আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাদকাসক্তদের সহযোগিতা জরুরী

সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা 'সাপ্তাহিক অগ্রযাত্রা'র সম্পাদক মাসিক ' সুন্নিয়ত' পত্রিকা ও সাপ্তাহিক জা'আল হক পত্রিকা'র উপদেষ্টা ওলামায়ে আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামা'য়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক, বিশ্ব সুন্নী ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আঞ্জুমানে আশেকা

মাদকাসক্তদের সহযোগিতা জরুরীঃ মাদকাসক্ত না হলে ৩৮ বছর বয়সের তরুণ বাপ্পী কাজী'র চোখের দৃষ্টি ও দেহের গঠন সবার নজর কাড়ারই কথা। কিন্তু তার দেহে নেই তারুণ্যের উচ্ছলতা। যে তরুণটির কথা বলছি তার নামটাও অনেক সুন্দর। বাপ্পী লেহেরী। এক সময় গানও গাইতো।

কী মায়াবী চেহারা আর উচ্ছ্বলতা এখন আর নেই। বাপ্পী'র সঙ্গে কথা হয় একটি বাসায়। 'ভাই নেশা করে ভুল করছি; ড্রাগ আমার জীবন শেষ করে দিছে'- চোখের পানি ফেলে বলে বাপ্পী । এক সময় ব্যবসা ছিল, বাবার রেখে যাওয়া বিশাল ব্যাংক ব্যালেন্স ছিল। বাবা ছিলেন সাব রেজিষ্ট্রার।

বন্ধুদের সঙ্গে ড্রাগ নিচ্ছে প্রায় দুই যুগ ধরে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে সে। আত্মীয়স্বজনরা আর খোঁজ খবর নেয় না। বাপ্পী'র নানা সমস্যা। খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না ।

বেড়া উঠলে সারা শরীরে ব্যথা হয়, সহ্য করতে পারে না। মাদকগ্রহণকারীরা চরম ঝুঁকিপূর্ণভাবে মাদক নেয়ার কারণে কেউ কেউ এইচআইভি পজেটিভ হয়ে পড়েছে। এ সংখ্যা বেশি না হলেও আশঙ্কাজনক। মাদকসেবীর মধ্যে এইচআইভি ঝুঁকি বাড়ছে। গবেষণায় ও অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, শিরায় মাদকগ্রহণকারীদের নেশা করা ছাড়ানো সহজ বিষয় নয়।

অথচ এরাই এইচআইভি/এইডসের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী। তাই শিরায় মাদকগ্রহণকারীদের চলাচলের নিরাপত্তা, সচেতনতা ও পুনর্ববাসন জরুরি। ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ মোট ১৯টি জেলায় সাত হাজার ঝুঁকিপূর্ণ মাদকসেবী শনাক্ত করা গেছে। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত হাজার। ২০০৭ সালের জাতীয় এইডস কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ২১ হাজার ৫৩৪ জন ইনজেকশনে মাদকগ্রহণকারী আছে।

২০০৫ সালের জাতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ সংখ্যা ২০ থেকে ৪০ হাজার। মাদকদ্রব্য অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসে রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে মাদকাসক্ত ও সমকামীদের মধ্যে এইডসের সংক্রমণ বেড়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টারের একটি খবরে আরও বলে, শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকগ্রহণকারী ও যৌনকর্মীদের মধ্যেই বিশ্বে এইডসের হার বেশি। ২৪৮ পৃষ্ঠার গবেষণা প্রতিবেদনে জাতিসংঘের উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয়, এইডসে আক্রান্ত হয়ে গত বছর বিশ্বে ২১ লাখ মানুষ মারা গেছে। ইউনিসেফের বিবরণ অনুযায়ী, যেসব আইডিইউ মাসে তিন বা তার অধিকবার শিরায় নেশাগ্রহণ করে, তাদের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ (মোস্ট এ্যাট রিস্ক-এমআর আইডিইউ) বলে চিহ্নিত করা হয়।

দেখা গেছে, আমাদের দেশের আইডিইউরা দিনে বা সপ্তাহে একাধিকবার নেশাগ্রহণ করতে অভ্যস্ত। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে চার কোটি ২০ লাখ মানুষ এইচআইভি/এইডস ভাইরাসে আক্রান্ত (গত বছর)। প্রতি বছরে আক্রান্ত হয়েছে ৫০ লাখ। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা বছরে গড়ে ১০ লাখ করে বাড়ছে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি।

ভারতে এইচআইভি পজেটিভ রোগীর সংখ্যা ৩১ লাখ। বাংলাদেশের তিন দিকে রয়েছে ভারত ও একদিকে মিয়ানমার। ভারতের সঙ্গে সীমান্তের পরিমাণ চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। তাই বাংলাদেশে এইচআইভির ঝুঁকি প্রকট। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও) ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনএইডস-এর পড়্গ থেকে আশঙ্কা করা হয়, বাংলাদেশে অন্তত ১৩ হাজার মানুষ এইডসের (এইচআইভি) ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।

মাদকাসক্তদের মধ্যেই এ আশঙ্কা বেশি। শতকরা ৭৫ ভাগ মাদকাসক্ত একই সিরিঞ্জে ইনজেকশন নেয়। এ প্রক্রিয়ায় রক্ত ও সুইয়ের মাধ্যমে তারা রোগ-জীবাণুর বিনিময় করছে। কোনো মাদকাসক্ত এইডসে আক্রান্ত হলে ইনজেকশন ভাগাভাগির কারণে একই এলাকার অন্যান্য মাদকাসক্তের মধ্যে সেই জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের ২০০৪ সালে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৪৬ লাখ মাদকসেবী আছে।

পুরুষ, নারী ও শিশু মিলে প্রায় এক লাখ মানুষ মাদক বিক্রি এবং পাচারের সঙ্গে জড়িত। একজন মাদকসেবী প্রতিদিন গড়ে ১০০ টাকা করে খরচ করে। এ হিসাবে দেশে বছরে মাদকের পেছনে খরচ দাঁড়ায় ৪৬ কোটি টাকা। মাদকসেবীদের ৮০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। সরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে, শিরায় মাদকগ্রহণকারীর সংখ্যা ৪০ হাজার।

এদের ৭৫ শতাংশই নিজেদের মধ্যে সুই-সিরিঞ্জ বিনিময় করে। ২০০৭ সালে দেশে ২১ হাজার ৫৩৪ জনকে ইনজেকটেবল ড্রাগ ইউজার (আইডিইউ) শনাক্ত করা গেলেও প্রকৃতপড়্গে এর পরিমাণ আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ন্যাশনাল এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের (এনএএসপি) সর্বশেষ সার্ভে প্রতিবেদনে (২০০৬) বলা হয়, ইনজেকশনে মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে শতকরা সাত ভাগ এইডসে আক্রান্ত। জরিপে ঢাকার এক হাজার ৭২ জনের মধ্যে ৭৫ জনের মধ্যে এইচআইভি পজেটিভ পাওয়া যায়। ঢাকা ও আশপাশের এলাকা মিলে মাত্র একজন মাদকসেবী নারীর দেহে এইডস ধরা পড়ে।

এইচআইভি/এইডস ছড়িয়ে পড়ার কারণগুলোর মধ্যে সুই-সিরিঞ্জের ব্যবহারে অসতর্কতা অন্যতম। ইনজেকশনে মাদকগ্রহণকারীরা এইডস সম্পর্কে সচেতন নয়। ক্ষতির ধরন সম্পর্কে অধিকাংশেরই ধারণা নেই। মাদকগ্রহণের সময় সুই ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে এইডসের জীবাণু ছড়াতে পারে, এমনটি জেনেও তারা পুরনো সিরিঞ্জ ব্যবহার করে। ঢাকা মেডিকেল, মিটফোর্ডসহ কয়েকটি স্পটে হকাররা ময়লার মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া সুই-সিরিঞ্জ বিক্রি করে।

ছিন্নমূল মাদকসেবীরা সহজপ্রাপ্য এসব সুই-সিরিঞ্জ কিনে নেয়। মাদকসেবীরা সুই-সিরিঞ্জ সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যখন বেড়া ওঠে তখনই নেশা করে। পদড়্গেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র ও কেয়ার বাংলাদেশ শিরায় মাদকগ্রহণকারীদের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে সুই-সিরিঞ্জ বিতরণ করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বে মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসনের প্রায় ৮০ শতাংশ কার্যক্রমই বিফলে যায়।

বাংলাদেশে এ হার আরও বেশি। চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের পরও মাদকসেবীরা পুনরায় মাদকগ্রহণ করে। শিরায় মাদকগ্রহীতাদের মধ্যে পুনরায় মাদক গ্রহণে ফিরে যাওয়ার হার প্রায় শতভাগ। পেথেডিনসহ শিরায় গ্রহণ করা অন্যান্য মাদকের আসক্তি ভয়াবহ। এ নেশা ছাড়া খুবই কঠিন।

মাদকাসক্তরা নেশা ছেড়ে দিলে শরীরের নানা জটিলতায় ভোগে। এই ভয়ে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই নেশা ছাড়ে না। আইডিইউরা সুই-সিরিঞ্জ বিনিময় ও অনিরাপদ যৌনমিলনের কারণে দেশের সবচেয়ে অধিক এইচআইভি/এইডস ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত। গবেষণায় দেখা গেছে, মাদক গ্রহণের ফলে যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়। আইডিইউসহ অন্য মাদকসেবীদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তারা প্রায় সবাই অনিরাপদ যৌনমিলনে অভ্যস্ত।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব মাদকসেবীকে নেশা করতে বাধা দিয়ে নিপীড়ন চালানো হলে তারা আত্মগোপন করে। দূর এলাকায় গিয়ে সহজলভ্য মাদক কিনে ঠিকই নেশা চালিয়ে যায়। এসব মাদকসেবী গোপনে মিশে যায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে। এদের মধ্যে এইচআইভি পজেটিভ থাকলে তা ভয়াবহ সংক্রমণ ঘটাতে পারে। তাই আইডিইউদের মাদক সেবন বন্ধ করার চাইতে নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা জরম্নরি।

তা না হলে আইডিইউদের মাধ্যমে এইচআইভি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়বে। এইচআইভি/এইডস টার্গেটেড ইন্টারভেনশন (হাতি) প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে কেয়ার বাংলাদেশ ৪১টি ড্রপ ইন সেন্টার চালাচ্ছে। এর মধ্যে ১৯টিই ঢাকায়। সংস্থাটির তত্ত্বাবধানে ছয় হাজার ৯৪৩ আইডিইউ আছে। হেরোইনসেবীর সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৭৮।

এদের মধ্যে শতাধিক আইডিইউর এইচআইভি পজেটিভ ধরা পড়েছে। আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১৬ জন। আইডিইউদের এইচআইভি/এইডস ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ সচেতনতার কাজ করে এমন আরেকটি প্রতিষ্ঠান পদড়্গেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র। সংস্থাটি ঢাকার বাইরে খুলনা ও বরিশাল বিভাগে ১১টি ড্রপ ইন সেন্টার চালাচ্ছে। স্থানীয় সহযোগী এনজিওর মাধ্যমে চলছে আরও ছয়টি।

এসব সেন্টারে অন্যূন সাড়ে তিন হাজার আইডিইউ আছে। হেরোইনসেবীর সংখ্যা ১২ হাজার। খুলনা অঞ্চলের ভিসিটি সেন্টারের (পরীক্ষা কেন্দ্র) মাধ্যমে মাত্র ২০ জন পজেটিভ ব্যক্তিকে শনাক্ত করা গেছে। ধারণা করা হয়, আইডিইউদের মধ্যে অসংখ্য এইচআইভি পজেটিভ রয়েছে, যাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে এইচআইভি পজেটিভদের কেয়ার এ্যান্ড সাপোর্টের কাজ করে মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ৮৭ জন আইডিইউ সদস্য রয়েছে। ঢাকার বাইরে শুধু চাঁদপুরে দুজন সদস্য আছে। রাজধানীর পুরান ঢাকায় পজেটিভদের জন্য একটি ড্রপ ইন সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। কাউন্সিলিং, বাড়ি ভ্রমণ, খাবার বিতরণ, সাধারণ রোগের চিকিৎসা, এআরবি (এইচআইভি/এইডস আক্রান্তদের জীবনীশক্তি বৃদ্ধির ওষুধ) দেয়া, রোগী ও পরিবারকে প্রশিড়্গণ এবং মানসিক সমস্যায় সহায়তা করার মাধ্যমে চলে কেয়ার এ্যান্ড সাপোর্টের কাজ।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।