অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
রাবেয়া যখন বুঝতে পারলো তখন অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। সামনে পুকুর, সেখানে লাফ দিয়ে লুকিয়ে থাকা যায়, কিংবা পাতলা হয়ে আসা মানকচুর ঝোপ, সেখানে বড় বড় পাতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখা যায়, সবার মতো সেও দৌড় দিয়েছিলো, অন্তঃসত্তা রাবেয়া দৌড়ে পালাতে পারে নি সময় মতো। ৬ মাসের পোয়াতি রাবেয়া পুকুরের পাশে এসে থমকে দাঁড়ায়।
বাসা এবং তার জীবন তছনছ করে যখন ওরা চলে গেলো রাবেয়া তখন চলৎশক্তিহীন একটা জড় পদার্থ। মাটিতে বসে গোঙাচ্ছে পাগলের মতো।
শরীরে শক্তি নেই, শাড়ীর অবশিষ্ঠাংশ তুলে গায়ে দিয়ে শরীরের আঁচরের দাগ দেখে মুর্ছা গেলো।
আবার যখন জ্ঞান ফিরলো রাবেয়ার তখন সন্ধ্যা হয় হয়। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাসার আগুন নিভেছে তবে শরীরের জ্বলুনী কমে নি একবিন্দুও। আঁচড়ে ছিড়ে ফেলা জায়গাগুলো এখনও জ্বলছে, মাটির প্রলেপ নেই, ঠোঁট ফুলে গেছে, গালের এক পাশ টনটন করছে ব্যাথায়।
দুপুরে যা করতে পারে নি, তাই করলো এখন। পুকুরে গিয়ে ডুব দিলো একটা। দুনিয়া অন্ধকার করা ব্যথায় অবশ হয়ে গেলো দেহ। তলপেটে ভীষন মোচড়। পুকুরের পানিতে লাল রক্তের আভাস।
নিজেকে হালকা লাগছে তার। পানির উপরে ভেসে উঠেছে একটা অপূর্ণ শিশুর অবয়ব। রাবেয়ার শরীরের সাথে এখনও যুক্ত সে শিশুর শরীর।
রমিজ ঘরে ফিরলো আজ এক সপ্তাহ পরে। রাবেয়ার আঘাতের দাগ মিলিয়ে গেছে প্রায়, শুধু বুকের উপরে গভীর ভাবে লেগে থাকা কামড়ের দাগটা শুকায় নি, ওখানে পুঁজ জমেছে।
ব্যথা করে, মাছি বসে, রাবেয়ার ভ্রক্ষেপ নেই।
জ্বরে অচেতন রাবেয়াকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কেটেছে রমিজের। রাবেয়া ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে না, ও জানে, ঘরটা যখন আগুণে পুড়েছে তখন রাবেয়া প্রাণপনে বাধা দিয়েছে। বাচ্চাটা গেছে যাক, যদি আল্লা চাহে তো আবার হবে। আল্লার জিনিষ আল্লা নিয়ে যেতে চাইলে ও বাধা দেওয়ার কে?
এক মাস হয়ে গেলো, রাবেয়ার শরীরের সবকটা ক্ষত শুকিয়ে গেলেও রাবেয়া স্বাভাবিক হয় নি এখনও।
রমিজকে দেখলেই আঁতকে উঠে। কাছে ঘেষতে দেয় না। রমিজ উপায়ান্তর না দেখে রহিমার মাকে নিয়ে এসেছে , ঐ বুড়িই এখন ঘরের সব কাজ দেখে।
বাবা খেইয়ে নাও দেকিন, ম্যালা কাজ পড়ি আচে। ঐ পাড়ে যেতি হবে।
রাবেয়া একদম চুপ, কোনো কথা বলে না। কারো সাথেই না। মাঝে মাঝে পুকুরের পাশে গিয়ে উদাস বে থাকে। মাঝে মাঝে মাটিতে থাপড় মেরে কাঁদে। সেই কান্নার কোনো অনুবাদ করা যায় না।
পুকুরের পাশেই রমিজের ছেলের কবর। মানুষের বাচ্চা পুতি ফেলতে হবে, শিয়াল কুকুরের জন্যি তো ফেলি রাখা যায় না।
মৌলভি সাব জানাযা পড়ে কবর দিয়েছে।
এই শুইনবে, একটা কতা আছিলো।
রমিজ অনেক দিন পরে রাবেয়ার স্বর শুনে অবাক হয়।
অন্তত সে ছাড়া বাসায় অন্য কেউ থাকে এই সত্যটা অনেক দিন ভুলতে বসেছিলো।
রমিজ থমথমে মুখে সব কথা শুনে। অনেকক্ষণ থম ধরে বসে থাকে।
কাউকে চিনিছিলি?
রাবেয়া মাথা নাড়ায়। মাথার ভেতরে অপরিচিত মুখের মিছিলে ঝিলিক দিয়ে উঠে কিছু চোখ, কিছু হাত, সব মিলিয়ে একটা সম্পূর্ণ ছবি হয় না।
থাক আর কষ্ট করতি হবি নে, বাদ দে দেকিনি, যা হবার হইয়েছে। আয় ঘরে চ। কতদিন তোর কথা শুনি নি।
রমিজ হাত বাড়িয়েও থেমে যায়। যত বাড় হাত বাড়ায় ততবার মনে হয় ওখানে অন্য কেউ হাত রেখেছে।
অন্য কেউ সেখানে থাবা দিয়েছে। মাথার ভেতরের সেই অপরিচিত মানুষগুলোকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারে না।
তুই ডুবি মরতি পারলিনে মাগী। তুই যা, আমর ঘর থিকে যা তুই।
রাবেয়া ঘর ছেড়ে চলে যায়, কোথায় যাবে, কোথাও যাওয়ার নেই।
সামনের শিকদারের পরিত্যাক্ত ভিটার ঝরঝরে গোয়াল ঘরে গিয়ে বসত গড়ে।
ফুলবাড়ীর কশেমপুর গ্রামে অদ্ভুত একটা সংসার চলতে থাকে। রমিজ কোনো এক অজানা মায়ায় ছেড়ে যেতে পারে না, রাবেয়ার জন্য প্রতিদিন ভাত নিয়ে আসে গোয়াল ঘরে, গোয়াল ঘরের ছাউনি বাধিয়েছে নতুন খড় দিয়ে। চার পাশে দেয়াল তুলেছে।
কোথাও কোনো ছন্দ পতন নেই, শুধু রাবেয়ার সামনে গেলেই মাথায় আগুণ জ্বলতে থাকে।
মাথার ভেতরে কাঁটার মতো প্রশ্নটা বাজতেই থাকে।
মাগী তুই গেলি কেনে? মাগী তুই ডুবি মরতি পারলি নে। তুই যা, তুই চলি যা এইখানতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।