অতএব- লক্ষন যা, তাতে দুঃখ আর ক্ষোভই আমার কপালের লেখা।
আজ জেলহত্যা দিবস। একটা রাষ্ট্র কতটা দায়িত্বহীন ( কিংবা অসৎ ) হতে পারে তার উদাহরণ এই হত্যাকান্ড। রাষ্ট্রের কারাগারে নিহত হন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা! যেহেতু তারা রাজনৈতিক নেতা ছিলেন সুতরাং হত্যাকান্ডটিও রাজনৈতিক, সন্দেহ নেই। কিন্তু আইনে 'রাজনৈতিক হত্যাকান্ড' বলে কোন অপরাধ নেই।
নৈতিক জায়গার বাইরে গিয়ে জেলহত্যাকে আইনের চোখেই কেবল গুরুত্বপুর্ন ভাবা হয়ে আসছে। সবাই শুধু এর ''বিচার''ই চান। কোন 'রাজনীতি' এই নেতাদের ঘাতক হলো সে প্রশ্ন আসে পরে, তাই দেখছি।
আমিও এখানে বলছি আইনী প্রকৃয়ার কথা।
হত্যাকান্ড ঘটে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর।
পরদিন ৪ নভেম্বর , ১৯৭৫ পুলিশের ডিআইজি প্রিজন মো. আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন ক্যাপ্টেন মোসলেম উদ্দিনসহ চারজনের বিরুদ্ধে । মামলা দায়েরের পরদিন অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর লালবাগ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ওসি এবিএম ফজলুল করিম মামলার তদন্তভার নেন । সে বছরই ২১ নভেম্বর মামলার তদন্তভার দেয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের হাতে। ডিএসপি সাইফুদ্দিন আহমদ এর কাছে ।
কিন্তু একই সময়ে গঠন করা হয় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি।
সুপ্রিমকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে। সুতরাং ডিএসপি পুলিশের হয়ে আর তদন্ত করতে পারেননি। পরের বছর (১৯৭৬ সালে ) তদন্তের অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি। এবং ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৬ সাল ২৩ টি বছর মামলা নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের তরফ থেকে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
আর কোনো তদন্ত হয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এলে রাষ্ট্রের তরফ থেকে মামলাটি নিয়ে আবার সক্রিয়তা শুরু হয়। কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক হোসেন, লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মেজর (অব.) মো. খায়রুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্ত শেষ করে ১৫ অক্টোবর, ১৯৯৮ তারিখে চার্জশীট দেয়া হয়।
৬ বছর ধরে চলে মামলার বিচারকাজ।
নিম্ন আদালতে
বিচার শেষে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান এ মামলার রায় দেন। রায়ে আদালত রিসালদার মোসলেমউদ্দিন খান, দফাদার মারফত আলী ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধাকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। এছাড়া ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ দেয়া হয়। হত্যাকান্ডের প্রধান অভিযুক্ত মৃত কে এম ওবায়দুর রহমান (নিম্ন আদালতের রায়ের সময় জীবিত ছিলেন) , নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, জাতীয় পার্টির নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মেজর (অব.) খায়রুজ্জামান এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে খালাস দেয়া হয়। ষড়যন্ত্রের কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় মামলায় আসামিদের সবাইকে ফৌজদারি কার্যবিধি ১২০(খ) ধারায় ষড়যন্ত্রের অভিযোগ হতে অব্যাহতি দেয়া হয়।
রায়ের পরপরই দন্ডাদেশপ্রাপ্তরা আপিল করে। ল্যান্সার মহিউদ্দিনকে গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানোর পর তিনি জেল আপিল করেন।
হাইকোর্ট বিভাগে
অবশেষে এ বছরের ২৮ আগস্ট এ মামলায় বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আতাউর রহমান খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ ২৮ আগস্ট রায় ঘোষণা করেন। খালাস দেয়া হয় নিম্ন আদালতের রায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি দফাদার মারফত আলী ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধাকে। কেবল পলাতক আসামি রিসালদার মোসলেমউদ্দিন খানের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়।
অন্যদিকে নিম্ন আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন দন্ডাদেশপ্রাপ্ত ৪ আসামি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, অবসরপ্রাপ্ত মেজর বজলুল হুদা ও মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকেও খালাস দিয়ে অব্যাহতি দেয়া হয়।
আপিল বিভাগে কবে যাবে?
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল জানিয়েছেন, হাইকোর্ট বিভাগ আদেশ দেয়ার পরদিনই এ আদেশের কপির জন্য আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এই কপি না পাওয়ায় আপিল করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। হাইকোর্টের আদেশের কপি কবে পাবেন তাও জানেন না বলে জানিয়েছেন তিনি। সুতরাং চুড়ান্ত ফায়সালার জন্য আপিল বিভাগে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্যে মনে হচ্ছে হয়তো আবারো চাপা পড়তে যাচ্ছে মামলাটির অগ্রগতি।
আমাদের কথা
একজনের ফাঁসি ও আটজনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড বহাল রেখে আদালত মন্তব্য করেছিলেন, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা আপিল করলে তারাও হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের মতো সুবিধা পেতেন। হাইকোর্টের কাছে একজনকেই দোষী বলে মনে হয়েছে। কোর্টের মতে বাকিরা এ হত্যাকান্ড বা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। আমাদের প্রশ্ন- যদি বাকি আসামিরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকেন তবে এতো সংগঠিত একটি অপরাধ কিভাবে হলো? একজন আসামি জেলখানার মধ্যে গিয়ে কীভাবে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করলেন।
জেলখানার ভেতরে তো নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা ছিলেন। তবে কি মামলা চলাকালে এসব প্রশ্ন রাষ্ট্রপক্ষ উত্থাপন করেননি?
এই দেশের বিচার ব্যবস্থায় মাননীয় বিচারকরা 'অ্যাডভাইজরিয়াল' ভূমিকা রাখতে বাধ্য। তারা রায় দেন দু'পক্ষের যুক্তি-তর্ক-প্রমানের ওপর ভিত্তি করে। নিজের 'ইনকিউজিটিরিয়াল' হতে পারেন আইনগত কারনেই। আর এ সুযোগে রাষ্ট্রপক্ষ দায়সারাভাবে মামলা চালায়, ভাবখানা এমন যে মামলায় জিতলে তো কারা অপরাধী তা প্রকাশ হয়ে যাবে! তাই রাষ্ট্রপক্ষ মামলায় জিততে চাননা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।