আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন'



[আবার জীবনানন্দ, আবার কবিতা। এবার 'বনলতা সেন'। এই কবির হাত থেকে আমার মুক্তি নেই!] কবিতা কি ব্যাখার মতো বিষয়, নাকি অনুভবের? ব্যাখ্যায় কি কবিতা হারিয়ে যায় না, নাকি সহায়তা করে বুঝে ওঠার জন্য? এইসব প্রশ্ন প্রায়ই মনে জাগে, আর কেবলি মনে হয় - এটি ব্যাখ্যাযোগ্য কোনো বিষয় নয়! তবে পাঠক নিজের মতো করে একটা ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই দাঁড় করায়, নিজের মতো করে গ্রহণ করে একটা কবিতাকে। আর সেটিই কবিতার শক্তি। একটা কবিতা একেকজন পাঠকের কাছে একেক মাত্রায় ধরা দেয়।

ব্যক্তিভেদে একটা কবিতার ব্যাখ্যা পাল্টে যায়, হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক। এদিক থেকে দেখতে গেলে কবিতার ব্যাখ্যা একইসঙ্গে বিপদজনক এবং আনন্দদায়ক। বিপদজনক, কারণ - যে কেউ বলতে পারেন, এই ব্যাখ্যা ঠিক নয়, ব্যাখ্যাটা আসলে এইরকম। তিনি ভুল বলেন না, কারণ তার কাছে কবিতাটি ওভাবেই ধরা দিয়েছে। অন্যদিকে আননন্দদায়ক, কারণ এই তর্ক-বিতর্কে একটা কবিতার বহুমাত্রিক রূপটিও ধরা পড়ে।

এই লেখায় আমি জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন' সম্বন্ধে নিজের অনুভুতির কথা বলার চেষ্টা করবো। কবিতার শুরুটা এরকম : 'হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন। ' হাজার বছর ধরে আসলে কে পথ হাঁটে? এটাকে কি আক্ষরিক বলে ধরে নেব আমরা? সেক্ষেত্রে তো প্রশ্ন জাগেই - একজন মানুষ 'হাজার বছর ধরে' পথ হাঁটে কীভাবে? সেটি যেহেতু সম্ভব নয়, তাই কথাটিকে আক্ষরিক বলে ধরে নেবারও সুযোগ নেই। তাহলে কি দীর্ঘ ভ্রমণের ইমেজ আনার জন্য কথাগুলো বলা হয়েছে? হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা, বা সমুদ্রে ঘোরা, বা সুদূর অতীতে বাস করার এই ভাষ্যগুলো কি নিছক একজন পথিকের পথচলার বিবরণ আর পথচলাজনিত কারণে তৈরি হওয়া ক্লান্তির অনুভূতি পাঠকের মনে ছড়িয়ে দেবার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে? নাকি অন্য কোনো মানে আছে এর? আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা নিছক একজনমাত্র পথিকের পথচলার বিবরণ নয়। বরং হাজার বছর ধরে যারা এই পথে হেঁটে গেছে, যারা সাগর-সমুদ্রে ঘুরে বেড়িয়েছে, এমনকি 'বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে' যারা ছিলো বা ছিলো 'আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে' - এই বর্ণনাটি তাদের সবার।

আর এই সব মানুষই দীর্ঘপথ পেরিয়ে যখন ক্লান্তপ্রাণ হয়ে গেছে, যখন তাদের 'চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন' তখন তাদেরকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছে 'বনলতা সেন'। এখানে পথিক যেমন কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়, 'বনলতা সেন'ও তেমনই নির্দিষ্ট কেউ নয়। এটি কেবলই একটি নাম, যেটি বহন করছে ক্লান্ত মানুষের মোহন আশ্রয়ের প্রতীক। এইভাবে দেখলে আমার সুবিধা হয়, নিজেকেও ওই হাজার বছর ধরে পথচলা পথিকদের একজন বলে ধরে নিতে পারি। ভাবতে পারি, আমারও একজন 'বনলতা সেন' থাকলে চমৎকার হতো, আমার সমস্ত ক্লান্তি, সকল বেদনা ও হাহাকার আমি তাকেই সমর্পণ করে দুদণ্ড শান্তি পেতাম! কিন্তু এইরকম ধরে নিয়ে পরের প্যারায় গিয়ে 'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য ; ... পঙক্তি দুটো পড়লে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে- মুখটি কি শ্রাবস্তীর কারুকার্য হওয়া বা চুলগুলো 'অন্ধকার বিদিশার নিশা' হওয়া কি আবশ্যক? না হলে ক্ষতি কি? না, আশ্যক নয় মোটেই, না হলেও ক্ষতি নেই কোনো, আপনার 'বনলতা সেন' আপনার মনের মতো হলেই হলো! কিন্তু এই প্রশ্নও হারিয়ে যাবে পরের পঙক্তিগুলো পড়লে- '...অতি দূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর..' কী অসাধারণ চিত্রকল্প! 'অতিদূর সমুদ্রের পর' হাল ভেঙে যে নাবিক 'দিশা' হারিয়েছে, তার তো অনিশ্চয়তার শেষ নেই।

সে তখন আছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে - সে কী কোনোদিন ফিরতে পারবে মানুষের পৃথিবীতে, নাকি ওই সমুদ্রেই শেষ হয়ে যাবে তার জীবন - এরকম একটা দোলাচলে। আর তখন যদি হঠাৎ চোখে পড়ে - 'সবুজ ঘাসের দেশ .. দারুচিনি দ্বীপের ভিতর' - কেমন লাগবে তার? জীবন ফিরে পাবার আনন্দ, বেঁচে থাকার আনন্দ কী অসামান্য হয়ে উঠবে না তার কাছে? এরকম একটি ভয়াবহ চিত্রকল্প তৈরি করে, তারপর বলা হচ্ছে - 'তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে ; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?' পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। ' মানে- বনলতা এমনই একজন, যে জীবন ফিরে পাবার আনন্দ দেয়! অবশ্য 'পাখির নীড়ের মতো চোখ' নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে কারো কারো। অসুবিধা নেই, আগেই বলেছি, আপনার বনলতা আপনার মনের মতো হলেই হলো। তারচেয়ে বড়ো কথা, এটাকে আক্ষরিকভাবে নেয়ারও কোনো দরকার নেই।

'পাখির নীড়' হয়তো আশ্রয়েরই প্রতীক। এই কবিতার সবচেয়ে রহস্যময় কথাগুলো আছে শেষ প্যারায়। 'সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে' শিশিরের শব্দ? কেমন সেটা? বোঝা যায়, নাকি বোঝানো যায়? নাকি কেবলই অনুভব করে নিতে হয়? 'ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল' রৌদ্রের গন্ধ? সেটা কিরকম? নিজেই কি বুঝলাম কিছু, যে বোঝাবো অন্য কাউকে? 'পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জেনাকীর রঙে ঝিলমিল' এটা মোটামুটি বোঝা গেল। পৃথিবীর সব রঙ মুছে গিয়ে জীবন এখন বর্ণহীন, সাদাকালো। পাণ্ডুলিপির আয়োজন শেষ, তখন সবই 'গল্প' হয়ে গেছে।

একদিন তো সবকিছুই 'গল্প' হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত! এই পঙক্তি দুটোকে আরো বেশি সাপোর্ট দেয় শেষের দুই পঙক্তি - 'সব পাখী ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ-জীবনের সব লেন দেন ; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। ' জীবনের সব লেনদেন ফুরিয়ে গেছে, আর কিছু নেই কোথাও। আছে শুধু অন্ধকার, আর এই বিপুল অন্ধকারের মধ্যে মায়াময় আলোর মতো বনলতা সেন! আহা, আমাদের সবার জীবনে যদি অমন একজন করে 'বনলতা সেন' থাকতো! [কৃতজ্ঞতা : প্রিয় ব্লগার একরামুল হক শামীম। এই কবিতাটিও আমি তার লেখা থেকে তাকে না বলেই ধার নিয়েছি!]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.