আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তরুণী আইনজীবীকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা ::দৈনিক সমকাল থেকে::

যোদ্ধা হতে চেয়েছি...

রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় মধ্যযুগীয় কায়দায় এক তরুণী আইনজীবীকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে আমিন মিয়া নামে মাদকাসক্ত এক যুবক। ঘাতক পরে আইনজীবীর মস্তক ও রক্তাক্ত দা নিয়ে রাস্তয় উল্লাস করে। চুল ধরে ছিন্ন মস্তক হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছে রাস্তায়। খণ্ডিত অংশ থেকে রক্ত ঝরে ভিজেছে রাজপথ। সেগুনবাগিচার তোপখানা রোডের ২৬/এ নম্বর মঞ্জিল নামের বাড়ির তৃতীয় তলায় গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে এমন নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন উদীয়মান আইনজীবী নাসরিন আক্তার তুলি (২২)।

ঘাতকের দায়ের কোপে আরো তিনজন আহত হয়েছেন। তারা হলেন: আমিনের মা রোকেয়া বেগম (৫৫), রিকশাচালক হানিফ (৪৫) ও বস্তিবাসী নুরজাহান ওরফে পাগলী (৫০)। তুলি ঘাতকের বাড়িতে সাবলেট থাকতেন। মস্তক হাতে নিয়ে আমিন রাস্তায় আসার পর আতগ্ধক ছড়িয়ে পড়ে। বীভৎস দৃশ্য দেখে চোখ বন্ধ করে অনেকে।

দায়ের ভয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়নি কেউ। যারাই সাহস করে আমিনকে ধরার জন্য এগিয়েছে, তাদের দিকেই দা নিয়ে তেড়ে গেছে সে। অবশেষে তাকে রুখতে শতাধিক মানুষ লাঠিসোটা, ইটের টুকরো নিক্ষেপ করতে থাকে তার দিকে। একই সময় পুলিশও পৌঁছে ঘটনাস্থলে। একপর্যায়ে মাথায় ইটের আঘাত পেয়ে রাস্তায় পড়ে যায় আমিন।

আর তখনই তাকে ধরে ফেলে পুলিশ। খবর পেয়ে গতকাল দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নিহত তুলির ভাই ও স্বজনরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে আসেন। তাদের কান্নায় মর্গে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। যেভাবে ঘটনা : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গতকাল সকাল ৭টার খানিক পরে সেগুনবাগিচা এলাকার আফতাব পোলট্রি ফার্মের কাছে এক ডাব বিত্রেক্রতাকে মারধর করে তার কাছ থেকে ধারালো দা নিয়ে দৌড়ে বাসার দিকে যায় আমিন। বাসা থেকে কিছুদূর থাকতেই তার মা তিন তলার বারান্দা থেকে দেখতে পান আমিন দা নিয়ে বাসার দিকে আসছে।

এ সময় তিনি ও ওই বাড়ির বাসিন্দা রিকশাচালক কাদির মিয়া নিচে নেমে আসেন। তারা তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু জোর করে আমিন তিন তলায় চলে যায়। ওই সময় আমিনের মা চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘সবাই দরজা বন্ধ করে দাও, আমিনের মাথায় খুন চড়েছে। ’ এ কথা শুনে নিচ তলা থেকে চার তলা পর্যন্ত অনেকে রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।

আমিনের বোন ফাতেমা ও সীমাও রুম থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান। আমিন তিন তলায় উঠে তার স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তার কুলসুমকে মারার জন্য তাড়া করে। আর তখন একটি কক্ষে ঢুকে তিনি দরজা বন্ধ করে দেন। এ সময় তার মাকে কোপ দেয় আমিন। তার মায়ের আঙুল কেটে যায়।

মা একটি কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে জীবন রক্ষা করেন। এ সময় রিকশাচালক হানিফ বাধা দিতে এলে উম্মত্ত আমিন তার হাতেও কোপ দেয়। ভয়ে হানিফ দৌড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। ওই সময় তুলি তার কক্ষে বসে নাশতা করছিলেন। তার ঘরে গিয়ে আমিন তার চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁছড়ে সিঁড়ির মাথায় ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়েই গলায় কোপাতে থাকে।

একপর্যায়ে দায়ের কোপে দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিল্পু হয়ে পড়ে তুলির। খণ্ডিত মস্তক হাতে নিয়ে নিচ তলার দিকে যায় আমিন। ওই সময় সেখানে আসেন পাগলী বলে পরিচিত পাশের বস্তির নুরজাহান। আমিন তার হাতেও কোপ দেয়। নুরজাহান চিৎকার করে দৌড়ে পালিয়ে যান।

আমিন খণ্ডিত মস্তক হাতে নিয়ে বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গা ও গেট পেরিয়ে রাস্তায় যায়। পথচারীরা এ দৃশ্য দেখে ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। যে-ই সাহস করে আমিনের দিকে এগোতে চেষ্টা করে, তাকেই দায়ের ভয় দেখায় সে। পাশের বাড়ির বিল্লাল হোসেন জানান, আমিন রাস্তার ওপর খণ্ডিত মাথা রেখে তুলির কান ও নাকে দা দিয়ে কোপাতে থাকে। আর বলতে থাকে, আমার স্ত্রীকে খুন করেছি।

একপর্যায়ে শতাধিক মানুষ একত্র হয়ে লাঠিসোটা নিয়ে তাকে ধরতে যায়। এ সময় আমিন ছিন্ন মস্তক রাস্তায় ফেলে রেখে পল্টন মোড়ের দিকে দৌড়াতে থাকে। কিছুদহৃর যাওয়ার পরই তাকে জনতা ও পুলিশ ধরে ফেলে। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় রক্তাক্ত দা। পরে আহত আমিনকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য শাহবাগ থানা পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। হত্যাকারী জানিয়েছে, তার স্ত্রীকে হত্যা করতে গিয়ে সে তুলিকে হত্যা করেছে। অন্য একটি সূত্র জানায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় ইয়াসমিন আক্তার আমিনকে তালাক দেওয়ার চিন্তা করছিলেন। আর ইয়াসমিন আক্তার এ বিষয়টির আইনি দিক খতিয়ে দেখার জন্য বলেছিলেন তুলিকে। তুলি সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শও করেছিলেন।

তা জানতে পেরেই আমিন তাকে হত্যা করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় চিকিৎসাধীন আমিন গতকাল দুপুরে সমকালকে জানায়, সে ২০০০ সালে সৌদি আরবে চাকরি করতে যায়। গত বছর দেশে ফেরে। গত বছরই বিয়ে করে তাদের এলাকার মেয়ে ইয়াসমিন আক্তারকে। বিয়ের পর সে সেগুনবাগিচা এলাকার একটি প্রতিষ্ঠানে তিন মাস কাজ করে।

এরপর থেকে বেকার। বিয়ের পর থেকে ইয়াসমিন আক্তার বেশ ভালোই ছিলেন। ৪-৫ দিন আগে থেকে তিনি বদলে যান। জাদুটোনা দিয়ে তাকে পাগল বানিয়ে ফেলেন। আমিন বলে, তার স্ত্রী জাদুটোনা করে রূপ বদলাতে পারে।

নিজেকে আড়াল করতে অন্যের চেহারায় রূপ নিতে পারত। এ কারণে সে দু’দিন বাসায় ছিল না। রাস্তায় থেকেছে। এ কারণে সে তার স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করে। গতকাল সকালে সে বাসায় ঢুকে দা দিয়ে স্ত্রীকে খুন করতে যায়।

কিন্তু স্ত্রী আইনজীবী তুলির রূপ ধারণ করে ফেলে। আর তখনই সে তুলিকে স্ত্রী ভেবে খুন করে। বাড়ির চিত্র : সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির পেছনের দিকে সরু গলিতে তোপখানা রোডের ২৬/এ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় গতকাল সকালে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির বাসিন্দারা কেউই বাড়িতে নেই। তৃতীয় তলার দুটি কক্ষের দরজা খোলা। অন্য দুটি কক্ষে তালা ঝুলছে।

সিঁড়ির ওপরের খালি জায়গায় ও পাশের ফ্ল্যাটের মহৃল দরজায় রক্ত লেগে আছে। ফ্লোরে পরে থাকা জমাটবাঁধা রক্তে পরে আছে একটি কবজ। খবর জানতে পেরে শত শত উৎসুক মানুষ বাড়িটি দেখতে আসে। বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটের লোকজন ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। ওই বাড়ির বাসিন্দারা জানান, আমিনদের বাসায় চারটি ঘরের মধ্যে দুটি ঘর সাবলেট ভাড়া দেওয়া।

এর মধ্যে একটি বড় ঘরে ১০-১২ জন দিনমজুর থাকে। পাশের একটি কক্ষে আমিনের দুই বোনের সঙ্গে থাকতেন তুলি। বাসিন্দারা জানান, আমিন বেশ কিছুদিন ধরে মাদকাসক্ত। এ নিয়ে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে তার প্রায়ই ঝগড়া হতো। তার স্ত্রী এতদিন বাবার বাড়ি ছিলেন।

১৫-২০ দিন আগে তাকে বাসায় নিয়ে আসে আমিন। ৭-৮ দিন আগে থেকে প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া হতো। দু’দিন তার মা ও স্ত্রীকে দা নিয়ে কোপাতেও যায় আমিন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কুট্রাপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা রফিজ উদ্দিনের একমাত্র মেয়ে নাসরিন আক্তার তুলি। তিনি ১৯৯৭ সালে সরাইল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ভালো ফল নিয়ে এসএসসি পাস করেন।

এরপর সরাইল ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৯৯৯ সালে এইচএসসি ও ২০০২ সালে ডিগ্রি পাস করে ঢাকায় আসেন। ঢাকার মহাখালীতে তার ফুপা আবু সাঈদের বাসায় ওঠেন। আইন পড়তে ভর্তি হন ক্যাপিটাল ল’ কলেজে। সেখান থেকে ল’ পাস করার পর তিনি এক সিনিয়র আইনজীবীর সহকারী হিসেবে জজকোর্টে প্র্যাকটিস করছিলেন বলে তার ফুপাতো ভাই আবু তাহের সমকালকে জানান। মহাখালী থেকে জজকোর্ট দূর হয়ে যাওয়ার কারনে তিনি তোপখানা রোডের ২৬/এ নম্বর বাড়িতে দু’মাস আগে থেকে সাবলেটে ভাড়া থাকেন।

প্রতি মাসে ১ হাজার ৫০০ টাকা খাওয়া ও থাকার খরচ দিতেন তিনি। পাপ্টপ্পু, দীপন ও আপন নামের তিন ভাইয়ের তুলিই ছিলেন একমাত্র বোন। তিনি সবার বড়। তার ছোট ভাইয়েরা পড়াশোনা করছে। তুলির আশা ছিল, একসময় তিনি বড় আইনজীবী হয়ে পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটাবেন।

আসুন আমরা তার আত্মার মাগিফরাত কামনা করি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।