নতুন কার্পেটিং করা ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে আমাদের ছোট বাসটা চলছিল ঘন্টায় আশি কিলোমিটার এর কাছাকাছি গতিতে। সদ্য কৈশোর পার হওয়া তরুণদের মনে তখন পারিবারিক শৃংখল থেকে মুক্তি আর অফুরন্ত স্বাধীনতার হাতছানি।
স্বাভাবিকভাবেই আমরা ছিলাম উচ্ছ্বল। অতি নিরস কোন গল্পেও হেসে এ ওর গায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছি।
আমরা রাজধানীতে চলছিলাম ইন্টারে ভর্তির আশায়।
গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারে বাঁজতে থাকা চটুল গানে ছন্দপতন হল কখন, কেউ খেয়াল করিনি।
হঠাৎ করে শুনি, কোন এক গায়িকা ক্যানকেনে গলায় টেনে টেনে গাচ্ছেন ... বেনী মাধব, বেনী মাধব, তোমার বাড়ি যাব....
মঈন বলল, ওই, দ্যাখ, কি বলে, শুনে আমরা আবার হাসতে থাকি; এটা কোন গান হল! আবজাব সব কথাবার্তা....
আর তখন বয়সটাই ছিল এমন, সব কিছুতে হাসি পায়।
মানব-মানবীর মধ্যকার প্রেম নিয়ে বিস্তর আগ্রহ থাকলেও এর গভীর ভাব-এ মগ্ন হওয়ার বয়স আমাদের না। আমরা কেউই তাই লোপা মুদ্রা মিত্র'র আকুতি আর বেনী মাধবের আকর্ষণ ধরতে পারলামনা। অদ্ভুত সব কথাবার্তা আমাদেরকে শুধু কৌতুকপ্রবণ করতে পেরেছিল তখন।
সেই ঘটনা গত হয়ে গেছে বহুদিন। ভুলেই গেছি সব কিছু।
ভার্সিটিতে এসে, হল-এ নিশুথ রাত জাগাদের একজন হয়ে, এক রাতে কম্পিউটারে গান শুনতে শুনতে কি একটা যেন করছিলাম,
থেকে থেকে দুরে কোথাও কাকের ডাক আর বাথরুমে ট্যাপ থেকে পানি পড়ার শব্দ ছাড়া কোন শব্দ নেই আপাতত।
এরকম একটা সময়ে কম্পিউটারে বেনী মাধব এসে উপস্থিত! আমি চমকে উঠলাম। এই গান এখানে আসলো কিভাবে জানিনা,
কোনদিন যে এই অদ্ভুত গান আবার শুনব, আমার ধারণা ছিলনা।
আমি কাজ বন্ধ করে চুপচাপ গানটা শুনলাম। কি সহজ সরল কিন্তু অন্যরকম কথা আর সুর। লোপা'র মসৃণ, নিখাদ গলায় সাংঘাতিক রকম আবেদনময়।
দিন বদলের পালায় আর হৃদিক টানাপোড়েনে ততদিনে বেনীমাধবের জন্য লোপার আকুতি আমার নিজেরই হয়ে গেছে।
আমি অনেকটা সময় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম এবং গানটা পেছনে টেনে এনে আবার শুনলাম....আবার।
একটা গান যে মানুষের মনের উপর এতটা চাপ ফেলতে পারে, আমি জানতাম না।
শুনতে শুনতে একসময় আমি নিজেই লোপা বা বেনীমাধব হয়ে গেলাম।
আর বাস্তবেওতো আমরা একেকজন তা-ই।
শুধু প্রকাশ করতে পারিনা লোপার মত।
গানের কথা: জয় গোস্বামী, কন্ঠ: লোপা মুদ্রা মিত্র
বেনী মাধব, বেনী মাধব, তোমার বাড়ী যাব
বেনী মাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাব?
বেনী মাধব, বেনী মাধব, তোমার বাড়ী যাব
বেনী মাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাব?
বেনী মাধব....
মোহন বাঁশি তমাল তরু মূলে, বাজিয়েছিলে
আমি তখন মালতি স্কুলে
ডেস্কে বসে অংক করি ছোট্ট ক্লাস ঘর
বাইরে দিদি মনির পাশে দিদি মনির বর
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ী
আলাপ হল বেনী মাধব সুলেখাদের বাড়ী
বেনী মাধব, বেনী মাধব লেখা পড়ায় ভাল
শহর থেকে বেড়াতে এলে, আমার রং কালো
তোমায় দেখে এক দৌড়ে, পালিয়ে গেছি ঘরে
বেনী মাধব আমার বাবার দোকানে কাজ করে
কুঞ্জে ওলি গুঞ্জে তবু ফুটেছে মঞ্জরী
সন্ধে বেলা পড়তে বসে অংকে ভূল করি
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন ষোল
ব্রীজের ধারে বেনী মাধব, লুকিয়ে দেখা হল
বেনী মাধব, বেনী মাধব এত দিনের পরে
সত্যি বল, সেসব কথা এখনও মনে পড়ে?
সেসব কথা বলেছ, তুমি তোমার প্রেমিকাকে
আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নিচে, অপূর্ব সে আলো
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিল চোখ আমার, পুড়িয়ে দিল চোখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভাল হোক
রাতে এখন ঘুমোতে যাই একতলার ঘরে
মেঝের ওপর বিছানা পাতা, জোৎস্না এসে পড়ে
আমার পরে যে বোন ছিল, চোঁরা পথের বাঁকে, মিলিয়ে গেছে
জানিনা আজ কার সঙ্গে থাকে
আজ জুটেছে, কাল কি হবে, কালের ঘরে শনি
আমি এখন এই পাড়ায় সেলাই দিদি মনি
তবুও আগুন, বেনী মাধব, আগুন জ্বলে কই (?)...
কেমন হবে আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?
বেনী মাধব, বেনী মাধব.... তোমার বাড়ি যাব
বেনী মাধব, বেনী মাধব.... তোমার বাড়ি যাব....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।