আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একুশ আগষ্টের মুল পরিকল্পনাকারীরা চিহ্নিত হয়ে শাস্তি পাবে কী?



জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার শ্রবণশক্তি লোপ পেয়েছে। চোখেও কম দেখতে পাচ্ছেন তিনি। তিনি তাঁর বাম কানে আর কোনদিন শুনতে পাবেন না। চার বছর আগে গ্রেনেড হামলায় বঙ্গবন্ধু কন্যার দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তির ক্ষতি হয়। এই ক্ষতি আরও বড় আকার নেয় ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই হতে চলতি ২০০৮ সালের ১১ জুন পর্যন্ত কথিত অভিযোগে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি থাকাকালে সুচিকিৎসা না পাবার কারণে।

শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এই উদ্বেগজনক তথ্য জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসুরী, বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্খার একমাত্র প্রদীপ শেখ হাসিনাকে গত বছরের ১৬ জুলাই গ্রেফতার করা হয়। কোন রকমের গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়াই সাবেক সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যৌথ বাহিনী গ্রেফতার করে ধানমন্ডির সুধাসদন থেকে। গ্রেফতারের সময় একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে তত্ত¡াধায়ক সরকার। শেখ হাসিনার সুচিকিৎসার জন্য তাঁর মুক্তির দাবিতে দেশ-বিদেশে সর্বস্তরের মানুষের আন্দোলন যখন জোরদার হচ্ছিল ঠিক তখনই তা আঁচ করতে পেরে সরকার তাঁকে মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রায় ১১ মাসের বন্দিজীবন শেষে সরকারের নির্বাহী আদেশে গত ১১ জুন বিশেষ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। বর্তমানে তিনি চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় রয়েছেন। শেখ হাসিনার চিকিৎসার জন্য আরও কিছুদিন সময় লাগবে বলে তাঁর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর সহায়তায় ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দকে শেষ করে দেয়া।

সেদিনের হামলায় শেখ হাসিনাসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হয়েছেন সাহসী নারী নেত্রী মিসেস আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতা-কর্মী। ওই হামলায় অন্ত:ত ৩০০ আওয়ামী লীগ নেতা-কমী আহত হয়েছিলেন। হামলার দুঃসহ স্মৃতি আর শারীরিক প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে বেঁচে আছেন অনেকে। বহু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনতা এখনও শরীরে বহন করে নিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রেনেডের স্পি­ন্টার। সারাদেশে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট বিকেলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ এক সমাবেশের আয়োজন করে।

বিকেল চারটায় মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মোহাম্মদ হানিফের (পরবর্তীতে তিনি মারা যান) সভাপতিত্বে পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশের পর ছিল বোমা হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচী। বিকেল সাড়ে চারটার মধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান বিকেল পাঁচটায়। একটি ট্রাকের ওপর তৈরী মঞ্চে তিনি কুড়ি মিনিটের বক্তৃতা শেষে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করার ঘোষণা দেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসতে থাকেন। ওইসময় সেদিন ঘটনাস্থলে পেশাগত দায়িত্বপালনরত কয়েকজন ফটো সাংবাদিক শেখ হাসিনার কয়েকটি ছবি তোলার জন্য তাঁকে মঞ্চেই থামিয়ে দেন বলে জানা যায়। ঠিক এমন সময় শুরু হয় মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা। দক্ষিণ দিক থেকে নিক্ষেপিত একটি গ্রেনেড মঞ্চের পাশে রাস্তার ওপর পড়ে প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড।

এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরও ১০ জন নিহত হন। এই নজিরবিহীন হামলায় আইভি রহমান ছাড়াও দেশরতœ শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন শেখ হাসিনার নিরাপত্তারক্ষী মাহবুব। ভাগ্যিস সেদিন ফটো সাংবাদিকদের কয়েকজন ক্যামেরায় ফটো ধারণের জন্য শেখ হাসিনাকে মঞ্চেই থামিয়ে দিয়েছিলেন। নাহলে হয়তবা শেখ হাসিনা সেদিন ঘটনাস্থলেই মারা যেতে পারতেন। কারণ হামলাকারীদের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন যেহেতু তিনিই (শেখ হাসিনা)।

সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিপুল সংখ্যক পুলিশ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ও আশপাশের বিভিন্ন ভবনের ছাদেও সাদা পোশাকে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন বেশ কিছু সংখ্যক পুলিশ। এছাড়াও ছিল বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বহু কর্মী। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীরাও সমাবেশস্থলের চারপাশে অবস্থান করছিলেন। গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর পরই ইন্টারপোল, এফবিআইসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বহু কর্মকর্তা আসেন বাংলাদেশে।

তাদের তদন্ত বা অনুসন্ধান রিপোর্ট আজও আলোর মুখ দেখেনি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও ওই সরকারের প্যারালাল সরকার বলে পরিচিত হাওয়া ভবনের নিয়ন্ত্রণাধীন দেশী বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকেও চলতে থাকে গ্রেনেড হামলার ঘটনার তদন্ত। পরবর্তীতে জোট সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ি করার অপতৎপরতা চালাতে থাকে। ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার পর মতিঝিল থানায় একটি মামলা করা হয়। মতিঝিল থানার (তৎকালীন) এসআই মো. আমির হোসেন ২০০৪ সালের ২২ আগষ্ট থেকে ২৩ আগষ্ট পর্যন্ত মামলার তদন্ত করেন।

পরে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি)। ডিবি তদন্ত শুরু করতে না করতেই আবার তদন্তভার পরিবর্তন করে দেয়া হয় সিআইডির ওপর। সিআইডির এএসপি আবদুর রশিদ ২০০৪ সালের ২৩ আগষ্ট থেকে ২০০৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত করেন। এরপর তদন্তভার দেয়া হয় সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানের ওপর। সিআইডিকে মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয়ার পরপর সিআইডি ঢাকা মেট্রোনের সাবেক এসএস রুহুল আমিন মামলাটির তদারকির দায়িত্ব পান।

তিনি জনগুরুত্বপূর্ণ এই মামলার বিষয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়সহ সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করেছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজায়। জজ মিয়া নাটক সাজানোর ঘটনায় জড়িত সিআইডির সাবেক কর্মকর্তা এসএস রুহুল আমিন, এএসপি মুন্সি আতিক ও আবদুর রশিদ। পুলিশ ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ এলাকার একটি চায়ের দোকান থেকে জজ মিয়াকে গ্রেফতার করে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে। পরে ঢাকা থেকে সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন ও তার টিমের সহযোগিরা গিয়ে জজ মিয়াকে চোখ বেঁধে ঢাকায় নিয়ে আসেন।

ঢাকা সিআইডি অফিসে জজ মিয়াকে দফায় দফায় নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ করে তার কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়। ২০০৫ সালের ২৬ জুন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে জজ মিয়াকে দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করান সিআইডির কর্মকর্তারা। সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা জজ মিয়ার স্বীকারোক্তিতে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, তানভীরুল ইসলাম জয়, লিংকন, রবিনসহ ৬ জনের নাম উল্লেখ করানো হয়। জজ মিয়ার এ স্বীকারোক্তি জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সিআইডির ওই সময়ের কর্মকর্তারা জজ মিয়া নাটক ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে জজ মিয়ার পরিবারকে মাসিক ৫ হাজার টাকা করে দিয়েছে।

জজ মিয়াকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে খুশি রাখতেই গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করে সিআইডি। চাঞ্চল্যকর বহুল আলোচিত এ মামলায় নিরপরাধ জজ মিয়াসহ ২০জনকে সিআইডি আটক করে নানাভাবে হয়রানি, নির্যাতন করে। জোট সরকারের সময়ে সিআইডির তদন্ত চলাকালে রহস্যজনক কারণে নিরীহ জজ মিয়া, শৈবাল সাহা পার্থ, হাবিব, বাদশা মিয়া, আবদুর রহমান, মো. হাছান, জহির হোসেন ওরফে লিটন, মনির, আইয়ুব, মোখলেসুর রহমান, মঞ্জুর হোসেন, আবুল হাশেম রানা, শফিকুল ইসলাম, শাহ আলমসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে জজ মিয়া, আবুল হাশেম রানা, শফিকুল ইসলামের কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়।

পুলিশের বর্তমান আইজি নূর মোহাম্মদের বক্তব্যেও গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তে বিএনপি-জামায়ত জোট সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের বিষয়টি পরিস্কার হয়েছে। আইজিপি বলেন, আগে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারার জন্য মামলার তদন্তে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলার তদন্তে সংকট সৃষ্টি করেছে এবং যারা মামলা নষ্ট করতে চেয়েছে এবং নিরপরাধীদের হয়রানি করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে (সূত্র : সংবাদ, ১৪ জুন, ২০০৮)। বর্তমান তত্ত¡াবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত বছরের ৫ জুন কক্সবাজার জেলার চকোরিয়া থানার আলহাজ্ব বদর আজিজউদ্দিন ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি পিটিশন মামলা দায়ের করেন ২১ আগষ্টের হামলার ঘটনায়। ওই এজাহারে ২১ আগষ্টের হামলার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, মন্ত্রী ও জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান, বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস, মোসাদ্দেক আলী ফালু, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, বরকতউল্যাহ ভুলু, আমানউল্যাহ আমান, খোদা বক্স চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, তকালীন পুলিশ কর্মকর্তা মোদাব্বির হোসেনসহ ২৮জনকে অভিযুক্ত করা হয়।

আদালত অভিযোগের বিষয়ে পল্টন থানার ওসিকে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু দীর্ঘদিন এ ব্যাপারে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতে এ ব্যাপারে সিআইডি নড়েচড়ে বসলেও শেষ পর্যন্ত তদন্তে অভিযুক্তরা জড়িত কিনা সে ব্যাপারে পরিস্কার কোন বক্তব্য জানা যায়নি। গত ১১ জুন ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা হামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। চার্জশিটে জোট সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাত-উল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেটের আদালতে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মতিঝিল থানায় দায়ের করা পৃথক দুইটি মামলার চার্জশিট দাখিল করে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। চার্জশিট দাখিলের পর সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তে ২৮ জনের নাম পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে সঠিক তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় চার্জশিট দেয়া হয় ৬ জনকে বাদ দিয়ে। চার্জশিটভুক্ত ২২ জনের মধ্যে কারাগারে বন্দি ১৪ জন হলো জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ছোট ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, নিষিদ্ধ হরকাত-উল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, তার ভাই মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু তাহের, শরিফ শহিদুল ইসলাম ওরফে বিপুল, মাওলানা আবু সায়ীদ ওরফে ডাক্তার আবু জাফর, আবুল কালাম বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, জুয়েল, হোসাইন আহমেদ ওরফে তামিম, মুফতি মঈন ওরফে আবু জান্দাল, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, উজ্জ্বল ওরফে রতন। বাকি ৮ জন পলাতক রয়েছে।

জোট আমলে আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলা, হত্যা-নির্যাতন, লুটতরাজ, ধর্ষণ, নারী লাঞ্ছনা সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল। রাষ্ট্র পরিচালনায় তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন হাওয়া ভবন হয়ে উঠেছিল সকল পরিকল্পনার একমাত্র কেন্দ্র। অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সর্বক্ষেত্রেই বিএনপি-জামায়াত জোটের সর্বগ্রাসী তান্ডবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন দেশের মানুষ। গোটা দেশটাকে জঙ্গিদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল জোট সরকার। এসবের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ব্যাপক গণআন্দোলন।

জননেত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার করে তুলেছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে জনগণের আস্থা হারিয়েছিল জোট সরকার। আর তাই শেখ হাসিনা জোট সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হন। দেশের মানুষ জোট সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হবে না।

সামগ্রিক কর্মকান্ডের কারণে সাধারণ জনগণ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ওপর এতটাই বিক্ষুব্ধ ছিলেন যে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে পুনরায় তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার কোনই সম্ভাবনা ছিল না। তাছাড়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় বসতে পারলে একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু ও পঁচাত্তরের খুনিদের বিচারের রায় কার্যকর হতো। সবমিলিয়ে শেখ হাসিনা আতংকের প্রতিক হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশ বিরোধীদের কাছে। তাই তাঁকেই শেষ করতে হবে আগে। এসব রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকেই শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় বলে জনমনে আলোচনা চলছে।

আলোচিত ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার বিচার কার্য চলছে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। মামলার অন্যতম অভিযুক্ত আবদুস সালাম পিন্টু গত ২২ জুলাই আদালতকে বলেন, ‘মুফতি হান্নান আমার বাসায় গিয়েছিল। সেখানে আমার ভাই তাদের আপ্যায়ন করেছে। আবু জান্দাল, াাবু তাহের ও কাজলও ছিল সেখানে। কিন্তু মুফতি হান্নান ব্যতিত অন্যরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আমার নাম বলেনি।

’ প্রধান অভিযুক্ত মুফতি হান্নান আদালতকে বলেন, ‘আমাকে নির্যাতন করে পুলিশ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করেছে। সেই নির্যাতনের কথা আমি লিখিতভাবে আদালতে বলতে চাই। আমি কাগজ-কলম চাই, আমাকে সুযোগ দেয়া হোক। ’ একইদিনে চার্জশিটভুক্ত আরেক আসামি আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল আদালতকে বলেন, ‘আমি দর্জির ব্যবসা করি। আমাকে ধরে এনে নির্যাতন করা হয়েছে।

জীবননাশের হুমকি দিয়েছে, ক্রসফায়ার করে হত্যা করবে যদি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি না দেই। আমি জবানবন্দি প্রত্যাহার করে নেব। আমার কোন আইনজীবী নেই। ’ (সূত্র-সংবাদ, ২৩ জুলাই, ২০০৮)। প্রকাশ্য আদালতে উপস্থাপিত আসামিদের উপরোক্ত বক্তব্য সত্য কি মিথ্যা তা আমরা কেউই জানি না।

হতে পারে আসামিরা বাঁচার জন্য এমন বক্তব্য দিচ্ছেন। আবার এই বক্তব্যগুলো যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে বলতে হয়, ২১ আগষ্টের হামলার ঘটনার প্রকৃত পরিকল্পনাকারী-গডফাদারদের বাঁচাতেই তদন্ত কাজে জড়িত কর্মকর্তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করতে বাধ্য করেছেন। কারণ আমরা জানি ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু থেকেই জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। ‘জজ মিয়া কাহিনী’ নিশ্চয়ই সবার জানা আছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানদেরকে দিয়ে ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলেন কার স্বার্থে? শেখ হাসিনাকে শেষ করে দিতে পারলে লাভবান হতো কে বেশি? এসব প্রশ্ন এখন সবার মধ্যে আলোচিত হচ্ছে।

দেশের মানুষ মনে করেন না যে, ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা শুধুমাত্র জঙ্গিদের নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। তারা মনে করেন, এর পেছনে ছিল একটি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক পরিকল্পনা। ২১ আগষ্টের গণহত্যার মত একটি পৈশাচিক বর্বরোচিত হামলার ঘটনার বিষয়ে কক্সবাজারের চকোরিয়ার আলহাজ্ব বদর আজিজউদ্দিন আদালতে যে পিটিশন কেসটি করেছিলেন সেই অভিযোগের সূত্র ধরে কেন বেগম জিয়া, তারেক, নিজামী, বাবুর ও মুজাহিদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতো। কিন্তু তা করা হয়নি। এটা কার স্বার্থে করা হলো না তা দেশবাসি জানতে চান।

দেশবাসি এটাও মনে করেন যে, ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার দায় কোনভাবেই এড়াতে পারে না বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। কারণ তৎকালীন জোট সরকারের দায়িত্বশীর ব্যক্তিরা এই হামলার ঘটনা নিয়ে নানাধরনের উপহাসমূলক আচরণ করেছে। দেশের মানুষ তা ভুলে যাননি। দেশের মানুষের কাছে একটা বিষয় দিবালোকের মত পরিস্কার তা হলো আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দকে একযোগে হত্যা করার জন্যই ২১ আগষ্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছে। আর সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ ছাড়া এতবড় একটা হামলা চালানো সম্ভব ছিল না কারও পক্ষে।

ফলে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ তথা জোট সরকার ২১ আগষ্টের হামলার নৈতিক দায় এড়াতে পারেন না কোনভাবেই। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার নেপথ্যের কারিগর-গডফাদারদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। একইসাথে এই ঘটনার তদন্ত কাজে যারা গাফিলতি-দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও শঠতার আশ্রয় নিয়ে সরকারি অর্থের অপচয় ঘটিয়েছেন তাদেরও চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। সুতরাং উচ্চ পর্যায়ের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ মাধ্যমে ২১ আগষ্টের হামলার ঘটনার পুন:তদন্ত করা হোক। খুঁজে বের করা হোক এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডের উৎস।

অন্যথায় এমন হামলার মাধ্যমে হত্যা-ধ্বংসযঞ্জের ঘটনা বন্ধ হবে না কখনও।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।