আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুবিধা বঞ্চিত নাকি অধিকার বঞ্চিত শিশু? আমাদের স্বপ্ন ও বাস্তবতা

এই ব্লগের সব লেখা কপিরাইট সংরক্ষিত

সুবিধা বঞ্চিত শিশু মানে কি? আমি মনে করি সুবিধা নানা রকম হতে পারে কিন্তু অধিকার নানা রকম হয় না। যেমন স্কুলবাস একটি সুবিধা। এটি সব স্কুলে নাও থাকতে পারে। জেনারেটর একটি সুবিধা। এটিও সব স্কুলে নাও থাকতে পারে।

কিন্ত শিক্ষক, ব্ল্যাকবোর্ড, চক, ডাস্টার, টুল, টেবিল এসব সহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরন থাকতেই হবে। কারন এই বিষয়গুলো অধিকার। সুবিধা বঞ্চিত শিশু এই শব্দটির বদলে আমি বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি অধিকারবঞ্চিত শিশু এই শব্দটিতে। আমাদের সমাজে আমরা নানাভাবে অধিকারবঞ্চিত। এই বঞ্চনা আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে।

ফলে আমরা এখন আর অধিকারহীনতা নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমাদের মস্তিষ্কে সেনসিটাইজেশন নামে একটি প্রক্রিয়া আছে, যার মাধ্যমে একটি ঘটনা বারবার দেখতে বা অনুভব করতে করতে সেই নির্দ্দিষ্ট বিষয়টিতে আমাদের কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। যেমন রাস্তাতে পংগু মানুষ দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অথচ এমন মানুষ কোন উন্নত দেশে রাস্তায় দেখা গেলে তাদের দেশের নাগরিকেরা কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে পড়বেন কারন সেখানে এটা রোজ দেখা যায় না। আমরা আমাদের দেশে এসব দেখে দেখে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে এখন রাস্তায় বিকলাংগ ভিখারী না দেখলেই আমরা অবাক হয়ে যাই।

শিশুদের অধিকারগুলি কি? প্রতিটি শিশুর সঠিক পরিচর্যা ও নিরাপত্তা পাবার অধিকার আছে। তার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে এবং রাষ্ট্র তার জন্য বয়স ও সময়োপযোগী আইন করবে যাতে তার কোন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের জন্য সে অনুপযুক্ত সাজা না পায়। তাকে কোনভাবে শারিরীক, মানসিক বা অন্য কোন রকম নিবর্তন বা নির্যাতনের শিকার হতে দেয়া যাবে না এবং তাকে স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশে বড় হতে দিতে হবে। তার জন্ম নিবন্ধন, মা বাবার সাথে থাকবার সুব্যবস্থা, নিজ ধর্ম বেছে নেয়ার স্বাধীনতা সহ নানা রকম বিষয়াবলী আছে যা শিশুর অধিকারের অন্তর্গত। যে শিশু অধিকার পায় না, তার সুবিধা পাওয়া তো সেকেন্ডারী বা দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয়।

এবার আমাদের দেশের দিকে তাকাই। প্রতিটি শিশুর জন্য নিরাপদ জন্মগ্রহনের ব্যবস্থা আমরা আজো করতে পারি নাই। তাদের জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারি নাই। বিশুদ্ধ আর্সেনিকমুক্ত পানির ব্যবস্থা করতে পারি নাই। তাদের এখনো শ্রম দিতে হয় মাঠে ও কারখানায়।

তাদের জন্য শিক্ষার সুব্যবস্থা করতে পারি নাই যদিও গাল ভরে বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর জন্য বিনা বেতনে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত শিক্ষার কথা আমরা বলি। প্রকৃত চিত্র হ্েচ্ছ, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক নাই, স্কুলঘর নাই, বসার জায়গা নাই এবং এমনও স্কুল আছে যেখানে পালাক্রমে একেক ক্লাসের ছাত্ররা একেকদিন বেঞ্চ ব্যবহার করতে পারে কারন তাদের জন্য বেঞ্চের সংখ্যা অপ্রতুল। অথচ এই দেশে এমন স্কুল আছে যার মাসিক বেতন লক্ষ টাকার কাছাকাছি, সব ক্লাসরুমে এয়ারকুলার আছে, তারা শিক্ষা সফরে সুইজারল্যান্ড যায় এবং প্লে গ্র“পে শিশুদের খেলার জন্য জীবানুমুক্ত মাটি ই্উরোপ থেকে আমদানী করে নিয়ে আসে। এমন স্কুলে আমাদের দেশের বড় বড় মানুষদের ছেলেমেয়েরা পড়ে, যাদের বাবা মা দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা সহ সব বড় বড় বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। অধিকার নিশ্চিত করা একদিনে সম্ভব নয় এটা আমরা সবাই বুঝি।

আমরা দরিদ্র, আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়াতো অসম্ভব নয়। এই পদক্ষেপের মধ্যে প্রথমেই যেটা নেয়া সম্ভব সেটি হলো বৈষম্য দূরীকরন। দেশের একজন শিশু টাকা আছে বলে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করে বিদেমী মাটি ছানবে আর আরেকজন মাটিতে বসে পড়াশোনা করবে, এটা অপরাধ। কারন আমাদের সংবিধানে সবার জন্য সমান অধিকারের কথা নিশ্চিত করার কথা বলা অঅছে এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথাও বলা আছে।

রাষ্ট্র একদিকে সমতার কথা বলে আবার একই দেশে নানা রকম শিক্ষা ব্যবস্থা, নানা রকম শিক্ষা সুবিধা এবং বড়লোক ও গরীব এর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী বিষয়গুলিকে জিইয়ে রাখে। আমরা অধিকার আর সুবিধাকে এক করে দেখতে গিয়ে কোন বিশেষ সুবিধা তৈরী করলে তাতে অধিকার অর্জিত হয়েছে বলে মনে করি। এক বেলা এতিমখানাতে বিশেষ খাবার দিয়ে ভাবি সারা বছরের দায়িত্ত্ব শেষ। আমাদের দেশে এতিম শিশুর জন্য বিশেষ কোন সুবিধা কিন্তু আমরা দিতে পারি নাই। কোন অভিভাবকহীন শিশুর আশ্রয়স্থলকে এতিম খানা আর লিল্লাহ বোর্ডিং নাম দিয়ে বিশেষায়িত করেছি তাদের দুরবস্থাকে।

পথশিশু, পথকলি নাকি টোকাই এই নামকরন বিতর্কে ব্যস্ত থেকেছি কিন্ত তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন করি নাই। হাসপাতালে দরিদ্রদের ফ্রি চিকিৎসার জন্য অস্থির হয়ে যাই আমরা। অথচ নামকরা স্কুলগলিতে কেন প্রতি ক্লাসে এরকম হতদরিদ্র অন্তত দুজনকে পড়ানোর চেষ্টা করি না। ঢাকা শহরে অনেক স্কুল আছে যেখানে হাজার হাজার টাকা বেতন নেয়া হয়। সামাজিক দায়িত্ত্বের অংশ হিসেবে তারা কি পারেন না অন্তত দুটি করে, দশটি শ্রেনীতে বিশজন শিশুকে পড়াতে।

স্বাভাবিক শিশুদের বেলাতেই আমরা এমন নির্দয়। যেসব শিশু প্রতিবন্ধি, অটিস্টিক, তাদের জন্য আমাদের চিন্তাতেই কোন স্থান নেই। ঢাকা শহরে এতো সুপার মার্কেট, সেগুলোতে কোন র‌্যাম্প নেই, নেই হুইল চেয়ার বা অন্ধদের জন্য সুব্যবস্থা। আমাদের কোন পাবলিক প্লেসে এমন কোন বাথরুম নেই যেখানে মায়েরা শিশুর ন্যাপি বা ডায়াপার বদলাতে পারেন। অটিস্টিক বাচ্চাদের জন্য ভালো স্কুল নেই।

সরকারী কোন ব্যয়বরাদ্দ নেই। ঢাকা শহরে শিশুদের খেলার জন্য কোন মাঠ নেই। যেখানে রাজধানীর শিশুদের এই অবস্থা, সেখানে ঢাকার বাইরের শিশুদের কি অবস্থা সেটাতো বোঝাআ যায়। জিপিএ ৫ পেলেই সকল সমস্যার সমাধান হবে ভেবে যারা গোঁেফ তা দিচ্ছেন, তারা জানেন না, খেলাধুলাহীন এই বিদ্যানদের শরীর ভেংগে পড়বে ৪০ বছরেই। এর নমুনা আমরা এখনই দেখতে পাচ্ছি।

অল্প বয়সে হার্ট অ্যটাক এখন অতিপরিচিত ঘটনা। এসবের সমাধান কি? আমরা ভাবি সমাধান কেবল টাকা দিয়ে অর্জন করা সম্ভব। প্রথমে যা চাই সেটি হলো সদিচ্ছা। তারপর চাই স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহন। সারা দেশে যতগুলি অভিজাত স্কুল আছে তারা সবাই ২০ জন করে ছাত্র বিনা বেতনে পড়ালে সংখ্যাটি কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায়।

যদি ঠিক করি প্রতিটি স্বচ্ছল পরিবার অন্তত একজন অধিকারবঞ্চিত শিশুর দায়িত্ত্ব নেব, তাহলে অন্তত ১০ লক্ষ শিশুর সংস্থান হয়ে যায়। সামাজিক উদ্যোগ ছাড়া কখনো অধিকার অর্জন করা যায় না। অধিকার কোন চাপিয়ে দেয়া বা বইতে লেখা দুর্বোধ্য শব্দাবলী নয়। আচরনের মধ্য দিয়েই সমাজে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়। তাই আমাকে যখন উনাইজার বা কারিশমার মতো ভব্যিষতের কোন আলোকিত শিশু লিখতে বলে শিশুদের নিয়ে, আমি বুঝি যে আমাদের সমাজ নাহয় উটপাখীর মতো বালিতে মুখ গুঁজে বসে আছে, তাই বলে আমরা তো বসে নেই।

শিশুরাই আজ ভাবছে শিশুদের নিয়ে। কঠিন চর্বিত চর্বনের বিতর্ক না করে , তারা বিতর্কের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছে নিজেদের ভবিষ্যতকে। এতো প্রতিক’লতার মধ্যেও তারা যান্ত্রিক অমানবিক হৃদয়ের মানুষ না হয়ে, মানুষের মতো মানুষ হতে চলেছে। পনেরো কোটি মানুষের এই দেশটকে বদলে দিতে চাই শুধুমাত্র সংকল্প। শিশুদের অধিকার অর্জনের জন্য সভা সমিতি সেমিনার শুধু নয়, চাই উদ্যোগ।

নিজের ভাই বোনকে অধিকার বঞ্চিত রেখে দারিদ্রকে যতই জাদুঘরে পাঠাই আর সুশাসন, গণতন্ত্র নিয়ে যতো বুলি কপচাই না কেন, সভ্য সমাজের সভ্য হয়ে ওঠার জন্য চাই সভ্য আচরন। শেরাটন হোটেলের ভেতরে ইউনিসেফের অফিস কম্পাউন্ড ,বাইরে ফুল বিক্রেতার কাজ করবে শিশুরা আর ভেতরে আমরা শিশূশ্রম নিয়ে কথা বলবো, কি বিকৃত এই বৈপরীত্য। আমি জানি অনেকেই বলবেন আমি একটু মেজাজ গরম করে এই লেখাটি লিখছি। ছোটবেলায় মা যখন চুল আচড়ে দেন,তখন থুতনিটা জেরে ধরে নেন যাতে আমরা মাথা না নাড়ি। সমাজের সেই থুতনী ধরার মানুষ যারা, তারা সমাজের মাথা, বুদ্ধিজীবি, নেতা, রাজনীতিবিদ।

তারা এখন আর সে কাজটি করছেন না। ফলে সমাজের মাথা নড়ছে প্রবল অনাচারে। কাউকে না কাউকে সেই কাজটি করতেই হবে। আমরা না পারলে কি হবে, আগামী দিনের মানুষেরা এ কাজটি করতে প্রস্তুত এখন। আমাদের চুপ করে থাকার কৈফিয়ত দিতে হবে তাদের কাছে।

আমরা যদি কথা না বলি, তবে একদিন যখন আগামী প্রজন্ম প্রশ্ন করবে কেন চুপ করেছিলাম আমরা, তখন মাথা নিচু করে আবারো চুপ করে থাকতে হবে আমাদের। আমি সেই চুপকরা নির্বাকদের দলে থাকতে চাই না। আসুন আমরা কথা বলি। আমরা আমাদের অধিকারের কাথা বলি। আমরা আগামী দিনের স্বপ্নের কথা বলি।

আমরা আমাদের আশা আর ভালোবাসার কথা বলি। আমরা সেই দিনের কথা বলি, যেদিনকে কাছে আনবেন বলে ৭১ সালে প্রান দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় মানুষেরা। নীরব, পাষান এই পৃথিবীতে শিশুদের জন্য ভালোবাসার উষ্ণ প্রস্রবন তৈরী হোক। আজকের শিশু বেড়ে উঠুক আগামী দিনের ভালোবাসায়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.