আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
এইবাংলায় আমরা সবাই রাজা। দোষটা আমাদের না কারন স্বয়ং কবিগুরই বলছেন, “আমরা সবাই রাজা”। কবিগুরুকে আমরা এত শ্রদ্ধা করি যে, গানের “আমরা সবাই রাজা” অংশের পরে যে “আমাদেরই রাজার রাজত্ব” অংশটুকু আছে তা আর খেয়াল করি নাই। আমরা এখন সবাই নিজ নিজ রাজ্যে রাজা। রাজ্য না থাকলেও যে যেখানে আছি সেটাকেই নিজের রাজত্ব ধরে রাজনীতি শুরু করি।
বিধায় এ অঞ্চলে ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, সেনাবাহিনী সবাই রাজনীতিবিদ। অনেকে বলবেন কৃষক বাদ দিলাম কেন? কৃষকের নামে যদিও রাজনৈতিক সংগঠন আছে তবে তার সভ্যরা কেউই কৃষক নয়। এই দেশে আপাদত কৃষকরা রাজনীতির বাইরে আছে।
রাজনীতি বলতে কোন সমাজ বিজ্ঞানী কি সংজ্ঞা দিয়েছেন তা আজ আর খেয়াল নাই। তবে নানা প্যাচগোচ নিয়ে ডিল করবার নাম রাজনীতি, এইটাই আমি বুঝি।
এরিস্টোটল বলেছিলেন, “মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক জীব”(Man is naturally a political animal)। অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনে আমরা সবাই কোন না কোন ভাবে যাবতীয় জটিলতা নিয়ে খেলতে খেলতে মূলত রাজনীতিই করি। কিন্তু এই দেশে আমরা দৈনন্দিন জীবনের উপকরণ ছাপিয়ে সবাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের রাজনীতি নিয়ে মেতে থাকি। কথা হচ্ছে কেন? রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের রাজনীতিতো সবার কাজ না। এর জন্য আলাদা কিছু লোক আছে যাদের সমাজ রাজনীতিবিদ বলে থাকে।
আগেকার দিনে রাজা ও তার দরবারের লোকেরা রাজনীতি করত। এখন গনতন্ত্রের যুগে যারা যারা রাজনীতি করতে চায় ও পারে তারা সমষ্টিগত ভাবে রাজনৈতিক দল করে রাজনীতিতে অংশ নেয়। এদের মধ্যে যারা জয়লাভ করে তারাই দেশ শাসন করে। যদিও আধুনিক গনতন্ত্রের যে কয়েকটি ফাঁকা বুলি আছে তার মধ্যে একটিতে বলা হয়, “জনগন নাকি নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কার্যে অংশগ্রহণ করে এবং দেশের মালিক বনে যায়”।
যাই হোক, পৃথিবীর অন্য কোন দেশ বা জাতির ক্ষেত্রেই সর্বক্ষেত্রে রাজনীতির এমন বিস্তার দেখা যায় না।
কিন্তু কেন?? কারনটা খুঁজে বের করবার আগে চলুন আড়াই হাজার বছর আগেকার এথেন্সে যাই। ঐ সময় সে শহরে ঘোরাঘুরি করতেন সক্রেটিস সাথে ছাত্র প্লেটোকে নিয়ে। এই প্লেটোর সব চাইতে ভাল প্রফেশন মনে হত রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় কার্যে অংশগ্রহণ। কারন এই ক্ষেত্রে ভাল/খারাপ যাই করবেন তা অনেক অনেক মানুষের উপর প্রভাব ফেলবে। কিন্তু প্লেটো জানতেন এই ক্ষেত্রে সুহৃদ এবং বিশ্বস্ত সঙ্গীছাড়া যে কেউ অক্ষম।
তার সেই আগ্রহ বা ক্ষমতাও ছিল না যে অনেক লোককে নিজের মতাদর্শ প্রচারে ব্যবহার করবেন। তো প্লেটো অন্য সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি একটা একাডেমী বানিয়ে সেখানে পড়াতে লাগলেন। প্রথমত প্লেটো এই কাজে দক্ষ এবং শিক্ষার্থীরা হয়ত এক সময় রাষ্ট্রের সমস্যা সমাধানে কাজে আসতে পারবে। পরবর্তীতে আমরা প্লেটোর এই একাডেমী হতে বের হতে দেখি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টোটলকে।
প্লেটো যদি নিজে রাজনীতিবিদ হতে চেষ্টা করতেন, তবে হয়ত মানবজাতি কয়েকশত বছর পিছিয়ে যেত। প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থে সক্রেটিস বলেছেন, যে কোন কাজে সফলতার জন্য পূর্ব শর্ত হল উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা লাভ। তবেই ব্যক্তি সঠিক পথে তার কার্যসম্পাদন করতে পারবে। সুন্দর একটি উদাহরণও দিয়েছেন সক্রেটিস। ধরুন একজন সফল ডাক্তার হবার আগে জানতে হবে “ডাক্তার বলতে কি বোঝাবে”।
যদি ব্যক্তি ডাক্তার বলতে বোঝেন এমন ব্যক্তি যে সফল ভাবে চিকিৎসা করতে পারেন তবে সে তার কাছে আসা গরীব রুগী (যে কিনা ফিস দিতে পারবেনা) অবশ্যই চিকিৎসা করবেন। কারন তিনি বুঝবেন চিকিৎসা দিলে তার অভিজ্ঞতা বাড়বে এবং একজন সফল ডাক্তার হবার পথে তিনি খানিকটা এগিয়ে যাবেন। অন্যদিকে, ব্যক্তি যদি বোঝেন চিকিৎসা করে যিনি অঢেল অর্থ আয় করেন, তিনিই সফল ডাক্তার তবে ঐ গরীব রুগীকে ফিরিয়ে দিবেন। এক্ষেত্রে তার দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে না। অথচ, ঐ ব্যক্তির যদি জীবনের উদ্দেশ্য পরিস্কার থাকত তাহলে সে বিত্তশালী হবার জন্য ব্যবসাকে জীবিকা হিসেবে বেছে নিত।
কারন অর্থ উপার্জনের মূল উপায় হল ব্যবসা।
আমাদের দেশে বর্তমানে এটাই সমস্যা। আমরা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পোষণ করিনা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক থেকে শুরু করে সবাই মনের ভেতর বিত্তশালী ও ক্ষমতাবান হবার চেতনা ধারণ করি। অথচ ধনী হবার সঠিক পন্থা হল ব্যবসা এবং ক্ষমতালাভের উপায় রাজনীতি।
এই দুটির জন্য ঝুঁকি নেবার সাহস লাগে। আমাদের আবার ঝুঁকি নেবার সাহস নেই। যুগ যুগ ধরে মেধাবী অমেধাবী নির্বিশেষে (প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিকোনে) বাঙালি নিরাপদ কর্মসংস্থানের পেছনে ছুটেছে। তাই আমাদের মেধাবীরা হয় উকিল, ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার আর মেধা যাদের কম তারা হয়েছে মাছি মারা কেরানী। তবে যে যার ক্ষেত্র থেকেই পাগলের মত ছুটেছে অর্থের প্রতি।
আবার আমাদের যারা রাজনীতিবিদ তারাও শুধু ক্ষমতায় তুষ্ট নয় এরাও অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটেছেন অর্থের দিকে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বিত্তশালী হয়ে তুষ্ট নয়, তারা নেমেছেন রাজনীতির মাঠে।
মোটের উপর আমরা পাচ্ছি কতগুলো অদক্ষ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ব্যাংকার, নামে মাত্র বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী যারা মূলত সকলেই রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। কিন্তু বানিজ্যিক ও রাজনৈতিক চেতনা অন্য ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর ফলে সব কিছুই নষ্ট হচ্ছে। এই জন্যই দেখাযায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের স্বীকৃত গুনিজন নেই বললেই চলে।
যারা আছেন তাদের বেশির ভাগই মিডিয়ার জোরে নিজেদের আন্তজার্তিক ভাবে স্বীকৃত বলে পরিচিত করেন। আসলে অনেকটাই ফাঁকা বুলি।
এইজন্যই হয়ত আমরা সবাই রাজনীতিবিদ। “আমরা সবাই রাজা আমাদেরই আপন রাজত্বে”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।