দেশে থাকতে শুনেছিলাম বটে ইউরোষ্টার অনেক দ্রুত চলে, এবার বুঝলাম গতি কাকে বলে। ১৮৬ মাইল স্পীড ঘন্টায় অবিশাস্য লাগে আমার কাছে। জার্মানী আর জাপানে নাকি এর চেয়েও দ্রুত গতির ট্রেন আছে। দেশে থাকতে গ্রামের বাড়ি যাবার সময় ঢাকা-মাওয়া রুটের গাড়িগুলো বেশ স্পীডেই চলত, কিন্তু এখন বুঝলাম স্পীড কি জিনিস। সা সা করে অতি দূরের গাছপালাগুলো যেন পাগলের মত পেছন পানে ছুটছে।
আমার পাশের সহযাত্রীদের দেখে মনে হল তারা যেন ঢাকা নারায়নগঞ্জ রুটের যাত্রী। কারন একটা ভ্যানিটি ব্যাগ ছাড়া সাথে আর কিছুই নেই। যদিও এটা ক্রসকান্ট্রি ট্রিপ বিষয়টা এখানে অনেক সহজ কারন অনেকেই সকালে প্যারিস গিয়ে বিকেল শপিং শেষে লন্ডন ফিরে আসে, ভাবখানা বঙ্গবাজার যাচ্ছে ঈদের কেনাকাটা করতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রেন ইংলিশ চ্যানেলের নীচে টানেলে ঢুকে পড়ল। অনেক শুনেছি এবার দেখলাম, দেখলাম বলতে অন্ধকার আর লাইট।
২৫/৩০ মিনিট পর টানেল থেকে বের হয়ে ট্রেন ধানক্ষেত ধরে ছুটতে লাগল। মোবাইলে এস এম এস এসে বলে দিল এটা ফ্রান্স। তা বাবা ফ্রান্সখানা দেখতে এমন কেন? এমন তো শুনিনি সপ্নের শহর, ভীষন সুন্দর, সারাদেশ ঘ্রানে ভরপুর বলেই তো জানতুম। এযে দেখছি ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। তা বাপু ধানক্ষেত তো আমাদের দেশেও আছে এবং তা এখান থেকে শতগুন সুন্দর।
বাংলার রুপ দেখিয়াছি পৃথিবীর রুপ আমি আর দেখতে চাইনা যিনি বলেছেন সত্যিই বলেছেন। ট্রেন মধ্যপথে ''লিল ইউরোপ'' ষ্টেশন একটা বিরতি দিয়ে আবার ছুটলো। ব্রুসেলস পৌছে গেলাম, কোন ইমিগ্রেশন নেই, জানাই ছিল পাতাল রেল ধরতে হবে গন্তব্য বোটানিক কুরুতদান ( উচ্চারন ভিন্নও হতে পারে) ।
পাতাল রেল ধরে বোটানিক এসে ম্যাপ বের করে ভাবছি কোথা দিয়ে গেলে সহজে হস্টেলে পৌছতে পারব। কাকে জিজ্ঞাসা করব ভাবছি? কারন আমার ফ্রেঞ্চ জ্ঞান অতি সামান্য।
কাছেই একটা মেয়েকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম ইংরেজীতে '' ডু ইউ নো হাউ টু গো দিস প্লেস? ম্যাপখানা দেখাতেই বিশুদ্ধ ইংরেজীতে জবাব '' আর ইউ অলসো লুকিং ফর ভ্যান গগ''
প্রশ্ন করতেই বুঝলাম এই সুন্দর মানবী ও আমার গন্তব্য একই যায়গায়। পরিচিত হতে সময় লাগলো না নাম মেগান, আমেরিকার ডেনভারের মেয়ে, পেশায় শিক্ষক। ছ সপ্তাহের হলিডের জন্য ইউরোপে আগমন সাথে ইষ্টার্ন ইউরোপে কোন শহরে বন্ধুর সাথে দেখা করবে। আমার মতই সলো ট্রাভেলার। নিজের পরিচয় দিলাম বাংলাদেশের কথা শুনে বলল ও জানে বাংলাদেশের কথা তবে দেশটির অবস্থান কোথায় জানেনা।
ছোটখাট একটা ভাষন বাংলাদেশের ব্যাপারে দিয়ে দিলাম।
পাঁচ মিনিটের পথ আমরা ২০ মিনিট ঘোরাঘুরি করে হস্টেলের হদিস বের করতে পারলাম। হস্টেলের নাম ভ্যান গগ, কেবলমাত্র ইয়াংদের জন্য দিবা রাত্র ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে, ভাড়াও তুলনামূলক সস্তা। রিসেপশন থেকে আমাদের একই রুমে ট্রান্সফার করে দিল। যদিও আমরা বার বার বললাম আমরা একসাথে নই।
ব্যাটা কি বুঝল কে জানে চাবি ধরিয়ে রুম নাম্বার বলে দিল। আবিস্কার করলাম রুমের অবস্থা বেশ ভাল। দুটো খাট আছে প্রত্যেকটাই আবার দু তলা। আর কারো খোজ খবর মিলল না। দুজনে আমরা দুটো খাট দখল করে নিলাম।
মেগান কে ১০ মিনিট সময় দিয়ে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি ও রেডী। অলরেডী ম্যাপ বের করে ফেলেছে হাতে লোনলী প্লানেট। বুঝলাম বেচারী প্লান করেই তবে এসেছে আমার মত উরে এসে জুড়ে বসেনি। ওদের স্পিরিট দেখে ভাল লাগল। আমিও নিজের কনট্রিবিউশন স্বরুপ একখানা ফ্রি ম্যাপ নিয়ে আসলাম, এটার মধ্যে বর্ননা সহ কি কি দেখার আছে তা সংক্ষিপ্ত ভাবে সুন্দর করে দেয়া আছে।
শুরুটা বেশ মজার '' আমরা জানি ব্রুসেলস নোংরা এবং ভীষন ছোট, কিন্তু একেই আমরা ভালবাসি'' বিষয়টা আমিও লক্ষ্য করেছি ইউরোপীয়ান ক্যাপিটাল হিসেবে শহরটা বেশ নোংরা এবং ভীষন ভীষন ছোট, ভালভাবে ৩/৪ ঘন্টা হাটলে দেখার মত সবকিছু কভার হয়ে যাবে। এরা নাকি প্রথমে ভেবেছিল ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টে সবাই যোগ দিবেনা তাই সবকিছু ছোট করে করেছিল কিন্তু এখন সবকিছু ভেঙ্গে আবার নতুন করে করছে যার চেহারা ব্রাসেলসর সবত্রই বিদ্যমান। সময় নষ্ট না করে আমরা বেরিয়ে পরলাম। তবে একটা কথা বলতে হবে বেচারীর ঘোরাঘুড়ির এনার্জি আছে।
যদিও আমাদের হস্টেলের সামনে বোটানিক সেন্টারে ওপেন এয়ার কনসার্ট হচ্ছে আমরা এখানে সময় নষ্ট না করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বেশীদূর যেতে হলনা সামনেই একটা বিশার অবিলিস্ক, নাম: ? অবাক হলেও সত্যি এর কোনো নাম নেই। ইতিহাস ঘাটতে জানা গেল এখানে ছয়জন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিককে সমাহিত করা হয়েছে। এবং এ জন্য সারাদেশের সব ওয়ার মেমোরিয়াল খুড়ে নাম না জানা ছয় জনকে এখানে আনা হয়েছে রীতিমতো লটারীর মাধ্যমে। কেহই জানেনা কারা এখানে আছে তাই এটারও কোনো নাম নেই, উদ্দেশ্য নাম না জানা যুদ্ধে মারা যাওয়া লাখো সৈনিককে স্বরন করা। আমার দেশের কথা মনে হল না জানি কত অজানা লাখো শহীদ আমাদের দেশে রয়েছে কজনই বা জানে তাদের কথা।
কিন্তু রাজাকার, আলবদররা কিন্তু ঠিকই দেশে এখনো আছে প্রতিপত্তি সহকারেই। যাই হোক অন্য আলোচনায় যাব না, ক্যামেরা দিয়ে কয়েকটা স্ন্যাপ তুলে নিলাম ঝটপট। কিছুদূর না যেতেই বিশাল গীর্জা নামটা ভূলে গেছি তবে এটা ব্রুসেলসের একটা আইকন। পথে অনেক টুরিস্ট্য দেখলাম, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি যখন আপনি নিজে টুরিস্ট তখন কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করার কথা ভাবলে দেখবেন আশেপাশে সবাই টুরিস্ট্য। লন্ডনে সবসময় যাতায়াত করি কই একিদনওতো কোন টুরিস্ট দেখলাম না।
যেই আমি কোথাও ঘুরতে গেছি ওমা এযে দেখছি সবই টুরিস্ট। যাকে শুধাই সেই বলে আমিওতো এই যায়গাটা খুজছি। যাইহোক আমরা শহরের ভেতরের পানে রওনা দিলাম।
প্রচন্ড শব্দের মিউজিক ভেসে আসছে বেশ কাছ থেকেই। যেতেই আবিস্কার করলাম রাস্তায় ওপেন ডিজে হচ্ছে।
প্রচন্ড শব্দে বাজছে মিউজিক সেইসাথে পঙ্গপালের মত নাচছে সবাই। বেশীর ভাগের কাছেই একটা করে পানীয়ের গ্লাস ওয়াইন অথবা বীয়ারের। আমরাও সোৎসাহে যোগ দিলাম। দেখলাম নাচানাচি ব্যাপারে মাস্টারনী বেশ পটু। আমিও স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে দিলাম।
অনেকক্ষন পর হট্টগোল শেষ হলো, আমরা কিছুটা ভেতরে প্রবেশ করতেই বুঝতে পারলাম এখানে গে পার্টি হচ্ছিল। এখানকার সবাই ওই সমাজের অধিবাসী। অদূরেই ব্রাসেলসের গে কেন্দ্র। এখানকার মেম্বার এরা সবাই। কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারলাম না গে পার্টিতে এত মেয়ে কেন।
কিছুটা জল বিয়োগ করা দরকার তাই একটা পানশালায় ঢুকে হালকা হয়ে নিলাম। আমি আবার টাকা পয়সা দিয়ে বাথরুম সারার বিপক্ষে। এনিয়ে দেশে থাকতেও কম হয়নি। কমলাপুর রেলষ্টশনের কথা মনে পড়ল একদিন বিপদে পরে আমি ও আমার বন্ধু নুরা কমলাপুর পাবলিক টয়লেটে গেছি। তো বেরোবার সময় টাকা চাইতেই ২ টাকা দিতেই ব্যাটা তেরে আসল '' মগের মুল্লুক নাকি ২ জন ২ টাকা দেন? ''
বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললাম '' আমি এখানকার প্রতিদিনের কাষ্টমার তাই কম দিলাম, ডিসকাউন্ট রেট আর কি'' ব্যাটা থ হয়ে বসে রইল।
যাই হোক কোথা থেকে যেন কোথায় চলে গেলাম। এবার বর্তমান ট্রিপের কথায় ফিরে আসি। আমরা ভাবলাম আমাদের একটু গলা ভেজানো দরকার তো একটা পানশালায় ঢুকতেই ভিতরের দৃশ্য দেখে ফিরে আসলাম ওটা গে দের পানশালা লোকজন গিজগিজ করছে। আবার অনেক গে রা আগাগোরা মেয়েদের সুইমিং কস্টিউম পড়া। আমার দেখে ভয়ই লাগলো।
আমরা এখান থেকে কেটে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কিছুক্ষন পর পেটও জানান দিল খেতে হবে, জানলাম ওরও একই অবস্থা। কোথাও খাওয়া যায় ভাবতে ভাবতে ম্যাপে দেখলাম কাবাব ষ্ট্রীটের কথা। খুজেপেতে দেরী হলনা যেহেতু শহরটা খুবই ছোট। রাস্তার আগাগোড়া সব কাবাবের দোকান, বুঝলাম এমন নামের হেতু।
সময় ব্যায় না করে একটায় বসে পড়লাম। ওয়েটার বিশাল মেনু ধরিয়ে দিল। সিদ্ধান্তু নিতে পারলাম না কোনটা খাব, তাই কোনটার নাম কি তা দেখতে গিয়ে খাবি খেলাম। শেফ মুরগী হিসেবে যেটা দেখাল সেটাকে আমার মুরগী হিসেবে বিশ্বাস হলো না। ওটাকে খাসীর রান বললেই ভালো মানাত।
আমি রিস্ক নিলাম না হালাল খাব তাই বীফ্ এর অর্ডার দিলাম। ইতিমধ্যে মেগান বসে গেছে বীয়ার নিয়ে আমি একটা কোল্ড ড্রিন্কস্ বেছে নিলাম। আমি কখনো এলকোহল খাইনি শুনে বেশ অবাক হলো। এবং ইনিয়ে বিনিয়ে বলল আমার খেয়ে টেস্ট করা উচিত এখুনি। আমি আবার কোন মেয়ের সাথে প্রথম পরিচয়ে মাতাল হতে চাইনা।
তাই বীয়ার খাওয়া থেকে বিরত থাকলাম। আমার খাবারটা ভালো ছিল না, গরুর মাংস মনে হলো কাচাই দিয়ে দিয়েছে। আমি ওর কাছ থেকে শেয়ার করলাম। খাবার বিল আসতেই আমি বিল দিতে গেলে ও ওর বিল দিতে চাইল। আমি অবাক হলেও দুজনের বিল দিয়ে দিলাম।
এ বিষয়টা এখানেও লক্ষ্য করেছি এখানে পরিচিত দু জন একসাথে খেলে যার যার বিল সে সে দেয়। আর আমাদের দেশে এটাকে অপমানজনক হিসেবে দেখা হয়।
ঘড়ির কাটা জানান দিল রাত ১২.৩০ বাজে। বাড়ির মানে হোস্টেলর পথে রওনা হলাম। পায়ের ব্যাথা জানান দিল বেশ পরিমান হাটা হয়েছে।
রাস্তায় আসার পথে বেশ কিছু ইয়াং ছেলেদের মাঝথেকে একটা এসে টাকা চাইল। এসব ব্যাপারে আমি নির্ভীক ব্যাটাকে পাত্তা না দিয়ে সামনের দিকে হাটা দিলাম। ও অবশ্য একটু ভয় পেল বলে মনে হলো।
হাতমুখ ধুয়ে রুমে এসে দেখি নতুন কোন গেষ্ট নেই তার মানে '' হাম তুম এক কামরেমে বান্দ হো, ওর চাবি খো যায়ে'' অবস্থা। কালকের প্লান ঠিক করে শুয়ে পরলাম দুজনে দুই মেরুতে.....
এরপর কি হলো এটা না হয় আরেকদিনের জন্য তুলে রাখলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।