আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি তোমাকে পূজো দিতে চাই/এহসান হাবীব

ফোঁটায় ফোঁটায় জহর আমি জমা করে রাখি তোর নাম করে বুড়ি জপি নতুন রুবাই ।

আঠারো শতকের প্রথমার্ধ বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি বিশেষ মাইলফলক হয়ে আছে। এই সময়েই সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠে। মুদ্রণ শিল্পের প্রচলন ও প্রসার সাহিত্যের জন্য খুলে দিল এক বিস্তৃত পৃথিবীর দরোজা। এরপর গত হয়ে গেল দুইশ বছর।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বাংলা সাহিত্যের জন্য অবশ্যই সম্ভাবনার দরোজা খুলে দিয়েছিলো। কিভাবে? - তা বিস্তৃত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। মুদ্রণ শিল্পের অভাবনীয় প্রয়োগের কল্যাণে হাতের কাছেই আজ তার প্রমাণ ও দলিল দস্তাবেজ। সাহিত্যের জন্য যারা একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর তাগিদ অনুভব করলেন তারা অবশ্যই সৃষ্টিশীল ছিলেন এবং সেই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতর দিয়েই মাইকেল অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনার উন্মেষ ঘটালেন। আর রবীন্দ্রনাথ তো প্রাতিষ্ঠানিকতার ধারায় রীতিমতো ইতিহাস।

পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে এসে যারা সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টা করলেন -তারাও সৃষ্টিশীলতার তাগিদ থেকেই তা করলেন। প্রমথ চৌধুরীই আমাদের প্রথম দেখালেন অপ্রাতিষ্ঠানিকতার প্রকৃত স্বরূপ। এরপর ত্রিশের সুধীন দত্তের কথাও স্মরণে আনা যেতে পারে। এরপর অবশ্য আমাদের সামনে অপ্রাতিষ্ঠানিকতার ধারনাটাই বদলে গেল। ষাটের দশকের প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার কল্যাণে প্রতিষ্ঠান বিরোধীতাকেই আমরা অপ্রাতিষ্ঠানিকতা বলে ভাবতে লাগলাম।

প্রতিষ্ঠানও যে প্রতিষ্ঠানের বিরোধীতার করতে পারে তা আমরা বুঝতে চাই নি। তো যাই হোক, এই দুইশ বছরে বাংলা কবিতা কম তো দেখলো না? প্রাতিষ্ঠানিকতা, অপ্রাতিষ্ঠানিকতা, প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার পর বাংলা কবিতা এক্সপেরিমেন্টাল যুগও দেখেছে। কিন্তু এই দুইশ বছরে বাংলা কবিতার প্রায় হাজার খানেক কবিতালিখিয়ে কী চেয়েছে? এই দুইশ বছরে তারা আজকের বাংলা কবিতাকে কোথায় নিয়ে এসেছে? এবার আমি একটা স্থুল বিষয়ের ভেতর ঢুকব। এই যে হাজার খানেক কবিতালিখিয়ে দুইশ বছর ধরে রিমের পর রিমের কাগজ আর ড্রামের পর ড্রাম কালি খরচ করে ফেললেন, তা কাকে অর্ঘ্য দেওয়ার জন্য? এখানে নন্দনতত্ত্বের একটা বিষয়ের সাথে আমার মতবিরোধ আছে। নন্দন তত্ত্বের একটা দিক বলছে, শিল্পী তার নিজের মনের আনন্দে শিল্প সৃষ্টি করেন।

পাখি যেমন নিজের মনের আনন্দে গান করে। আমি নন্দনতত্ত্ব বিশারদদের মনে করিয়ে দিতে চাই সেই গল্পটির কথা। দৈত্যের বাগানের গল্প। যে বাগানে জনমানুষ তো দূরের কথা শিশুদেরও প্রবেশাধিকার ছিলো না। আর সে বাগানে পাখিও গান গাইতো না, ফুলও ফুটতো না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে- পাখিও শ্রোতা চায়, ফুলও দর্শক চায়। কবি কবিতা লেখার মুহূর্তটুকুতেই কেবল নিজের মনের আনন্দে কবিতা লেখেন, এরপর কবির মন আনন্দে ভরে ওঠে তখন যখন তা পাঠক সমাজের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। সাধু সন্ন্যাসীর ভাব করে যারা পাঠক সমাজকে গৌণ করে ফেলেন তারা নিবিড় রাত্রিতে অন্ধকার ঘরে বুকের উপর হাত রেখে বলুন, পাঠক আপনার কতটা আকাক্সিত জন। হোমার থেকে রবীন্দ্রনাথ, আবু হাসান শাহরিয়ার থেকে রবার্ট ব্রাউনিং সকলেই তো এক পাঠককে অর্ঘ্য দিতে চেয়েছেন। একটি সভ্য কম্যুনিটিতে 'পাঠক' একটা আলাদা শ্রেণি হিসেবে পরিগণিত হয়।

অবশ্য সেক্ষেত্রে কম্যুনিটিরও কিছু দায় থাকে। সে দায় আমাদের কম্যুনিটি মিটিয়েছে। আমাদের মুদ্রণ শিল্প পৃথিবীর যে কোন দেশের প্রকাশনামানের সাথে পাল্লা দিতে পারে। আমাদের কবিরা প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, নিরীক্ষা ও প্রচল সব ক'টি ধারাতেই তো গত দুইশ বছর ধরে চেষ্ঠা চালিয়েছে পাঠকের দ্বারে যাওয়ার জন্য। তবু আজও এই দেশে সচেতনভাবে একটি পাঠক শ্রেণি গড়ে ওঠলো না।

এ পর্যায়ে আমরা দুইটি মতবাদের দেখা পাবো। এক মতবাদের লোকেরা বলছে- পাঠক নেই একথা ঠিক নয়, বাংলা কবিতার এখনও প্রচুর পাঠক। এ পর্যায়ে আমি একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরতে চাই, বাংলাদেশের সর্বাধিক বিক্রিত কবিতার বইয়ের এক মুদ্রণে প্রকাশিত কবিতার বই সর্বোচ্চ দুইহাজার কপি, আর কোন কবিতার বইয়ের পঞ্চম মুদ্রন হয়েছে এমন নজিরও বিরল। আর গড়ে এক মুদ্রণে কবিতার বই ছাপা হয় পাঁচশ কপি। তো এই দুইহাজার ও পাঁচশ'র মাঝে যে বইগুলো বিক্রি হয় তার অধিকাংশ ক্রেতাই কোন না কোনভাবে কবিতাকর্মী।

তাহলে শ্রেণি হিসেবে পাঠক'র অস্তিত্ত্ব কোথায়? সাম্প্রতিক এক আড্ডায় আমার এক বন্ধু বলেছিলো যে, কয়েকদিন পূর্বে পত্রিকায় প্রকাশিত একটা ছবি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সেই ছবিটি ছিলো জাপানের একটি চলন্ত ট্রেনের অভ্যন্তরের দৃশ্য। সেখানে সারি সারি মানুষ ট্রেনে বসে আছে আর সকলেই এক একটা বই নিয়ে মেতে আছে। চিন্তা করা যায় বাংলাদেশের কোন ট্রেনের দৃশ্য এটি? ৫০ কোটি ইংরেজি ভাষাভাষির মাঝে গিনস্বার্গের 'হাউল' ৩ মাসে বিক্রি হযেছিলো প্রায় ১ লাখ কপি। সেখানে ২১ কোটি বাংলা ভাষাভাষির মাঝে শক্তি বা আল মাহমুদের কবিতার বই গত ৫০ বছরে বিক্রি হয়েছে কত কপি? তাহলে আমাদের সমাজে পাঠক শ্রেণিটি কোথায়? একটি পুরোনো ঐতিহ্যবাহী শহরের কয়েকটি গণগ্রন্থাগারের চিত্র তুলে ধরি- টাকা দিয়ে কিনে নয়, টাকা দিয়ে সদস্য হয়ে নয়, সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ আছে এই গ্রন্থাগারগুলোতে। সেখানে আমি দেখেছি দিনের কর্মব্যাস্ততায় তো বটেই বিকেলের অবসরেও গ্রন্থাগারগুলো খা খা করে।

প্রায় দু'ইঞ্চি পুরো ধূলোর আস্তরণের ভিতর আমি উঁইপোকার খাবার হতে দেখেছি মাইকেলের মেঘনাদ বধ, রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, তারাশংকরের কবি, বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়, মোবাশ্বের আলীর শিল্পীর ট্র্যাজেডি'র মতো বই। এতো আমাদের পাঠক শ্রেণির কীর্তিই। দ্বিতীয় মতবাদ হলো- বাংলা কবিতা আজ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, ফলে পাঠক বাংলা কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাদের জন্য বলি, মানলাম আমি এহসান হাবীব না হয় 'বালছাল' লিখি কিন্তু উপরে উল্লেখিত উঁইপোকায় খাওয়া কবিতার কবিরা কী দোষ করেছে? না কি তাদেরও কিছু হয় নি? যখন একটা কম্যুনিটিতে সচেতনভাবে কোন পাঠক শ্রেণি গড়ে ওঠে না, তখন শুরু হয় সাংস্কৃতিক দালালী। বিভিন্ন রকম এজেন্ডা নিয়ে শুরু হয় গোষ্ঠী কেন্দ্রিক নোংরামি, প্রকাশনা সংস্থাগুলো লিপ্ত হয় ফড়িয়াবাজীতে।

পাঠক শ্রেণি না থাকলে কবিকে কবিতা লেখার পাশাপাশি নানা রকম অসাহিত্যিক কাজেও লিপ্ত থাকতে হয়, যেমন- তাকে সময় করে একবার সম্পাদকের কাছে ধর্ণা দিতে হয়, প্রকাশকদের পিছনে স্যান্ডেলের তলি ক্ষয় করতে হয়, তাকে জনসংযোগ তো করতে হয়ই পাশাপাশি তাবলিগও করতে হয়। প্রকৃত কবি এতে ক্লান্তি বোধ করেন। এতসব ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর চাইতে তিনি ছেড়ে পারেন কবিতা লেখাই। এতে কবির কিছুই যাবে আসবে না, সভ্যতা বঞ্চিত হবে তার কবিতা থেকে। সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে কবিকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরী।

পাঠক! আমি তোমাকে পুঁজো দিতে চাই। এবার তুমি দিনের আলোয় একটু দেবতা হও তো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.