আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুকুলের জন্য শোক / মাহবুব হাসান



লেখক মুহম্মদ জুবায়ের এর ডাকনাম ছিল মুকুল। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন কবি মাহবুব হাসান মুকুলের জন্য শোক / মাহবুব হাসান ======================= ঘুমের ভেতর টেলিফোন বাজছে। সেলফোন। তাকিয়ে দেখি ফিরোজ সারোয়ারের ফোন। সরো কেন এত সকালে? সেহরি খেয়ে ভোরের নামাজ পড়ে শুয়েছিলাম।

ঘুমটা গাঢ়ই ছিল বোধহয়। সকাল পৌনে ৯টায় ওকে রিং করলাম। কিরেঃ। আমার গলা ভারি, ঘুমঘোরে। সরো বলল, বাবা-মায়ের মৃত্যু শোক পাইনি।

বন্ধুদের মৃত্যুশোকে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। জুবায়ের আর নেই! জুবায়ের আর নেই, মাত্র তিনটি শব্দ ঝাঁকালো আমাকে। বুক থেকে কান্নারা ধেয়ে আসছে সিডরের বেগে। আমি শুধু বলতে পারলাম, বলিস কি? সরো কান্নায় ভাঙতে ভাঙতে বলল দিদার এইমাত্র জানাল। ঘণ্টাদুয়েক আগেঃ।

আমি আর কোন কথা উচ্চারণ করতে পারলাম না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সেলফোন নিয়ে। মুহাম্মদ জুবায়ের, আমার বন্ধু, গল্পকার, ঔপন্যাসিক আর সার্ত্রের ইন্টিমেট-এর অনুবাদক। মৃত্যু তাকে খুবলে খেলো সুদূর ডালাসে। সেই শহরে চলে গিয়েছিল মুকুল বাংলা ভূমি ছেড়ে কর্মসংস্থানে।

সেখানে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে জুবায়ের, আমাদের মুকুল কয়েক বছর সিঙ্গাপুরে ছিল। সেই দিনগুলোতে একবার ঢাকায় দেখা হয়েছিল আমাদের। দেখা হোক বা না হোক, মুকুল সব সময় ছিল আমাদের সঙ্গে। ফোনে, ই-মেইলে প্রায় নিয়মিত কথা হতো। ওর এবং আমাদের বন্ধু অতিরিক্ত আইজি নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা একদিন বলল জুবায়ের ফিরে আসতে চায়।

দেশে এসে কি করবে? আমি হাসতে হাসতে বললাম, পুলিশে ঢুকিয়ে দাও। আমার সঙ্গে সোহরাব হাসানও ছিল, বলল কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েঃ। কিশোর বলল কি যে বলো না! ওকে দিয়ে হবে না। কিশোর ঠিকই বলল ওকে দিয়ে হবে না। খুব মুডি মানুষ মুকুল।

জেদিও। ইত্তেফাকে কাজ করেছিল জুবায়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ার সময়ই। পরে স্টাফ রিপোর্টারও হয়েছিল বোধহয়। কিন্তু কাজটি বেশিদিন করেনি মুকুল। কাজ নিয়েছিল নান্দনিক অ্যাডফার্মে।

‘নান্দনিক’ কবি ফজল শাহাবুদ্দীন আর শরফুদ্দীন আহমদের যৌথ ক্রিয়েশন। আমরা নিয়মিতই আড্ডা মারতে যেতাম নান্দনিকের নর্থ-সাউথ রোডের অফিসে। ওখানে কাজ করতে করতেই শাহীন ভাবীর সঙ্গে ওর ফোনে পরিচয় আর ভাব জন্মে। পরিণয়ের মাধ্যমে প্রেম পর্বটি শেষ হয়। একবার আমাকে বললেন, মাহবুব আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দেন।

হেসে বলি কেমন করে। ম্যানেজ করেন। ও তখন বাইক চালায় দুরন্ত গতিতে। ওর বাইকে টাঙ্গাইলে গেলাম, বাসায়। ম্যানেজ করলাম পাঁচ হাজার টাকা।

ফার্মগেটে ওভারব্রিজের পশ্চিমদিকে কয়েকটি দোকানের ছোট একটি সে ভাড়া নিল। আমরা দল বেঁধে যাই ওর কারবারের জায়গায়। বার্গার-টার্গার আর কোমল পানীয় বিক্রি করছেন ক্রেতাদের হাসিমুখে। আমাদেরও খাওয়াচ্ছেন অকাতরে। খাওয়ার কথা যখন উঠল, তাহলে আরও কিছু সত্য লিখি।

সেই জীবনালেখ্য অনুভবযোগ্য করে তুলতে পারব না হয়তো, একটা রেখাচিত্র দিতে পারব মাত্র। ছাত্রাবস্থায় অর্থকষ্টে কেটেছে আমার। পকেটে পয়সা না থাকলে খালি পেটে থাকতে হতো। সেই তিয়াত্তর, চুয়াত্তর, পঁচাত্তর, ছিয়াত্তর, সালের কঠিন দিনগুলোতে আমাকে খাইয়েছে অকাতরে বেশ কয়েক বন্ধু, মুকুল তাদের একজন। বাবা ছেলেকে টাকা পাঠাতেন নিয়মিত।

সরোর ভাইয়েরা ওকে টাকা, না হলে চাল পাঠায়। কতদিন যে সরোর জহুরুল হক হলের রুমে রান্না করে খেয়েছি আমরা। কত রাত যে আমরা আড্ডা মেরে কাটিয়েছি রেজিস্ট্রি বিল্ডিংয়ের সামনের মাঠের ঘাসের গালিচায়। আমি মুহসীন হলে, সরো জহুরুল হক হলে, মুকুল সূর্যসেন হলে। মুকুলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ফারুখ ফয়সালের কল্যাণে।

ওরা বগুড়ার বন্ধু। ফারুখ আমাদের সঙ্গে বাংলায়, মুকুল ইংরেজিতে পড়ে। ফারুখ সেই সময়ই অসম্ভব পরিশ্রমী-কর্মঠ, চালাক-চতুর আর বিদেশিনীদের সঙ্গে পাবলিক রিলেশনসে ওস্তাদ। খাওয়া, না খাওয়ার সেই জীবন-সংগ্রামে ফারুখ, মুকুল ছাড়াও আমাদের অনেক বন্ধু-বান্ধবী ছিল এবং আজও আছে তারা ভালো বন্ধু হয়ে। যেমন আমাকে সাংবাদিকতায় নিয়ে আসে মিনা।

সানাউল্লাহ নূরীর বড় মেয়ে কিশোর বাংলায় ঢুকিয়ে দিয়ে আমার অর্থকষ্টের জীবনে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিল। মুকুল হলের ডাইনিং থেকে টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার নিয়ে আসত ওর রুমে। আমরা ভাগাভাগি করে খেতাম। সেই জীবন। মানুষের সেই জীবন, শালিকের, দোয়েলের মতো ভেসে উড়ে গেছে।

সেই কষ্টের, সংগ্রামের জীবনের পরতে পরতে জমে আছে তিতা, নুন, মিষ্টি, বাতাস আর ভালোবাসা। সেই জীবন আর কোনদিন ফিরে পাব না যখন খাবারের নিশ্চয়তা ছিল না। যখন একবেলা খেতে কাজী সালাহউদ্দিনের বাসায় কিংবা আলেয়া চৌধুরী হিরার কাছে চলে যেতাম। হাসান হাফিজ, রেজোয়ান সিদ্দিকী, শান্তি, মিলন, সিরাজুল ইসলাম, বুলবুল চৌধুরী, আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, জুবেরী আরও অসংখ্য বন্ধু জড়িয়ে আছে সেই জীবনযুদ্ধের সত্যযাত্রায়। এ যেন এক থালায় খাবারের মতো, মাখামাখি জীবন।

বছর ৮/৯ আগে এক ভোরে ফোনে একজন বলল, এই যে কবি। বলেন তো আমি কে? গলা শুনে চিনতে পারি না। গলার স্বর অনেকটাই ভাঙা, হাস্কি। কেবল কথা বলার ভঙ্গিমাটা যেন চেনা চেনা লাগছে। বললাম না।

তা পারবেন কেন। আপনি তো-তো, চিনলাম তো বলার সঙ্গে সঙ্গে, মুকুল ঠিক হচ্ছে না। কোথায় আপনি। বলল ডালাসে। আমি ভাবলাম মজা হচ্ছে।

মুকুলই জানাল শহীদ কাদরীর অসুস্থতার কথা। কাদরীর দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে গেছে। ওর সঙ্গে নিয়মিত ফোনালাপ হয়। ডালাস টু বোস্টন। সেখানে আমাদের আরও দুই বন্ধু থাকেন।

বদিউজ্জামান নাসিম ভাই, আর লিটন ভাই। নাসিম ভাইয়ের সঙ্গেও মুকুলের নিয়মিত যোগাযোগ। বোধহয় ফারুখ ফয়সালের সঙ্গে যোগাযোগটা আলগা হয়ে গিয়েছিল। ফারুখ থাকে কানাডার অটোয়াতে। আর পৃথিবীব্যাপী ওর যাতায়াত।

মিডিয়া ট্রেনার হিসেবে বেশ খ্যাতি ওর। মুকুল প্রায়শই চাকরি ছাড়ে, আবার ধরে। যুগান্তরে এসে আমি ওকে বললাম লেখেন। ও আত্মকথনমূলক লেখা লিখতে থাকল। কিছুদিন চলার পর, যখন ওর বেশ সুনাম হয়েছে তখন ওর বেকারত্ব ঘুচল।

লেখাও পাঠানো বন্ধ হল। আবার বেকার হল মুকুল আবার লেখা শুরু করল। এভাবে বেশকিছু লেখা হয়েছে। মাঝে মধ্যে সাহিত্য বিষয়ে লিখত। আমি মাস দুয়েক আগে যুগান্তর সাহিত্যের দায়িত্ব নেয়ায় ঘাড়ে চাপল ঈদ সংখ্যা।

ই-মেইলে বললাম লেখা পাঠান। ও পাঠাল শামসুর রাহমানের ওপর একটি রচনা। সেটি ছাপালাম রাহমানের মৃত্যু দিবসের কয়েকদিন পর ২২ আগস্ট। লিখলাম ঈদ সংখ্যার জন্য গল্প পাঠান। ফিরতি মেইলের হেডিং গল্প পাঠালাম।

আমি খুশি। ওর গল্পের আলাদা স্বাদ। চিঠিটা এক লাইনের, গল্প লিখতে পারলে তো পাঠাবো। এরপর একদিন ফোনে পেল আমাকে বাসায়। বলল গতকাল ফোন করছিলাম কোথায় থাকেন? বলে নাই।

আমাকে রিনি বলতে ভুলে গেছে। বলল সরোকে বলবেন আমাকে যেন ফোন করে। যত টাকা বিল হবে আমি পাঠিয়ে দেব। আমি সে কথা সরোকে বলিনি। ওটাই আমার সঙ্গে মুকুলের শেষ কথা।

এরপর একদিন সোহরাব হাসান বলল জুবায়ের নাকি হাসপাতালে। বোস্টন থেকে নাসিম ই-মেইল করেছে। খুলে পড়লাম। ওর জন্য সবাইকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে বলেছেন নাসিম। আমরা ফোন করলাম বোস্টনে।

আরও কিছু জানলাম। পরের দিন আমার মেইলেও পেলাম জুবায়েরের রোগ ও চিকিৎসা বিষয়ক কথা। আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলাম আমার আত্মার বন্ধুর জন্য। ঈদ সংখ্যার কাজ শেষ হয়ে গেছে। আমাদের বন্ধু আফজাল হোসেন, ওকে একটি কপি দিতে গেছি ওর ধানমণ্ডির অফিসে সন্ধ্যায়।

সেখানে স্বপন দত্তর সঙ্গে দেখা। ও জানাল ঝর্নার নতুন নম্বর। পুরনো নম্বরে ঝর্না-রনজুকে পাই না আমি। ফোন নিলাম ঝর্নার। কথা বললাম মুকুলের অবস্থা সম্পর্কে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে।

মুকুলের মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টারও কম আগে। হায়! কে জানত ওই রাতের শেষে ভোরবেলায়ই সরো হদয় ভাঙা গলায় জানাবে আরও একটি বন্ধু হারানোর শোককথা। ------------------------------------------------------------ দৈনিক যুগান্তর । ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ শনিবার প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।