আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঃঃঃঃ কেওকারাডং আর ওরা ১৩ জন (পার্ট ওয়ান) ঃঃঃঃঃ

::::: দেখবো এবার জগতটাকে :::::

পাহাড় পর্বত নিয়ে আগ্রহ জন্মায় বিভুতিভুষণের “চাঁদের পাহাড়” পড়ার পর থেকেই। কিশোর শঙ্কর আর দুঁদে মাউন্টেনিয়ার আলভারেজের রোমাঞ্চকর অভিযান আফ্রিকার চন্দ্র পর্বতের দিকে। প্রথমবার যখন বান্দারবান গেলাম তখন পুরোদস্তর নেকা টুরিস্টের মত। গলায় ক্যামেরা, মাথায় হ্যাট। চিম্বুক, টাইগার হিল (নীল গিরি), মেঘলা, স্বর্ন মন্দির, শৈলপ্রপাত যেটাই দেখি তাতেই লাফাই আর পটাপট ছবি তুলি।

দামী হোটেলে থেকে ল্যান্ড ক্রুজারে করে একটা সুইস টিমের সাথে ঘুরলাম। পাহাড়িদের সাথে মেশা হলোনা। গাইড ভদ্রলোককে কেওকারাডং সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। উনি না করলেন। অনেক রিস্কি, শান্তিবাহিনীতে গিজ গিজ করছে, রাস্তা নাই...হাজার কথা।

কিন্তু কেওকারাডং এর উপর আগ্রহ কমলো না। পড়ে নেটে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে বুঝলাম, বিচিত্র কারণে বাংলাদেশের সরকার চায়না সমতলের লোকেরা গভীরে যায়। গুগল আর্থ আর অনেক সাইটে রহস্যঘেরা বগা লেকের ছবি দেখে লোভ বাড়লো। সরকার গভীরে বিন্দুমাত্র কাজ করে নাই। ওরা যেন আমাদের দেশের লোক না।

যেতে গেলে পাসপোর্ট ভিসা হয়তো লাগে না, কিন্তু সরকারী লোকদের ভাব ভঙ্গিতে মনে হয় বিদেশে যাচ্ছি। কিন্তু এডভেঞ্চার লোভীরা বড়ই বেয়াড়া ট্রেকাররা রেগুলার হানা দিচ্ছে। মদক ময়াল, সিপ্পি, নতুন নতুন পর্বত, ঝর্ণা, নদী, পাড়া আবিষ্কার হচ্ছে। আধুনিক ইন্টারনেটের কল্যানে ছবি গুলো বাকীদের উতসাহী করতে যথেষ্ট। এরকম এক ট্রেকারদের দলের সাথে পরিচয় হলো।

ওদের একজন সাজ্জাদ। পাহাড় ছাড়া মাথায় আর কিছু ঢুকেনা। বান্দারবানের গহীন অরন্য নিজের বেডরুমের চেয়েও ভালো চেনে। কারণ নিজের বেডরুমের চেয়ে জঙ্গলে তাবু খাটিয়ে থাকে বেশি। যাই হোক সাজ্জাদ যাচ্ছে কেওকাড়াডং, সাথে এমেচারদের নেবে।

আমি লাফিয়ে উঠলাম, নাম দিলাম। আমার প্রথম ট্রেকিং প্রথমবারের মত গহীনে যাচ্ছি। আমরা ঢাকা থেকে নাইট কোচে রওনা দিলাম। সাজ্জাদ ছাড়া দলের কারোরই অত গভীরে যাবার অভিজ্ঞতা নাই। আমি দেড় বছর বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ছিলাম।

পাহাড়ে পর্বতে অনেক এক্সেরসাইজ করছি। সিতাকুন্ড রেঞ্জে এমন জায়গাতেও গেছি যেখানে দিনের বেলা সুর্যের আলো ঢুকেনা। রাঙ্গুনিয়ার গভির জঙ্গলে স্লিপিং ব্যাগে রাত কাটিয়েছি। সাজ্জাদ অভয় দিল খুব কষ্ট হবে না। অভিজ্ঞতা থেকে জানি এই সিজনে সবচে বড় শত্রু জোক।

কিন্তু মে মাসের কড়া রোদে জোক থাকেনা। বর্ষার পড় থেকে ওরা বের হয়। দলের সবার সাথে খাতির হলো। বান্দারবান শহরে এর আগে আরো কয়েকবার আসছি। বাস কাউন্টারে আমরা ফ্রেস হলাম।

কয়েকজনকে পেলাম রুপ সচেতন, অভিযাত্রিদের মত বিশাল ব্যাকপেক খুলে সানব্লক বের করে মাখতে থাকে। পড়ে বুঝেছিলাম এই কঠিন আবহাওয়াতে ওটা খুব দরকারী। সবাই বাথরুমে অনেকটাইম নিচ্ছে। কিন্তু আমাদের যেভাবেই হোক দুপুর দেড়টার আগে রুমাবাজার থেকে বের হতে হবে। আর্মির নিয়ম অফিস আওয়ার ৭টা থেকে ২টা।

২টার পর ওরা আর পারমিট দেবেনা। আমি আর সাজ্জাদ দৌড়ালাম চান্দের গাড়ির স্ট্যান্ডে। গাড়ি পাইনা। এটা বাঙ্গালী অধ্যুষীত এলাকা। এখানকার বাংলীরা কেমন জানি।

হেল্প করতে চায়না। সবাই মারাত্মক ভাড়া চায়। আমরা ছিলাম ৭ জন। পড়ে আরেকটা গ্রপের সাথে দেখা। ওরা কিছুই জানেনা।

পেপারে কেওকাড়াডং এর নাম দেখে চলে আসছে। দুইদল এক হলে আমাদের নাম্বার হলো ১৩ জন। আমরা গ্রুপ হিসাবে ভাড়া করলে গাড়ির খরচ উঠে আসে। আমরা চান্দের গাড়িতে রওনা দিলাম। আসলে নাম ছাদের গাড়ি, কারণ ছাদে ভেতরের চেয়ে বেশি লোক উঠে।

ছাদের গাড়ি থেকে নাম বিবর্তন হয়ে হয়েছে চান্দের গাড়ি। যারা নিচে বসেছিল তারা ভয়ঙ্কর রোদে আমাদের কয়লা হয়ে যাওয়া নিয়ে হাসা হাসি করলো, কিন্তু রোদে কয়লা হোলেও আমরা যে ভয়ঙ্কর মজা পাচ্ছি ওটা ওরা কিভাবে বুঝবে। চারপাশে বড় বড় পাহাড়, গিরিখাদ। আর অসঙ্খ টক টকে পাহাড়ি জবা আর পাহাড়ি জারুলের লাল নীল বন্য সৌন্দর্য। আমরা মিলন ছড়ি, শৈল প্রপাত, নিলগিরি, ছেড়ে চিম্বুক Y জাঙ্কশান পার হলাম।

এর আগে যতবার আমি আসছিলাম এ পর্যন্তই আমার দৌড়। সবাই বুঝাইছিল ওইপাশে মগের মুল্লুক। মানুষের জানপ্রানের কোন গেরান্টি নাই। চিম্বুক আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করলাম। জানি যে এই ক্যাম্পের দ্বায়িত্বে আছে আমার খুবই প্রিয় এক কোর্সমেট (যখন কার কথা তখন ও কেবল লেফটেন্যান্ট থেকে ক্যাপ্টেন হয়েছে, ওকে জানাইনি।

কথা বার্তায় দেখছি ট্রেকারদের ভালো চোখে দেখে না)। ওখান থেকে শুরু হলো গহীনে যাত্রা। ওই সীজনটা হচ্ছে জুম এ চাষের আগের সময়। পাহাড়ে আগে অনেক ঘুরছি, তাই পাহাড় কেটে জুম চাষ আমাকে অবাক করে না। অন্যরা যারা নতুন তাদেরকে হিংসা হলো।

তবে এখানকার পাহাড়ি জবা আসলেই দুর্দান্ত। আর অনেক জারুল। পাহাড় জ্বালিয়ে জুমের ক্ষেত করছে। দুই পাশে আগুন মাঝ দিয়ে লক্কর ঝক্কর চান্দের গাড়ির ছাদে আমরা, হলিউডি স্ট্যান্ট মুভির মত। ছাদের দড়ি দিয়ে নিজেকে বেধে রাখছি যখন তখন ছিটকে যাবার সম্ববনা আছে।

চান্দের গাড়ি ফোর হুইলার পুরা পুরি দেশি প্রযুক্তি। কোন ব্রেকের ঝামেলা নাই। একটা বড় কাঠের টুকরা। ব্রেকের দরকার পড়লে হেল্পার ছেলেটা দৌরে গিয়ে চাকার তলে ওটা ঢুকিয়ে দিয়ে থামায়। পথে একটা পাড়ায় এক লোকের সাথে দেখা লিফট চাইলো।

হেল্পার আর ড্রাইভারদের আপত্তি সত্তেও আমরা নিলাম। তার নাম “দিংমা”। একজন প্রিস্ট। অবশ্য সে বলে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক। জাতিতে বম।

এদিকে চাকমা মারমা কিংবা বাংলী নাই বললেই চলে। সবাই বম, ম্রো কিংবা ত্রিপুরা। দিংমা দাদার সাথে বেশ খাতির হয়ে গেলো। চমতকার লোক। কথায় কথায় উফ বলা তার হ্যাবিট।

দাদা ওদিকে জোক আছে কেমন? জোক উফ! কিন্তু এখন নাই। দাদা জায়গা কেমন? সুন্দর উফ। দিংমা দাদা টানা ২দিন হেটে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাচ্ছিলেন। খালি গা। ছেড়া প্যান্ট আর পায়ে নাইকি কেডস।

পাহাড়ি ধর্মযাজকের পাহড়ি পোষাক। বমদের ধর্ম এখন বিলুপ্ত। কিন্তু সাজ্জাদ আর দিংমা দাদার কাছে শুনলাম বমরা বিশ্বাস করে আগে ওরা সবাই স্বর্গে ছিল। দেবতা (নাম বুলে গেছি) ওদের পাপের জন্যে পাহাড়ে নির্বাসন দিয়েছে। জীবনযাত্রা এত কঠিন এটা ওদের পাপের ফল।

তাই কোন অনুযোগ নেই, অদ্ভুত বিশ্বাস। ওদের মুক্তির জন্যে দেবতা গরুর পিঠে কলা পাতায় (পাহাড়ে কলা আর লেবু গাছ অনেক, পাহাড়ি কলা বানরেরাও খায় না। কিন্তু লেবু ভয়ঙ্কর সুবাস ছড়ায়) লিখা ধর্মগ্রন্থ পাঠিয়ে দিয়েছিল। পথে খিদে পাওয়ায় সেই লোভী গরু সেটা খেয়ে ফেলে। সেই ধর্মগ্রন্থে তাদের মুক্তির উপায় বাতলানো ছিল।

কিন্তু গরুর জন্যে এটা হলো না। তাই বমরা এখনো খ্রিস্টান হবার পরেও তাদের ট্রাডিশনাল একটা দিনে উতসব করে আর বল্লম দিয়ে একটা গরুকে আস্তে আস্তে খুচিয়ে খুচিয়ে মেরে ফেলে। এদিকে জনবসতি নাই বললেই চলে। ১০/১২ মাইল পর পর একটা গ্রাম (পাড়া) গ্রামের ৭/৮ এর বেশি পরিবার নাই। সাজানো গোছানো ট্রাডিশনাল ট্রাইবাল পাড়া।

স্কুল আছে খুব কম, মাঝে মাঝে চার্চ (বোঝার উপায় নাই, কারণ কোন ক্রস নাই) দরজায় রোমান হরফে ওদের ভাষায় বিভিন্ন কথা (বম কিংবা ম্রোদের ভাষায় নিজের বর্ণ মালা নাই) ছোট্ট ছোট্ট ভ্যালীর মত জায়গায় টুকটুকে পাহড়ি বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে। বুঝলাম ক্রিকেট কত গভীরে গেছে। পুরুষ খুব কম, থামি পড়া ভয়ঙ্কর সুন্দরী মহিলারাই বেশি। সবাই দেখি মুখে কি জানি মেখে রাখছে। সাজ্জাদ বললো এটা মুলতানী মাটি না, এটা টাম ফলের বিচির গুড়া।

পড়ে অবশ্য টাম ফল খেয়েছি অনেক বার। ওরা সবাই বলে আমের ভাই টাম। ...চলবে। আমি সামহোয়ারে নতুন। ব্লগে কিভাবে ছবি দেয় জানি না।

তাই ছবি দেখতে চাইলে কেউ ক্লিক করতে পারেন নিচের ফেসবুক লিঙ্ক গুলাতে Click This Link Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।