আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দূরদেশে: একা ও একসঙ্গে

প্রশিক্ষণার্থীদের কান্ট্রি স্ট্যাটাস রিপোর্ট শুরু হলো দেশের নামের ক্রমানুসারে। আফগানিস্তান না থাকলে বাংলাদেশকেই সব সময় সূত্রপাত করতে হয়, এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না। প্রথমে শুরু করার সুবিধা অসুবিধা দুই-ই আছে। আমার জন্যে মনে হয় সুবিধার দিকগুলোই বেশি ছিল। পরপর ব্রুনাই, ভারত এবং শেষে ইন্দোনেশিয়া রতি আলফাদিনের প্রতিবেদন দিয়ে শেষ হলো দিনের কর্মসূচী।

ইন্দোনেশিয়ার টেলিভিশন টিভিআরআই এবং বেতার আরআরআইয়ের হয়ে দর্শক মতামত জরীপের কাজটা করে তথ্য অধিদপ্তর। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য বেতার টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যম জনজীবনে, বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে তা উদঘাটন করা। শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণসহ স্বাস্থ্যখাতে পরিসেবা সম্পর্কিত উন্নয়ন এবং মানুষের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে গণমাধ্যম কতটা প্রভাবিত করছে ইত্যাদি এই মতামত জরীপের মূল উদ্দেশ্য বলে রতি তার রিপোর্টে উল্লেখ করেেছ। তবে প্রতিবেদন ছাড়াও সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর এবং আলোচনা থেকে যতটা ধারণা করা গেছে তা হলো ইন্দোনেশিয়ার পাঁচটি প্রদেশে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠি ভাষা সম্প্রদায় ও ধর্মবিশ্বাস মিলিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের ঐক্যবদ্ধ এক জাতিস্বত্ত্বাই মূল সমস্যা। সেই কারণেই দর্শক জরীপেও মিডিয়া এ্যান্ড ন্যাশনাল ইন্টিগ্রিটি সম্পর্কিত প্রশ্নটি বারবারই ঘুরে ফিরে এসেছে।

ক্লাস থেকে বেরোবার সময় রতিকে বললাম, ‘তোমার শুরুটা তো ভালই হয়েছে। ভয় ভেঙেছে নিশ্চয়ই?’ ‘ন্যারোলি এসকেপ্ড। ’ রতির সংক্ষিপ্ত জবাব। আগের দিন রাত দশটার দিকে একটা সমস্যা নিয়ে রতি আমার কাছে এসেছিল। মৃদু টোকা শুনে দরজা খুলতেই রতি আলফাদিন বললো, ‘তোমার ঘরে কি আসতে পারি?’ ‘নিশ্চয়ই, মোস্ট ওয়েলকাম।

’ ঘরে ঢুকে রতি যা বললো তার সারকথা হলো দেশে নিয়মিত নামাজ পড়লেও এখানে আসার পর থেকে সে এক ওয়াক্ত নামাজও পড়েনি। এর ফলে সে যথেষ্ট মনোকষ্টে আছে। আমি বললাম, ‘নামাজ পড়তে সমস্যা কী, তোমার তো মসজিদে জামাতে নামাজ পড়তে যেতে হবে না। ইসলামে এই একটা সুবিধা, কোনো মন্দির গির্জা বা প্যাগোডায় যাবার দরকার নেই। যে কোনো জায়গায় জায়নামাজ এমনকি তোয়ালে বিছিয়েও নামাজ পড়ে ফেলা যায়।

’ ‘নামাজ তো ঘরেই পড়া যায়, কিন্তু আমি যে পশ্চিম দিকটাই ঠিক বুঝতে পারছি না। তুমি হয়তো বলতে পারবে ভেবে তোমার কাছে এলাম। ’ ‘তুমি বরং এ ব্যাপারে আবদুল জলিলকে জিজ্ঞেস করতে পারো। হাজি মানুষ নিশ্চয় নিয়মিত নামাজ পড়েন। ’ আমার কথা শুনে হাসতে শুরু করে রতি।

‘ব্রুনাই দারুস সালামের প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেকেই হাজি। ওদের প্রচুর টাকা আছে, সময় সুযোগ পেলেই মক্কা মদীনায় ট্যুর করে আসে। হজ্জ্ব করাটা ওদের ট্যুরিজমের অংশ। ’ বিষয়টা যেহেতু আমার জানা নেই, তাই এ প্রসঙ্গে কথা না বাড়িয়ে বললাম ‘আগামীকালই তোমাকে কেবালামুখি হবার ব্যবস্থা করছি। শুধুমাত্র পশ্চিম দিক খুঁজে না পাওয়ায় আমাদের এই প্রশিক্ষণ কোর্সের একমাত্র মুসলিম বোন নামাজ পড়তে পারবে নাÑ এটা মেনে নেয়া যায় না।

’ দুপুরে কুয়ালালামপুর পৌঁছে বিকেলের ক্লাসে যোগ দিয়েছে পাকিস্তানি সাইফ-উর-রেহমান, রেডিও পাকিস্তানের অডিয়েন্স রিসার্চ অফিসার। সাইফ তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রেডিও পাকিস্তানের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট মধ্যরাতে! অর্থাৎ পাকিস্তান এবং রেডিও পাকিস্তানের জন্ম একই সাথে! ষোলটি সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৮ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে রেডিও পাকিস্তান। অনুষ্ঠান মূল্যায়ন এবং দর্শক মতামত জরীপের ক্ষেত্রে প্রথাসিদ্ধ ধারণার বাইরে তেমন কোনো কাজ হয় বলে মনে হলো না। তবুও আমাদের বেতারের চেয়ে অন্তত অডিয়েন্স রিসার্চে ওরা এগিয়ে আছে। করাচি, লাহোর, মুলতান, পেশোয়ার, রাওয়ালপিন্ডি এবং কোয়েটা কেন্দ্রের প্রত্যেকটিতে একজন করে অডিয়েন্স রিসার্চ অফিসারের অধীনে রয়েছে দর্শক মতামত জরীপ সেল।

পিবিসি অর্থাৎ পাকিস্তান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের হেড কোয়াটার ইসলামাবাদে বসে কেন্দ্রগুলোর জরীপের ফলাফল সমন্বয় করে সাইফ। তার প্রতিবেদন থেকেই জানা গেল, আঠারোটি বিদেশী ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে রেডিও পাকিস্তানের বৈদেশিক সম্প্রচার বিভাগ। পিবিসি’র ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্রডকাস্টিং-তালিকায় আরবী, ফার্সি, তুর্কি, জাপানীর সাথে ‘সিলেটি’ ভাষার উল্লেখ থাকলেও বাংলায় ভাষায় কোনো অনুষ্ঠান নেই। বাংলাকে কি পাকিস্তানিরা এখনো তাদের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা মনে করে! সাইফ-উর-রেহমান এ ব্যাপারে কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। সাঈফ উত্তর না দিতে পারলেও বিদেশী ভাষার তালিকায় বাংলা ভাষার উল্লেখ না থাকা এবং বাংলায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার না করার পাকিস্তানিরা তাদের মানসিক দৈন্যতাই প্রকাশ করে দিয়েছে।

তারা একাত্তরের পয়াজয়ের স্মৃতি যেমন ভুলতে পারিনি, তেমনি তারা নিশ্চয়ই তাদের নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশ বা বাংলাভাষা সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে দিতে চায় না। ঘরে ফিরে সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সতীর্থদের কাউকে না পেয়ে উল্টো দিকের পথ ধরে একা একা হাঁটতে শুরু করলাম। অনেকদূর পর্যন্ত হেঁটে পাহাড়ের গায়ে যে বাসস্টপে থামলাম তার নাম জালান বুকিত আংকাসা। পরে জেনেছি বুকিত মানে পাহাড়Ñ অর্থাৎ আংকাসা পাহাড়ের কোলে এই নাগরিক জনপদের নাম সঙ্গত কারণেই আংকাসাপুরি।

পরিকল্পনা ছিল ফেরার পথে একটা বাসে উঠে আংকাসাপুরি ছাড়িয়ে মাঝ পথে ব্রিকফিল্ডের কাছাকাছি নেমে একবারে রাতের খাবার সেরেই ফিরবো। সেই মতো বাস ধরে যথাস্থানে নেমেও গেলাম বাস থেকে, কিন্তু রাস্তার এপারে পূর্ব পরিচিত কোথাও না ঢুকে, বেছে নিলাম একটা ঝকঝকে নতুন রেস্টুরেন্ট। আমার ধারনা ছিল এই এলাকার সব হোটেল রেস্টুরেন্টই ইন্ডিয়ান স্টাইলের! দক্ষিণ ভারতীয় না হলেও এখানকার ব্যবসা বাণিজ্য পাঞ্জাবী সরদারজি বা শ্রীলঙ্কার তামিলদের দখলে। কিন্তু টেবিলে বসার পর মেনু দেখে বুঝলাম এটা ভারতীয় অথবা চাইনিজ নয়Ñ সত্যিকারের মালয় রেস্তোরা। মালয়দের নাসি গোরিং, তাল্ল গোরিং জাতীয় দু চারটা খাবারের সাথে আগেই পরিচয় ঘটেছিল, কাজেই খুব একটা সমস্যা হবে না জানতাম।

খাবারের কথা বলার সাথে সাথেই প্রশ্ন হলো, ‘হোয়াত দ্রিংক?’ আমাদের দেশে খাবারের সাথে পানীয়ের ব্যাপারটা ততোটা গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে ধরা হয় না। ডাল ভাত রুটি মাংসÑ খাবার যাই হোক সাথে সাধারণত পানি, বড় জোর কোনো কোক-সেভেন আপ জাতীয় হালকা পানীয়। পোলাও রেজালা বা কাবাব বিরিয়ানী হলে সাথে বোরহানীÑ এর বেশি কিছু নয়। এখানে ছোট বড় যে কোনো খাবারের দোকান, বিশেষ করে মালয় রেস্টুরেন্টে প্রথম প্রশ্ন ‘হোয়াত দ্রিংক?’ মেনু থেকে পরিচিত কোনো একটা ড্রিংকের অর্ডার দেয়া যেতো, কিন্তু নেহায়েতই এক্সপেরিমেন্ট করার উদ্দেশ্যেই যে পানীয়টি দিতে বললাম তার নাম ‘সুসুলেম্বু’। পরিবেশনকারী ছেলেটি সম্ভবত অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল।

ব্যাপারটা তখন বুঝিনি, বুঝলাম যখন ফ্রাইড রাইসের সাথে এলো একগ্লাস দুধ। লেম্বু কথাটি যুক্ত থাকায় স্বাভাবিকভাবেই আমার মনে হয়েছিল ‘সুসুলেম্বু’ মানে লেবুর তৈরি কোনো তরল পদার্থ। পরে অবশ্য মনে পড়েছে ‘কপিসুসু’ মানে যদি কফি উইথ মিল্ক হয় তাহলে সুসুলেম্বু অর্থ গরুর দুধ হতে আপত্তি কোথায়। যাই হোক, রেস্টুরেন্টের পরিবেশনকারী ছেলেটি নিশ্চয়ই জীবনে অন্তত একবার হলেও নাসি গোরেং এর সাথে সুসুলেম্বু পরিবেশনের অভিজ্ঞতার কথা বহুদিন মনে রাখবে। অমর একুশে বইমেলায়: জাগৃতি প্রকাশনী (স্টল নং-২২১, ২২২,২২৩) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।