আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দূরদেশে: একা এবং একসঙ্গে

ব্যাংককে এক রাত ব্যাংকক এয়ারপোর্টের বাইরে এসে প্রথমবারের মতো নিজেকে সত্যিকারের বিদেশে আবিষ্কার করলাম। চারিদিকে অপরিচিত পরিবেশ, অচেনা হৈ চৈ, মাঝে মধ্যে দুর্বোধ্য ইংরেজিতে ভাঙাচোরা শব্দাবলী। সব মিলিয়ে বান্ধবহীন এই শহরে হঠাৎ করেই খুব অসহায় বোধ হচ্ছিল। অভিজ্ঞ বন্ধুরা পইপই করে বলে দিয়েছিল, এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যাবার আগেই বিমান বন্দরে বাংলাদেশ বিমানের কাউন্টার থেকে হোটেল রিজার্ভেশান, পরবর্তী ফ্লাইট ধরার জন্যে ফেরার ব্যবস্থা এবং ব্যাংককে অবস্থানকালীন লাঞ্চ-ডিনার-ব্রেকফাস্টের যাবতীয় ব্যবস্থা না করে নিলে অসুবিধায় পড়তে হবে। কাজেই হোটেলের স্লিপ, খাবারের কুপন এবং যাতায়াতের ব্যবস্থা পাকাপাকি করে নিয়েই বেরিয়েছি।

ইমিগ্রেশনে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হাউ মেনি ডেজ ইউ ওয়ান্ত?’ বললাম, দিন তিনেক হলেই চলবে। ‘ইউ ওয়ান্ত থ্রি ডেজ, আই গিভ ফিফটিন ডেজ। ’ হাসতে হাসতে পনের দিনের জন্য প্রবেশাধিকার দিয়ে দিল ইমিগ্রেশন অফিসার। কাস্টমসের লোকেরা ব্যাগ দেখার প্রয়োজনও বোধ করেনি। এখন শুধু লিমোজিন সার্ভিসের বাহনের অপেক্ষা।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো নাÑ না লিমোজিনের ড্রাইভার নয়, রঙিন এ্যালবাম হাতে এগিয়ে এলো বারবণিতার দালাল। রাত্রিকালীন ব্যাংককের আকর্ষণের কথা অনেক শুনেছি কিন্তু এয়ারপোর্টের বাইরে পা রাখতেই কেউ হাত বাড়িয়ে দেবে ভাবিনি। দালালটি রঙিন চিত্রাবলীর পাতা ওল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে মোলায়েম ইংরেজিতে মিস অমুক, মিস তমুকের গুণাগুন বর্ণনা শুরু করলো। এসব আজীবন কুমারীদের কারো সঙ্গেই আমাদের রাত্রি যাপনের কোনো ইচ্ছা নেই জেনে সে বিন্দুমাত্র হতাশ হলো না। হাতের ফোলিও ব্যাগ থেকে এবারে সে বের করলো বেশ বড়সড় একটা ক্যাটালগÑ এবারের বিষয় ডিসকো নাচ।

কোন নাইট ক্লাবে কোন সুন্দরী কি পরিমাণ অঙ্গ উন্মুক্ত রেখে নৃত্য পরিবেশন করেন অথবা কোন ক্যাবারে নাচের আসরে আজ কোন ভুবনমোহিনী তার বস্ত্র উন্মোচন করবেনÑ এসবের সচিত্র প্রতিবেদন। আমরা বিরস বদনে জানালাম এতেও আমাদের কোনো উৎসাহ নেই। যাত্রা বিরতি হিসাবে নিতান্ত একটা রাত ব্যাংককে কাটাবো, কাজেই নাচ গানের আসরে সুন্দরীদের সাথে সময় নষ্ট না করে শহরটা একটু ঘুরে ফিরে দেখতে চাই। শহর দেখতে চাই জেনে দ্বিগুণ উৎসাহে ছোট্ট একটি প্রচার পুস্তিকা বের করলো সে এবং মিস অমুক গাইড হিসাবে নামমাত্র মূল্যে আমাদের শহর ভ্রমণে নিয়ে যেতে পারে সে কথাও জানিয়ে দিতে ভুললো না। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই এই মিসদের পাল্লায় পড়ে ফ্লাইট মিস করতে চাই না।

কাজেই দালাল ভোলাতে চেষ্টা করলেও আমরা কিছুতেই ভুলছি না। শহর ভ্রমণের ব্যবস্থাটাও আমরা নিজ উদ্যোগে করতে চাই জেনে কিঞ্চিত হতাশ হয়ে থাই পর্যটন বিভাগের এই চলমান বিজ্ঞাপন নতুন মক্কেলের সন্ধানে এগিয়ে গেল । দুপুর একটায় ঢাকা ছেড়ে দুঘণ্টা উড়ে ব্যাংকক বিমান বন্দরে নেমেছি স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে চারটায়। অক্টোবরের শেষ বিকেলের রোদ এরই মধ্যে হলুদ হতে শুরু করেছে। লিমোজেনের গাড়িতে যখন প্রায় একশ কিলোমিটার গতিতে শহরের দিকে ছুটে চলেছি তখন রোদের সোনালি আভায় চারিদিক ঝকঝক করছে।

নাক বরাবর প্রসারিত, ব্যাপক বিস্তৃত রাস্তার দু’পাশে গড়ে উঠেছে বিশাল দালান কোঠা, কিছুক্ষণ পরপরই চোখে পড়ে বিপুলায়তন বৌদ্ধমূর্তি অথবা স্থাপনার দেয়াল জুড়ে গড়–রের প্রতিকৃতি। বিমান বন্দর থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কের দু’পাশে কেমন একটা শান্ত সমাহিত ভাব। বিকেলের পড়ন্ত রোদে মন্থর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে থাই তরুণ তরুণী। রাস্তার ফ্লাইওভারগুলোতে কিছু কিশোর কিশোরীর ভিড়। সাইকেলে চেপে এপার ওপার করছে কেউ কেউ।

অনেক দূর পর্যন্ত চলতে চলতে ভাবছিলাম পুরো শহরটা বোধহয় এমনি নিঃশব্দ নির্ঝঞ্জাট ধরনেরই হবে। ধারণা পাল্টাতে বেশি দেরি হলো না। পাগলের মতো ছুটে চলা গাড়ির ব্যস্ততা, বিচিত্রসব হর্নের বিকট শব্দ, সাইলেন্সার বিহীন টেম্পো জাতীয় বাহনের কান ফাটানো আওয়াজে কিছুক্ষণের মধ্যেই কান ঝালাপালা হয়ে গেল। গাড়ির আরোহী অথবা চালকদের সবাই সবার চেয়ে ব্যস্ত। কেউ কারো জন্যে পথ ছাড়তে চায় না, কেউ কারো পেছনে পড়তে চায় না।

অতএব মাঝে মধ্যেই দীর্ঘ অচলাবস্থা। শহরে ঢোকার সময় মনে হয়েছিল, এই বুঝি গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু হাজারো জনাকীর্ণ ফুটপাথ, অসংখ্য দালান কোঠা, সারি সারি সাজানো বিপনী কেন্দ্র, বহু উদ্যান আর প্রচুর পথের বাঁক পেরিয়েও পথ ফুরাতে চায় না। সাড়ে ছয়শ’ বছরের পুরোনো এই শহরের বিশালত্ব কেবল তখনই অনুভব করতে পারলাম। আধুনিক থাইল্যান্ডের রূপকার আয়ূথ্যা রাজবংশের শাসনামল শুরু হবার অনেক আগেই আগে চাওফ্রেয়া নদীর পশ্চিম তীরের ছোট্ট এক বন্দরে বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে গোড়াপত্তন ঘটেছিল ব্যাংককের।

১৭৬৭ সালে আয়ূথ্যা রাজবংশের পতনের পর রাজা তাকসিন শ্যামদেশের ক্ষমতায় আসীন হলেও রতœাকোসিন রাজবংশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৭৮২ সালে রাজা প্রথম রামার শাসনকালে। রাজা তাকসিনের মৃত্যুর পরে তিনিই চাওফ্রেয়া নদীর পূর্ব তীরে রাজধানী ব্যাংককের সীমানা বিস্তৃত করেন। ১৯৮২ সালে এ শহরের লোকসংখ্যা ৫০ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংকক নগরীসহ সারা দেশেই রতœাকোসিন রাজবংশ প্রতিষ্ঠার দ্বি-শত বার্ষিকী পালনের প্রস্তুতি চলছে, তাই সর্বত্রই সাজ সাজ ভাব। রাজা রামারাও সড়ক হয়ে রাজবংশের বিভিন্ন কৃতিপুরুষের গোটাকয়েক ধাতব উপস্থিতি ডাইনে বাঁয়ে রেখে আমরা যখন সিলোম রোডে পৌঁছালাম তখন পথের দু’পাশে বাতি জ্বলে উঠেছে।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে জমে উঠেছে সান্ধ্যকালীন খাবারের ভ্রাম্যমাণ দোকান। শুধু ব্যাংককে নয়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক শহরেই বাড়ির বাইরে হোটেল রেস্টুরেন্ট অথবা রাস্তার পাশের খাবারে সবাই বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অর্থ উপার্জনের অনিবার্য প্রক্রিয়ায় স্বামী স্ত্রী উভয়েই নিয়োজিত হবার ফলে গৃহস্থালী ঝামেলার অনেকটাই এরা কমিয়ে দিয়েছে। ব্যাংককের ফুটপাথের ধারে ঠেলাগাড়ির উপর সাজানো দোকানে রকমারি খাবারের বিপুল সমাবেশ। মাছ-মাংস, সবজি- তরকারি এবং ভাত-চৌমিন ছাড়াও নানারকম ফল।

ঝুলতে থাকে চামড়া ছেলা হাঁস, গরম পানিতে টগবগ করে ফোটে কবুতর বা তিতির জাতীয় আস্ত কোনো পাখি। আচার এবং চাটনি জাতীয় খাবারেরও ছড়াছড়ি এসব দোকানে। এ যাত্রায় অবশ্য রোড সাইড রেস্টুরেন্টের খাবার চেখে দেখার সময় এবং সুযোগ কোনোটাই শেষপর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। তবে ব্যাংককের বাণিজ্যিক এলাকার জনাকীর্ণ রাস্তায়, বিশেষ করে হোটেল পাড়ার বাতাসে সেদ্ধ করা হাঁসের যে গন্ধ নাকের ভেতর দিয়ে আমার ব্রক্ষ্মতালুতে পৌঁছে স্থায়ী ছাপ মেরে দিয়েছিল, কুয়লালামপুর, সিঙ্গাপুর এবং সউলসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন বড় শহরের রাস্তায় সেই গন্ধ ফিরে ফিরে এসে ব্যাংককের প্রথম রাতের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। দূরদেশে: একা এবং একসঙ্গে জাগৃতি প্রকাশনী/ অমর একুশে বইমেলা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।