বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় সংস্কৃতির জন্য অপমানজনক কোনকিছু এই ব্লগে লেখা যাবে না।
১ম পর্বের লিংক
২য় পর্বের লিংক
৩য় পর্বের লিংক
৪র্থ পর্বের লিংক
১৯৫২ পরবর্তী ঘটনাবলী
সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ আওয়ামী লীগ এর সমর্থনে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই আন্দোলনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ’৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারীর ক্ষতিগ্রস্থদের প্রতি সংহতি জানিয়ে কালো ব্যাজ ধারণ করে। অধিকাংশ অফিস, ব্যাংক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিবসটি পালন উপলক্ষে বন্ধ ছিল। ছাত্ররা কলেজ এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় চুক্তিবদ্ধ হয়।
ঢাকার আর্মানিটোলার একটি জনসমাবেশে ১ লক্ষেরও বেশী লোকের সমাগম হয়, যেখানে নেতারা মওলানা ভাসানী সহ অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দাবী করেন। যাই হোক, পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদরা বিশেষ করে ফজলুর রহমানের “বাংলাকে যে-ই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দেখতে চায়, সে রাষ্ট্রদোহী হিসেবে চিহ্নিত হবে” – এই ঘোষণায় জাতিতাত্ত্বিক দ্বন্দ প্রকট হয়ে ওঠে। বাঙ্গালী ছাত্র এবং সাধারণ জনতা আন্দোলনের বর্ষপূর্তি উদযাপনের নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে। ১৯৫৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে কালো পতাকা উত্তোলন করে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। পুলিশ ছাত্র এবং অন্যান্য প্রতিবাদকারীদের গ্রেফতার করে, যাদের পরবর্তীতে জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পরেও মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট
১৯৫৪ সালের কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচনে রাজনৈতিক উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট জোটের বিরোধিতা করে, এই যুক্তফ্রন্ট এর নেতা ছিলেন এ.কে.ফজলুল হক এবং আওয়ামী লীগ, যার উদ্দ্যেশ্য ছিল বৃহত্তর কেন্দ্রীয় স্বায়ত্ত্বশাসন। অনেক যুক্তফ্রন্ট নেতা ও কর্মী গ্রেফতার হন। পার্লামেন্টের মুসলিম লীগ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বোগরার নেতৃত্বে একটি সভায় মিলিত হন, এই সভায় বাংলাকে সরকারী স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্ত চরম জাতিতাত্ত্বিক অসন্তোষের জন্ম দেয়, কারণ অন্যান্য অঞ্চলের জনসাধারণও তাদের আঞ্চলিক ভাষার স্বীকৃতি দাবী করে।
মৌলভী আবদুল হক এর মত উর্দু সমর্থকরা বাংলাকে সরকারী স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাবের চরম বিরোধিতা করেন। তিনি মুসলিম লীগের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১ লক্ষাধিক লোকের একটি র্যালিতে নেতৃত্ব দেন। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ব্যর্থ হয় এবং যুক্তফ্রন্ট কেন্দ্রীয় পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, মুসলিম লীগের প্রতিনিধিত্ব ঐতিহাসিকভাবে কমে যায়।
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রনালয় বাংলা ভাষার উন্নয়ন এবং বাংলা ভাষা,সাহিত্য এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে বাংলা একাডেমী গঠন করার নির্দেশ দেয়। যুক্তফ্রন্টের এই আদেশ ছিল ক্ষণস্থায়ী, কারণ গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল ঘোষণা করেন এবং ১৯৫৪ সালের ৩০শে মে গভর্নরের অধীনে শাসনব্যবস্থা চালু করেন।
গভর্নরের শাসনামল শেষ হওয়ার পর যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৫ সালের ৬ই জুন পুনরায় মন্ত্রনালয় গঠন করে। যদিও আওয়ামী লীগ এই মন্ত্রনালয়ে অংশগ্রহণ করেনি।
যুক্তফ্রন্টের পুনরায় ক্ষমতায় আরোহণের পর ১৯৫৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রথমবারের মত শান্তিপূর্ণভাবে শহীদ দিবস পালিত হয়। সরকার নতুন শহীদ মিনার নির্মানের একটি বিশাল পরিকল্পনায় সমর্থন প্রদান করে। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পুলিশের গুলিবর্ষণে আহত এবং নিহতদের স্মরণে পাঁচ মিনিটের নীরবতা পালন করা হয়।
বাঙ্গালী নেতাদের আয়োজনে বিরাট র্যালি অনুষ্ঠিত হয় সকল সরকারি অফিস এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
সংবিধান সংশোধন
১৯৫৪ সালের ৭ই মে কেন্দ্রীয় পরিষদের অধিবেষণে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারী বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং পাকিস্তানের সংবিধানের ২১৪(১) ধারাটি নতুনভাবে লিখিত হয়, “ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু এবং বাংলা। ” যাই হোক, আইয়ুব খানের সামরিক সরকার উর্দুকে পুনরায় একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৫৯ সালের ৬ই জানুয়ারী সামরিক সরকার একটি বিবৃতি দেয় যেখানে ১৯৫৬ সালের সংবিধানের দুটি রাষ্ট্রভাষার নীতিকে সমর্থন জানিয়ে সরকারী অবস্থানকে পুনর্বহাল করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা
যদিও রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটির ১৯৫৬ সালেই সমাধান হয়ে গিয়েছিল, তারপরও আইয়ুব খানের সামরিক সরকার বাঙ্গালী স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে পাঞ্জাবী এবং পশতুন সম্প্রদায়ের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। জাতীয় জনসংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বেসামরিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে বাঙ্গালীরা সুবিধাবঞ্চিত হতে থাকে এবং সংখ্যালঘু রাষ্ট্র হিসেবে অর্থ এবং অন্যান্য সরকারী সুযোগ পেতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানে ক্রমাগত জাতিগত অবমূ্ল্যায়নের কারণে বাঙ্গালীরা বিভক্ত হয়ে পড়ল। এর ফলে জাতিগত বিভক্তি বেড়ে গেল এবং ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে জাগ্রতকারী আওয়ামী লীগ বৃহত্তর স্বায়ত্বশাসন এবং গণতন্ত্রের জন্য ছয় দফা আন্দোলনের সূচনা করে। ছয় দফা দাবীর অন্যতম দাবী ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামে অভিহিত করা হোক।
এই দাবী পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।