আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশে গবেষণার হালচাল-৩

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
(গত পোস্ট) এর আগের পোস্টগুলোতে আমার চোখে বাংলাদেশে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নানা বিদেশী প্রোজেক্টে বিজ্ঞান গবেষনার হালহাকিকত লিখেছিলাম। আজ লিখব বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে চলা গবেষণার হালচাল নিয়ে। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে গবেষণা চালান শিক্ষকরা ও তা করে তাদের ছাত্রছাত্রীরা। কথা হচ্ছে, এসব গবেষণার ক্ষেত্র ও উদ্দেশ্য কি? কিছু অনিয়মের কথা বাদ দিলে আমাদের দেশে মূলত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলতে তাদেরই ধরা হয়, যারা অনার্স ও মাস্টার্সে খুব ভাল রেজাল্ট করেন। অনার্স পর্যায়ে ছাত্র ছাত্রীরা একেবারেই গবেষণার ধারে কাছে আসতে পারে না।

মাস্টাসের একটি ভাল ছাত্র সেই ক্ষেত্রেই গবেষণা করে, যে ক্ষেত্রে তার সুপারভাইজর অভিজ্ঞ। অনেকে ভাবতে পারেন, সুপারভাইজর বাছাইয়ের সময় হয়ত ছাত্রটি তার আগ্রহের গবেষণা-ক্ষেত্রে যিনি অভিজ্ঞ তাকেই বেছে নেয়। সারা বিশ্বে এই ব্যাপারটা সত্য হলেও বাংলাদেশে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশে একজন ছাত্র তার মাস্টার্স সুপারভাইজর বাছাইয়ের সময় যে সকল বিষয় দেখে তার মাঝে প্রধান প্রধান কারন গুলো অনেকটা নিম্নরূপ: ১. সুপারভাইজর কতটা প্রভাবশালী। প্রভাবের পরিমাপ করা হয় সুপারভাইজরের ফোনে চাকরি পাওয়া, তার হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া, তার সুপারিশে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার্থে কত সহজে যাওয়া সম্ভব ইত্যাদি।

২. সুপারভাইজরের গবেষণার ফ্যাসিলিটিজ কিরূপ (তা যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন)। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর প্রতি বিভাগে দুই একটি ল্যাব মোটামুটি স্বয়ং সম্পূর্ণ থাকে। বিধায় ছাত্র ছাত্রীদের মূল টার্গেট থাকে ঐ সব সুপারভাইজর বেছে নেওয়া। যেমন ধরূন, কোন ছাত্রের ইমিউনলজি খুব ভাল লাগে, সে চায় ভবিষ্যতে এই ক্ষেত্রে কাজ করবার । কিন্তু সে যদি ডিপার্টমেন্টে এমন একজন সুপারভাইজর পায় যে কিনা বায়োটেকনলজির গবেষণা করেন, এবং তার ল্যাব স্বয়ং সম্পূর্ণ তখন সেই ছাত্রটি বায়োটেকনলজির ক্ষেত্রেই যাবে।

৩. সুপারভাইজর ছাত্রের ব্যাপারে কতটা অমনোযোগি। কিছু ছাত্রের মাস্টার্স করার উদ্দেশ্য থাকে শুধু একটা ডিগ্রির জন্য। বিধায় অহেতুক, ফলাফলহীন গবেষণার পেছনে সময় নষ্ট করবার চাইতে একজন নিস্তেজ সুপারভাইজরের অধীনে নামে মাত্র থিসিস করে যদি একটা সার্টিফিকেট পাওয়া যায় তবে ক্ষতি কি? যেহেতু, আলোচনা আমরা গবেষণায় আগ্রহি ছাত্রটির দিকেই রাখব (যে কিনা শিক্ষক হবে) বিধায় খারাপ ছাত্রের কথা বাদ। তা সেই ভাল ছাত্রটি তার অনাগ্রহের বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করে শিক্ষক হিসেবে ঢোকে। এরপর, সে স্কলারশীপ যোগাড় করে।

পিএইচডির ক্ষেত্রে তার আগ্রহ থাকে কোন নামি দামি বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে ডাক পাওয়া যায়, সেখানেই সে উড়ে যায় এবং ডিগ্রি নিয়ে দেশে আসে (যদিও অনেকেই আসেন না)। দেশে ফিরে উক্ত শিক্ষক তার পিএইচডির ক্ষেত্রেই গবেষণা পরিচালনা করেন (বর্তমানে বাংলাদেশে ঐ সব গবেষণার দরকার থাকুক আর নাই থাকুক), তার ছাত্র-ছাত্রীদেরও সেই সবই করতে হয়। এই সব গবেষণার সাথে দেশের সমস্যার কোন যোগসূত্র থাকে না। এগুলোর উদ্দেশ্য শুধু ডিগ্রি প্রদান ও নামে মাত্র রিসার্চ পেপার (গবেষণাপত্র) পাবলিশ করা।

রিসার্চ পেপারগুলোর বেশির ভাগই আমাদের দেশী এবং এর এডিটর মূলত আমাদের শিক্ষকরা নিজেরাই হয়ে থাকেন। এ যেন নিজের ডায়েরীতে নিজে লেখার মত। একই ধরণের নামেমাত্র গবেষণা টাইটেল এদিক সেদিক করে বছরের পর বছর ধরে পাবলিশ হতে থাকে। এডিটর সাহেবের একাধিক পেপার পাবলিশ হয়। দেখা যায় একজনের (ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক) তুচ্ছ কোন গবেষণার পেপারে সংশ্লিষ্ট গবেষক ও তার সুপারভাইজরের প্রিয় কয়েকজনের নামই থাকে।

তারা গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকুক আর নাই থাকুক। ছাত্রদের লাভ তারা সিভিকে সমৃদ্ধ করে অন্যদিকে শিক্ষকরা তাদের প্রোমোশনের পথ পরিস্কার করে। এমনও অনেক শিক্ষক আছেন যাদের কোন ল্যাবরেটরি নেই, না আছে যোগ্য ছাত্র কিন্তু ওনাদের রিসার্চ পেপারের সংখ্যা প্রচুর। একবার ঢাবির এক অধ্যাপক ঠাট্টা করে বলেছিলেন, “ঢাবিতে অধ্যাপক হবার জন্য পাবলিশড্‌ পেপার দরকার, সেটা নেচারে (বিশ্বের অন্যতম নামকরা জার্ণাল) পাবলিশ হল নাকি ইত্তেফাকে তা বড় কথা নয়!!” বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ গবেষণা শুধু থিসিস জমা দেওয়ার সাথেই শেষ হয়ে যায়। ঐ সব নিয়ে পরে আর কেউ মূলত কাজ করে না।

করলেও একই কাজ করে এবং একই থিসিসের কপি-পেস্ট করে অনেকে। বিভিন্ন বিভাগের থিসিসগুলো ভাল করে ঘাটলে দেখা যাবে একই ভুল একই পাতায় বছরের পর বছর ধরে বিদ্যমান। এর একমাত্র কারন কপি-পেস্ট। আমাদের প্রিয় শিক্ষকরা তাদের অক্ষমতা গুলোকে সম্পদের অপ্রতুলতা দিয়ে ঢাকবার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে বলতে পারি শুধু মাত্র শিক্ষদের অমনোযোগিতা ও অনাগ্রহের কারনে নামে মাত্র থিসিসের কাজ করতে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা যে সব উপকরণের অপচয় করে শুধু তা দিয়েই অনেক অনেক ভাল গবেষণা সম্ভব, যা কিনা দেশের মানুষের সমস্যার উদ্ঘাটন বা সমাধান করতে পারবে।

এত সমস্যার মাঝেও এদেশে কিছু শিক্ষক আসলেই খুব ভাল গবেষণা করছেন, শুধু দেশের মানুষের জন্য। কিন্তু, তাদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। খোঁজ করলে দেখা যাবে, বিদেশে গবেষণা করে বাংলাদেশের যারা বিখ্যাত হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই ঐ কয়েকজন শিক্ষক দ্বারা অনুপ্রাণিত। সেই অনুপ্রেরণা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত সেই সব বিজ্ঞানীদের কবে যে দেশে ফিরে কাজ করতে আগ্রহি করে তুলবে তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো কয়েক বছর। হয়ত, একদিন তারা ফিরবেন তাদের জ্ঞানের আলো নিয়ে।

(শেষ) লেখাটা এখানেই শেষ করলাম। আমার জানা, বোঝায় অনেক ভুল থাকতে পারে। ব্লগার বন্ধুদের অনেকেই এইসব নিজ চোখে দেখেছেন। অনেকেই দেশের পর্ব শেষ করে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার্থে আছেন, আছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও। তাদের সবাইকে আহ্ববান জানাচ্ছি আলোচনার জন্য, সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজবার জন্য।

অন্তত আর কিছু না হলেও, আমাকে যদি তারা কিছু দিকনির্দেশনা দিতে পারেন, যা বাংলাদেশে গবেষক হিসেবে জীবনকে অর্থপূর্ণ করতে সাহায্য করবে তবে কৃতজ্ঞ থাকব। অনেক লেখাপড়াই করেছি এ পর্যন্ত ভাল রেজাল্ট করবার জন্য, ভাল বিজ্ঞানী হবার জন্য, এখন সব অর্থহীন লাগে।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.