আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

র্দুনীতি মুক্ত সমাজ ইউটোপিয়া মাত্র



দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ইউটোপিয়া মাত্র কোটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে শুরু করে আধুনিক অর্থনীতির তত্ত্ব পর্যন্ত দুর্নীতি একটি বহুল পরিচিত এবং আলোচিত বিষয়। সা¤প্রতিক সময়ে দুর্নীতি দমনের চটকদার ও সস্তা জনপ্রিয় বিষয়কে সামনে রেখে ১/১১’র পরিবর্তন দুর্নীতিকে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে দাড় করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক কাঠামো এবং বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চরিত্রকে সামনে রেখে আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য তথাকথিত দুর্নীতি বিরোধী অভিযান এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার মৌখিক বক্তব্যের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করার সম্ভাবনা আর ড. ইউনুসের ৫০% সুদের ব্যবসার মাধ্যমে দারিদ্র্যকে যাদুঘরে পাঠানোর বক্তব্য সমগোত্রীয়। সমাজের দরিদ্রতর জনগোষ্ঠীকে মুনাফা লাভের হাতিয়ার বানিয়ে দারিদ্র্যকে স্থায়ী রুপ দেবার প্রক্রিয়াকে যেমন ‘সোসাল বিজনেস’র চটকদার নামে ডাকা হচ্ছে তেমনি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিপরীতে আন্তর্জাতিক মহলের তল্পিবাহী শাসক শ্রেণী তৈরির বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়াকে ‘দুর্নীতি বিরোধী অভিযান’ নামকরণ করা হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতৃত্ব অসৎ ও দুর্নীতি পরায়ণ এতে কোন সন্দেহ নেই।

তেমনি সন্দেহাতীত সত্য হচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং উন্নত বিশ্বও যথেষ্ঠ পরিমাণ দুর্নীতিগ্রস্ত। বরং উন্নত বিশ্বে দুর্নীতিকে এক ধরণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে। এবং দুর্নীতি করার অধিকারও কেবল সমাজের উপরতলার যথেষ্ঠ পয়সাওয়ালা মানুষদের জন্য সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঘুষ দেওয়ার প্রক্রিয়াকে আনুষ্ঠানিক লবিংয়ের পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। অফিসের কেরানির ঘুষ খাওয়ার পরিবর্তে তারা কর্পোরেট দুর্নীতির অভিজাত কালচার সৃষ্টি করেছে মাত্র।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফান্ড ডোনেট করার মাধ্যমে নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করার প্রক্রিয়া অভিজাত ও আনুষ্ঠানিক দুর্নীতির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। হেগেলের মতে, “ গধঃবৎরধষ ডড়ৎষফ রং ঃযব ঢ়যবহড়সবহধষ সধহরভবংঃধঃরড়হ ড়ভ রফবধং ” আর কালমার্কসের মতে “ ঞযব ঘধঃঁৎব ড়ভ রহফরারফঁধষং ফবঢ়বহফং ড়হ ঃযব সধঃবৎরধষ পড়হফরঃরড়হং ফবঃবৎসরহরহম ঃযবরৎ ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ. ” আমরা কাল মার্কসের বক্তব্যের সঙ্গে মোটামুটি একমত। সমাজের চরিত্র পুরোপুরি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নির্ভরশীল একথা যেমন সত্য নয়, তেমনি এটি অস্বীকার করারও কোন সুযোগ নেই যে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডই সমাজের চরিত্র বহুলাংশে নিয়ন্ত্রন করে। মার্কসের বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বের দাবীদার, “ ঞযব সড়ফব ড়ভ ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ পড়হংঃরঃঁঃবং ঃযব বপড়হড়সরপ ংঃৎঁপঃঁৎব ড়ভ ংড়পরবঃু ধহফ ঃড় যিরপয পড়ৎৎবংঢ়ড়হফ ফবভরহরঃব ভড়ৎসং ড়ভ ংড়পরধষ পড়হংপরড়ঁংহবংং. ”  পুঁজিবাদী সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয় বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে পুঁজি সংগ্রহের উচ্চাকাংখা দ্বারা। সমাজের শ্রমিক শ্রেণী চরমভাবে শোষিত হয়ে ক্রমাগত দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যেতে থাকে আর সম্পদশালী বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমকে ঊীঢ়ষড়রঃ করে ক্রমাগত সম্পদশালী হতে থাকে।

মুনাফা তৈরির সীমাহীন আকাংখা আর জীবনকে উপভোগ করার একমাত্র সংস্কৃতি পুঁজির যে গঠন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাকে কোন ক্রমেই বৈধ বলা যায়না। পৃথিবীর ইতিহাস বলে আদি পুজির সঞ্চয় ঘটে দুবৃর্ত্তায়ন, লুটপাট আর শোষনের মাধ্যমেই। শ্রমিকের শ্রমের কারনে যে মূল্য তৈরি হয় তাকে পুঁজি করেই মানুষ সম্পদ তৈরি করতে শেখে। আদিম দাস সমাজ ব্যবস্থায় , সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এবং আজকের আধূনিক সময়েও প্রলেতারিয়েত মানুষকে শোষনের সেই একই ইতিহাস বিদ্যমান। কেবল রুপ পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।

একটি সমাজের আভ্যন্তরীণ শোষন যখন পূর্ণ হয় তখন মুনাফা ও বাজারের লোভে সে সৃষ্টি করে উপনিবেশ, নতুন সম্পদ নতুন বাজার আর সস্তা শ্রমিক মিলে নতুন শোষনের ইতিহাস। আজকের আধুনিক ইউরোপের প্রতিটি ইঞ্চিতে জড়িয়ে আছে আফ্রিকার দাসদের ঘাম, রক্ত আর এশিয়ার উপনিবেশ থেকে চুরি করা ও লুট করা সম্পদ রাজি। দুবৃত্তায়নের মধ্যদিয়ে তৈরি করা এই সম্পদ জন্ম দিয়েছে আধুনিক সভ্যতার, যার পাদপীঠে দাড়িয়ে এখন আইন, সমাজ আর নীতির তত্ত্ব জন্ম নিয়েছে বিস্তর। এই অসভ্য প্রক্রিয়ায় সম্পদ আহরণের ইতিহাসকে সভ্যতার চাদরে ঢেকে দিয়ে তারা এখন আমাদের শেখাচ্ছে কিভাবে গণতন্ত্র অর্জন করতে হবে, কিভাবে আরও বেশী সভ্য হতে হবে। ওরিয়েন্টাল দৃষ্টি ভংগী পোষন করে তারা এখনও মনে করে সারা পৃথিবীকে বিশেষ করে কালো চামড়ার এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষদের গণতন্ত্র ও সভ্যতা শেখানো তাদের এক মহান দায়িত্ব।

তৃতীয় বিশ্বের সরকার ব্যবস্থাকে দুর্নীতিবাজ হিসাবে প্রমান করে তারা তাদের এই পবিত্রতম ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে মাত্র। পুঁজিবাদী শোষনের অমানবিক প্রক্রিয়াকে স্থায়ীত্ব দিয়েছে সম্পদের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আজন্ম লোভ , জীবনকে বস্তুগত উপভোগের উদগ্র আকাংখা আর পৃথিবীকে জাগতিক ও পার্থিব দৃষ্টিতে বিচার করার বস্তুগত দর্শন। যে সমাজ টাকার জন্য শরীরের নগ্নতাকে ব্যাবসার পণ্য বানায়, যে সভ্যতা ব্যাবসা করার জন্য যুদ্ধ বাঁধায়, যে মহান মানবেরা মানুষের রক্তের হোলী খেলার মধ্য দিয়ে সভ্যতার চাকা ঘোরানো তেল জোগাড় করে, সেই সভ্যতা হটাৎ করে কোন একদিন সকালে সুর্য্যরে আলোয় দুর্নীতি মুক্ত চরিত্রবান হয়ে যাবে - এতটা অবাস্তব আহম্মকী আশাবাদ ব্যক্ত করতে আমাদের বুদ্ধিতে বাঁধে। দুবৃত্তায়নের মধ্য দিয়ে যে অর্থনীতির জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা তার মৌলিক চরিত্রের পরিবর্তন বাদে কোন আলাদিনের চেরাগের আলোয় দুর্নীতি মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর। একটি বস্তুগত সমাজে, একটি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দুর্নীতি তাই চিরকালীন সত্য।

দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ইউটোপিয়াই মাত্র।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।