জন বেলামী ফস্টার তার “ধ্বংসের বাস্তুবিদ্যা” (The Ecology of Destruction, Monthly Review, February 2007) প্রবন্ধটিতে ব্যাখ্যা করেছেন মার্কস কেমন করে ‘বিপাকীয় ভেদ’ এবং ‘বিপাকীয় পুনর্ভরণ’ এই দুটি ধারণার মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীতে প্রকাশিত হয়ে পড়া পুঁজিবাদী সমাজের বাস্তুসংস্থানগত দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর ‘বিপাকীয় ভেদ’ ধারণার মাধ্যমে বোঝা যায় কেমন করে পুঁজির পুঞ্জিভবনের যুক্তিটি প্রাকৃতিক পুনরুৎপাদনের মৌলিক প্রক্রিয়াটিকে ধবংস করার মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্যকেই বিনষ্ট করে। তার উপর ‘সেই বিপাকের চারপাশের পরিপ্রেক্ষিতকে ধবংস করার মাধ্যমে’, মার্কস বলে চলেছেন, ‘এটি (পুঁজিবাদী উৎপাদন) পদ্ধতিগত পুনর্ভরণকে সামাজিক পুনরুৎপাদনের নিয়ন্ত্রিত নিয়মে পরিণত করে (অর্থাৎ বাঁধাগ্রস্ত করে)’ - যে পুনর্ভরণ আসলে একমাত্র পুঁজিবাদী কাঠামোর বাইরেই সম্ভব।
কিউবার কৃষি-বাস্তুবিদ্যার সাম্প্রতিক অগ্রগতি প্রত্যক্ষ উদাহরণের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে শুধুমাত্র কিছু পদ্ধতি নয় বরং এর সাথে সমন্বিত খাদ্য উৎপাদনের সামাজিক-বিপাকীয় সম্পর্কের ব্যাপক রূপান্তরের মাধ্যমে এ বিপাকীয় চ্যুতির পুনর্ভরণ সম্ভব। ইতোমধ্যেই অনেক পন্ডিত ব্যক্তি কিউবার জৈব-কৃষির সাফল্যের বৈজ্ঞানিক অর্জন নিয়ে আলোচনা করেছেন।
যদিও কিউবার জৈব-কৃষির এই সাফল্য এবং ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে এর সম্ভাবনাকে কেবল জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের আলোকে না দেখে দেখতে হবে কিউবার পুরো সমাজ ব্যাব¯থায় যে পরিবর্তন এসেছে তার আলোকে। রিচার্ড লেভিন যেমন বলেছেন: “কৃষি ক্ষেত্রে কিউবার অগ্রগতিকে বুঝতে হলে পুরো বিষয়টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে—– ঘাড় ঘুড়িয়ে একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে, আড়চোখে তাকিয়ে পুরো বিষয়টিকে বুঝতে হবে কেমন করে সত্যিকার অর্থেই মহৎ একটি পথ ধরে কিউবার সার্বিক উন্নয়ন এগিয়ে চলেছে….”
জমি হলো গুপ্তধন যার চাবি শ্রম
মার্কসের বিপাকের ধারণার মূল প্রোথিত আছে শ্রম-প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার যে ধারণা তার মাঝেই। শ্রম এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ, তার এবং প্রকৃতির মধ্যে বস্তুগত বিনিময় সাধন করে এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ভূমি অর্থাৎ মৃত্তিকা (এবং তার সাথে সম্পর্কিত প্রাকৃতিক চক্র) এবং শ্রম অর্থাৎ মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যকার বিপাকীয় সম্বন্ধ, এই দুইটি হল মানুষের সকল সম্পদের মূল উৎস। একদল কৃষি-গবেষকের সাথে গত বছরের কিউবা সফরের সময় আমি দেখি ঘোড়ার গাড়িতে করে একটি খামারের জৈব উৎপাদন নিকটস্থ কমিউনিটি স্ট্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
একটা হিমাগারের গায়ে দেখি লেখা আছে: “জমি হলো গুপ্তধন যার চাবি শ্রম”। একটি যৌথ খামারে জৈব ফসল উৎপাদন এবং নিকটস্থ কমিউনিটিতে তার সরবরাহের ব্যাপারটি কাছ থেকে দেখে আমার কাছে মনে হলো এটি যেন মার্কসের প্রাকৃতিক বিপাকের ধারণার দৈশ্যিক উপস্থাপনা। জমিকে গুপ্তধনের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে যেন সাময়িক লাভের জন্য তাকে নি:শেষিত করে ফেলা না হয়, বরং কৃষির বাস্তুগত নিয়মনীতির (কৃষি-বাস্তুবিদ্যা বা এগ্রি-ইকোলজি) যৌক্তিক এবং পরিকল্পিত প্রয়োগের মাধ্যমে একে সদা পুনরুজ্জীবিত রাখা হয়। আর গুপ্তধনের চাবির মতোই শ্রম মাটি থেকে তার শ্র্রেষ্ঠ উপাদান বের করে নিয়ে আসার মাধ্যমে উৎপাদন করে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য যা সমস্ত সম্প্রদায়ের নিকট সমান ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়।
মার্কসের কাছে বিপাক শব্দটির মানে দুরকম।
একটি হলো মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে যে জটিল আদান-প্রদান ঘটে, তাকে নিয়ন্ত্রণকারী একটি প্রক্রিয়া। দ্বিতীয়টি আরো বৃহত্তর অর্থে শ্রমবিভাজন ও সম্পদের বন্টনকে নিয়ন্ত্রণকারী প্রাতিষ্ঠানিক ধারণাকে বোঝায়। বিপাকীয় বিচ্যুতির বিশ্লেষণ এ দুটি দিককে নিয়েই। ইকোলজিক্যাল বা বাস্তুগত অর্থে, মার্কস লক্ষ্য করেন পুঁজিবাদী কৃষি আর “নিজে নিজে টিকে থাকার” অবস্থায় নেই যেহেতু এটি “আর নিজের মাঝে নিজের উৎপাদনের প্রাকৃতিক শর্ত খুঁজে পায় না”। বরং কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি এখন সুদূর বহির্বাণিজ্য ও কৃষির বাইরের পৃথক শিল্পক্ষেত্র থেকে সংগ্রহ করতে হয়।
এর ফলে জমির উর্বরতা ও বর্জ্য সঞ্চয়নের মধ্যকার প্রাকৃতিক চক্রে ফাটল ধরে।
বিপাকের বৃহত্তর সামাজিক অর্থের কথা ধরলে দেখা যায়, পুঁজি ও শ্রমের মধ্যকার বিশেষ সম্পর্কের কারণে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের মাঝে ফাটল দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পদে রূপান্তর, শারীরিক/মানসিক শ্রমের বিভাজন, গ্রাম ও শহরের মধ্যকার ব্যবধান ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক অর্থে বিপাকীয় চ্যুতি বা ফাটলকে বোঝা যেতে পারে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে কর্পোরেট ফাটকাবাজির প্রাধান্য, ‘দক্ষ’ টেকনিশিয়ানের জ্ঞানের কাছে ক্ষুদ্র কৃষকের স্বাধিকারের বিনাশ, গ্রাম্য খামার থেকে শহরের দিকে জনসংখ্যার স্থানান্তর ইত্যাদি বিভিন্ন ভাবেই এই ফাটল বাস্তবায়িত হয়।
‘এটি সুন্দর কাজ’
আমার সৌভাগ্য যে কিউবায় জৈবখামারগুলোতে কাজ করে এমন অনেক কৃষকের সাথে আমি কথা বলতে পেরেছি।
আমার কাঁচা স্প্যানিশের কারণে বেশী সূক্ষ আলোচনায় যেতে না পারাটা আমাকে হতাশ করলেও কৃষকদেরকে মৌলিক একটি প্রশ্ন আমি ঠিকই করতে পেরেছি। আমাকে শহুরে কৃষিজমির কাজ দেখাচ্ছিল এরকম একজন কৃষককে প্রশ্ন করেছি : “তোমার কি এই কৃষিকাজ ভালো লাগে?”
কৃষক দ্বিধাহীন ভাবে বলল: “এটি সুন্দর কাজ”।
আরো অনুবাদ এবং কিউবার চারটি প্রদেশের কৃষিকাজ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বুঝেছি খাদ্য উৎপাদনের রূপান্তরের বাস্তব ফলাফল কি; বিশ্ব কৃষিবাণিজ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য ছাড়াই এখানে পুষ্টিকর খাদ্যশক্তি পাওয়া যায়।
কিউবার এই কৃষি মডেল প্রাকৃতিক পুষ্টিচক্রকে পুনর্সংযুক্ত করে, গ্রামের মানুষের শ্রমের সাথে শহুরে উৎপাদনশীল শ্রমের বন্ধন তৈরি করে। সামাজিক-বিপাকীয় সম্পর্কের রূপান্তরের ফলে জীববৈচিত্র্যকে ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছে, যেমন : উপকারী কীটপতঙ্গের ব্যবহার।
মালিকানা এবং বিতরণের নতুন ধরনের ফলে চাষাবাদ, ফসল তোলা ও ভোগ- সব ক্ষেত্রেই অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। নতুন ধরনের শ্রম-সম্পর্ক তৈরী করা হয়েছে যার ফলে আদিবাসী কৃষক একজন প্রশিক্ষিত এগ্রোনোমিস্ট এর সাথে মিলেমিশে পরিবেশ, ভূগোল ও আবহাওয়ার সাথে ফসলকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। আর “ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কিউবা ছাড়া আর কোথাও এটি সম্ভব নয়”- সন্দেহবাদীদের এই ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে কৃষকরা ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দেশগুলোতে চাষাবাদের এই পদ্ধতিটিকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করছেন।
“জৈবিক চাষাবাদ পদ্ধতির উন্নয়নের” জন্য কিউবাকে বিকল্প নোবেল পুরষ্কার দিয়েছে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এই সাফল্যের পেছনে নতুন পদ্ধতির আবিষ্কারের অবদান অবশ্যই আছে, তবে তা আংশিক; বাকিটা হলো নতুন তথ্যকে স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োগের জন্য ছড়িয়ে দেয়ার সাফল্য।
Entomophages and Entomopathogens (CREEs) উৎপাদনের জন্য রয়েছে ২৮০টি সফল গবেষণাগার, যেগুলো ক্ষতিকর পতঙ্গকে আক্রমণকারী উপকারী পতঙ্গ উৎপাদনের মাধ্যমে জৈবপ্রক্রিয়ায় পতঙ্গ দমনকে সম্ভব করে তুলেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় করা গবেষণার মাধ্যমে প্রাকৃতিক প্রতিষেধক ও জৈব সারের উৎপাদন প্রচলিত কৃষির বাইরে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যদিও বিপাকীয় বিচ্যুতির পুনর্ভরণ শুধু এটিকেই কেন্দ্র করে ঘটেছে, বিষয়টি তা নয়। বাস্তুসংস্থানের সাথে সম্পর্কিত করে বিপাকীয় চ্যুতির পুনর্ভরণকে বুঝতে হলে প্রথমে প্রাকৃতিক পুষ্টিচক্রের স্থানিক পুনর্বিন্যাসকে বোঝা দরকার। বিপাকীয় চ্যুতির বাস্তুগত বোঝাপড়ার মূল বিষয়টি হলো পুষ্টিচক্রকে নিয়ন্ত্রণকারী ভৌত প্রক্রিয়াগুলোর স্থানিক সম্পর্ক (spatial relations)। ভূমি থেকে মানুষের পৃথকীকরণ (গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর) প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যকার বিপাকীয় সম্পর্কের মাঝে ফাটল তৈরী করেছে ।
কেননা উৎপাদনশীল শস্য ও খামার থেকে পণ্যের সাথে সাথে পুষ্টি উপাদনগুলোও দূরে চলে যায় এবং অবশেষে দূরের কোন শহরের আবর্জনায় পরিণত হয়। পুষ্টিশূন্য মাটির জৈবকাঠামো পুনরুদ্ধারের জন্য পুঁজিবাদী কৃষি প্রক্রিয়ায় তখন দূর থেকে আমদানীকৃত শিল্প উৎপাদন (যেমন : ইউরিয়ার মতো নাইট্রোজেন সার) মাটিতে নিয়মিত প্রয়োগ করতে হয়। এর ফলে প্রাকৃতিক পুষ্টিচক্র নষ্ট হয় এবং প্রকৃতিতে নতুন এক বাস্তুগত দ্বন্দ্বের সূচনা করে যার একদিকে শহরের স্যুয়ারেজ সিস্টেমে পুষ্টি উপাদানের সঞ্চয়ন অন্যদিকে শহর থেকে রাসায়নিক সার দূর গ্রামে রপ্তানীর জন্য জ্বালানীর ব্যবহার। একইভাবে কৃষিকাজে ব্যবহ্রত গবাদিপশুকে তার খাদ্য উৎপাদনকারী জমি থেকে সরিয়ে নেয়ার ফলে খাদ্যশস্য/গবাদিপশু এবং গবাদিপশুর গোবর/খাদ্যশস্যের মধ্যকার বস্তুগত বিনিময় বাধাগ্রস্ত হয় এবং বিপাকীয় বিচ্যুতি ঘটে।
১৯৯৫ সাল থেকে কিউবার কৃষিঅর্থনীতিতে পুষ্টিচক্র ও বস্তুগত বিনিময়ের এই ভেঙ্গে পড়া সম্পর্ককে পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে।
কিউবার কৃষি-বাস্তুবিদ্যার মূলনীতি হলো : “স্থানীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং চারাগাছ-পশুর সমন্বয়ের মাধ্যদিয়ে আন্ত:খামার সিনার্জি”। কিউবা ভ্রমণের সময় আমি দেখেছি কিভাবে এ নীতিতে চাষাবাদের ফলে নিকটবর্তী খামার কিংবা আন্ত:খামার সমন্বয়ের মাধ্যমে পুষ্টিচক্রের পুনরুদ্ধার হচ্ছে।
(চলবে........)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।