-কে কে পড়া পারনা দাঁড়াও।
আমি দাড়ালাম। আমার সাথে হাতে গোনা আরও কয়েকজন দাঁড়াল। স্যার আমার দিকে তখন তাকালেন। সবাইকে বসতে বললেন।
আমিও বসতে যাচ্ছিলাম। স্যার আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। স্যার বললেন,
- কিরে মুরাদ আমি প্রতিদিন ক্লাসে এসে কে কে পড়া পারনা দাঁড়াও বললে তুই প্রতিদিন দাঁড়াস। আমি প্রতিদিন তোকে মারি।
এরপরও তুই প্রতিদিন পড়া শিখে আসিস না। তোর কি লজ্জা বলতে নাই। তোর সমস্যা কি???
আমি তখন অষ্টম শ্রেনীতে পড়ি। আমার ইংরেজি টিচার মতিন স্যার। প্রতিদিন আমাকে পড়া না পারলে মারতেন।
আমিও শুধু মার খেতাম। কখনও জিজ্ঞেস করতেন না যে আমার সমস্যা কোথায়? আমি পড়া পারছিনা কেন? কিন্তু সেদিন যখন জিজ্ঞেস করলেন আমি উত্তর দিতে পারিনি। আমি বলতে পারিনি স্যার আমি ইংরেজি বুঝিনা। শুধু মুখস্ত করলে আমার মনে থাকেনা। আমার এই মুখস্ত করাটা অন্য সাবজেক্টে হয় কিন্তু ইংরেজির বেলায় হয়না।
আমি কিছুই বলতে পারিনি স্যারকে। শুধু মাথা নিচু করে ছিলাম। স্যার ক্লাসভর্তি সবার সামনে আমাকে অনেক লজ্জা দিলেন। আমি জানতাম আমার বন্ধুরা মজা পাচ্ছিল। কারন তারা মার খাওয়া থেকে বেঁচে গেছে।
একমাত্র মানুষই মানুষের বিপদে হাসতে পারে।
সেদিন এর মত বাসায় গেলাম। সন্ধ্যায় পড়তে বসলাম। সমাজ বই পড়ছিলাম। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমার ক্লাসের কথা মনে পড়ল।
তখন আমার মনে খুব জেদ চলে আসল। নিজেকে নিজে বললাম এই ইংরিজেতে কি আছে আমাকে দেখতে হবে। ইংরেজি বই উল্টালাম। সেদিন একটা প্যারাগ্রাফ মুখস্ত করতে বলেছিলেন। আমি সেই প্যারাগ্রাফ খুঁজে বের করলাম।
মুখস্ত করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি পারছিলাম না। কারন অন্য বিষয়ের লেখাগুলো বাংলায় থাকত। আমি বুঝতে পারতাম সেখানে কি বলতে চাচ্ছে। তাই সেগুলো খুব তাড়াতাড়ি মুখস্ত হয়ে যেত।
কিন্তু ইংরেজিতে আমি বুঝতাম না সেখানে কি বলতে চাচ্ছে। আমি তখন ওই প্যারাগ্রাফ এর কোন কোন শব্দগুলোর অর্থ্ বুঝতাম না তার নিচে দাগ দিলাম। ডিকশনারী থেকে খঁজে বের করলাম। অনেক কষ্টে সেই প্যারাগ্রাফ এর কিছুটা সারমর্ম্ দাড় করাতে পারলাম। তারপর মুখস্ত করলাম।
পরদিন স্যার যথারীতি যারা পড়া পারেনা তাদের দাঁড়াতে বললেন। অনেকে দাঁড়াল। আমি বসে রইলাম। স্যার আমার দিকে তাকালেন। আমার মনে হতে লাগল আমি পড়া পারি এটা স্যারের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে অবাক করা বিষয়।
আমাকে বললেন, -কিরে মুরাদ তুই বসে আছিস যে। তুই কি পড়া পারিস? আমি বললাম, - জ্বী স্যার পারি। স্যারের বিষ্ময়ের সীমা থাকলনা। আমাকে বললেন, -বলতো দেখি। আমি মুখস্ত বলে গেলাম।
স্যার আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষনপর বললেন, ঠিক আছে বস। সেদিন আমাদের সিলেবাসের আরেকটা প্যারাগ্রাফ মুখস্ত করতে দিলেন। কিন্তু সেই প্যারাগ্রাফ আমাদের গ্রামার বইয়ে ছিলন। আমি আমার বড় ভাইয়ের গ্রামার বই থেকে সেটা খুঁজে মুখস্ত করলাম।
পরদিন স্যার আবার যখন পড়ার কথা জিজ্ঞেস করলেন আমাদের ক্যাপ্টেন সৌরভ বলল, স্যার এটা আমরা বইয়ে খুঁজে পাইনি। স্যার সেকথা না শুনে বললেন, -কে কে পড়া পারনা দাঁড়াও। ক্লাসের সবাই দাঁড়াল। শুধু একজন ছাড়া। সেই মানুষটা ছিলাম আমি।
সেদিন বুঝলাম পড়া পারলে কেমন লাগে। ক্লাসের সবাই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু আমি বসে আছি। এমন অনেক দিন ছিল যেদিন সবাই বসে থাকত আর আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে পড়া পারি কিনা জিজ্ঞেস করলেন।
আমি হ্যা উত্তর দিলাম। স্যার আমাকে ডাকলেন। আমি তার টেবিলে গেলাম। স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কেথ্থেকে শিখেছি। আমি জবাব দিলাম আমার বড় ভাইয়ের গ্রামার বই থেকে।
স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি লিখে এনেছি কিনা। আমি হ্যাঁ উত্তর দিলাম। স্যার আমাকে খাতাটা আনতে বললেন এবং পড়া জিজ্ঞেস করলেন। আমি সেদিনও মুখস্ত বলে গেলাম। স্যার আমাকে লেখাটা ব্ল্যাকবোর্ডে লিখেতে বললেন।
আমি লিখলাম। সবাই আমার লেখা থেকে খাতায় লিখে নিল। এরপর থেকে যখন কোন প্যারাগ্রাফ বা এপ্লিকেশান বা অন্য কিছু বইয়ে পাওয়া যেতনা। তখন স্যার বলতেন, কেউ খুঁজে না পেলেও মুরাদ ঠিকই খুঁজে পাবে। আমার খুব আনন্দ হত তখন।
সেই থেকে শুরু। আমি ইংরেজির পেছনে লেগে থাকলাম। মতিন স্যার আমার ইংরেজির ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন। এরপর ল্যাংগুয়েজ পার্ক্ এর মঈন স্যার আমার ইংরেজির পুরো কাঠামো তৈরী করে দিলেন। এরপর আমার কলেজের সুনীল স্যার আমার ছোট ছোট যে ভুল গুলো ছিল তা শুধরে দিলেন।
আমার এই তিন টিচার এর জন্য সবাই দোয়া করবেন।
এখন আমার জবে আমাকে ইংরেজি বলতে হয়। আমিও দ্রুত বলে যাই। বলার পর যখন ক্লায়েন্ট সন্তুষ্ট মনে চলে যায় আমি তখন আমার এই তিন টিচার এর কথা ভাবি। টিচার এর কৃতজ্ঞতা কখনও শেষ করা যায়না।
আমিও পারবনা। তবে তাদের পা ছুঁয়ে একবার ছালাম করতে চাই। মতিন স্যার এর সাথে অনেকবার দেখা করব করব করেও করা হয়নি। জানিনা এতদিন তিনি সেই স্কুলে আছেন কিনা। আর মঈন স্যার এখন লন্ডনে থাকেন।
সুনীল স্যার এর সাথে হয়ত দেখা হবে। তিনি আমার কলেজেই আছেন। তবে আমি সবার পা ছুঁয়ে একবার করে ছালাম করার প্রতিক্ষায় আছি..................................... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।