেস হেডকোয়ার্টারকে বললাম যে,তাওয়াবকে আমাদের নিয়ে আসা উচিত। গ্রীণ সিগনাল পেয়ে আমি তাওয়াবকে একটি চিঠি লিখলাম।

তাঁর শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা আমি জানতাম। সেই ঠিকানায় তাঁকে আমি চিঠি পাঠালাম। কিন্তু চিঠিটি ফিরে আসলো। বিলি হয়নি। এরপর তখনকার গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাওয়াব আমাকে একটি লম্বা চিঠি লিখলো।

সে তখন যুদ্ধে যোগদানের শর্ত জানতে চাইলো। অথচ আমি বা আমরা সকলে যুদ্ধ করছি শর্তহীনভাবে। খাদেম আলী বলে একজন স্হপতি ছিলেন। তাঁরও জার্মান স্ত্রী। খাদেম আলী ছিলেন তাওয়াব-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

খাদেম আলীর মাধ্যমে তাওয়াবকে আমি পুনরায় খবর পাঠালাম যাতে সে চলে আসে। এরপর তাওয়াব ওসমানী সাহেবকে একটা পত্র লেখে খাদেম আলীর মাধ্যমে। এক বিকেলে আমি আর রেজা বসে আছি অফিস কক্ষে,এ. কে. খন্দকার আর স'পতি খাদেম আলী গেছেন কর্নেল ওসমানীর রুমে। দরজা বন্ধ। এর মধ্যে বিকট চিৎকার।

আমি আর রেজা চুপ করে বসে আছি। ওসমানী কি বলছেন বুঝতে পারছিলাম না। পরে খন্দকার সাহেব আর খাদেম আলী ফিরে আসলে তাদের জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে ? খন্দকার সাহেব বললেন যে,তাওয়াব মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য কিছু শর্ত আরোপ করেছেন- এটা শুনেই ওসমানী রাগে অগ্নিশর্মা এবং এ জন্যই চিৎকার করছিলেন। এরপর তাওয়াব-এর সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয়নি। অথচ কর্নেল ওসমানী বিষয়টি ধীর স্হিরভাবে হ্যান্ডেল করে তাওয়াবকে পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসতে পারলে পাকিস্তানিরা অনেকটাই হতাশ হতো এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও ইতিবাচক প্রভাব পড়তো।

চলবে.........
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.