লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। মানবজীবন অতি মূল্যবান
মোহাম্মদ ইসহাক খান
গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন বিশিষ্ট এবং বরেণ্য বক্তা, সময়ের সাহসী চরিত্র চৌধুরী রইসুল ইসলাম। তাঁর প্রচণ্ড জ্বালাময়ী বক্তৃতার তোড়ে মনে হচ্ছে সামনে উপবিষ্ট লোকগুলো উড়ে চলে যাবেন, এবং দুর্বল মাইকটি আর সহ্য করতে না পেরে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।
গমগম করছে ছোট্ট মিলনায়তন, প্রতিধ্বনি হচ্ছে বলে একটা মুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। খানিকক্ষণ এই পরিবেশে বসে থাকলে মাথা ঝিমঝিম করে এবং রক্তের মধ্যে বিপ্লব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার ক্ষীণ আভাস পাওয়া যায়।
অবশ্য এমন কিছু ঘটছে না। মাইকটা চিঁ চিঁ শব্দ করলেও এখনো ফেটে যায় নি, আর রইসুল ইসলামের মুখ-নিঃসৃত থুথু সামনের মানুষগুলোকে খানিকটা ভিজিয়ে দেয়া ছাড়া আর আপত্তিকর কিছু ঘটেনি।
গগনবিদারী কণ্ঠে তিনি নিজের বক্তব্যের বিষয়টি সবার মর্মে ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করছেন।
এজন্য শুধু তাঁর দরাজ গলার আওয়াজই নয়, ঘুষি পাকিয়ে কাল্পনিক প্রতিপক্ষের প্রতি মুষ্ট্যাঘাত হানা, টেবিলের ওপর সজোরে কিল মারা ইত্যাদি পদ্ধতিও ব্যবহার করছেন তিনি।
দীর্ঘক্ষণ ধরে একই কথা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলে চলেছেন তিনি। সামান্য একটা কথাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, ফেনিয়ে-ফেটিয়ে, রবারের মতো টেনে লম্বা করতে করতে পুরো এক ঘণ্টা পার করেছেন। সবটুকু শুনতে হয়তো ভাল লাগবে না, তাই তাঁর বক্তৃতার শেষের দিকের "চুম্বক অংশ" তুলে দেয়া হল।
"... ... মানবজীবন কি এতই সস্তা? এতই মূল্যহীন? এটা নিয়ে কি আমাদের কারোই মাথাব্যথা নেই? গার্মেন্টসে শ্রমিকরা পুড়ে মরছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন শ'য়ে শ'য়ে মানুষ মরছে, আরও নানা অসুখবিসুখে কুকুর-বেড়ালের মতো মানুষ মরছে।
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের জীবনের এই নিদারুণ অপচয় তো আর সহ্য করা যায় না। ভাইয়েরা আমার! আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে, আর একটিও অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আমরা মেনে নেবো না। এর জন্য দায়ী ব্যক্তি, তা সে যেই হোন না কেন, তাঁকে অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মানবজীবনের মূল্য সবাইকে বুঝিয়ে তবেই আমরা ক্ষান্ত হবো, তার আগে নয়।
সম্মানিত সুধী! আমি আপনাদের অনেক সময় নষ্ট করেছি, আর নয়। এবার আমি থামছি। আপনারা সুখী, সুন্দর, নিরাপদ জীবন যাপন করবেন, এবং আমাদের এই আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকবেন, এই আশাবাদ ব্যক্ত করে আমার আজকের বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। "
চৌধুরী রইসুল ইসলামের বক্তৃতা শেষ হওয়া মাত্রই ঝিমিয়ে পড়া, ঘুমিয়ে পড়া এবং বিরক্ত হয়ে ক্রমাগত হাই তুলতে থাকা লোকগুলোর ওপর একটা ঢেউ খেলে গেল, তাঁরা মিলনায়তন কাঁপিয়ে সজোরে হাততালি দিতে লাগলেন এবং এই সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠলো যে, এর কাঁচের জানালাগুলো বুঝি এবার ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়বে। এখুনি থরথর করে কাঁপছে জানালাগুলো।
চৌধুরী রইসুল ইসলাম ঘর্মাক্ত শরীরে, রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে গাড়িতে উঠে বসলেন। আজ আর কোন কাজ নেই, তিনি এখন বাসায় ফিরে বিশ্রাম করবেন।
*****
দরজার নিচ দিয়ে খবরের কাগজ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে হকার। প্রথম পাতার এক কোণে একটা ছোট্ট খবর আছে। হেডলাইনঃ সড়ক দুর্ঘটনায় বিশিষ্ট বক্তা, সমাজসেবী এবং কলাম লেখক চৌধুরী রইসুল ইসলামের মৃত্যু।
বরেণ্য বক্তার একটি পাসপোর্ট সাইজ ছবির নিচে কালো ব্যাজের ছবি, শোকের চিহ্নস্বরূপ। তারও নিচে রিপোর্টার লিখেছেন, "নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। 'মানবজীবন অতি মূল্যবান, দু'পয়সার নয়' শীর্ষক বক্তৃতা দিয়ে বাড়িতে ফেরার পথেই ঘাতক বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে মারা গেলেন গুণী বক্তা চৌধুরী রইসুল ইসলাম। আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলেন, মানবজীবন আজকের দিনে দু'পয়সারই হয়ে পড়েছে। খ্যাতনামা এই ব্যক্তির মৃত্যুতে বিভিন্ন মহল গভীর শোক প্রকাশ করেছে ... ..."
(১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।