.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)
এরপর আমি 19A বাসে করে চললাম আয়োনা স্ট্রিটে। বাস থেকে কোথায় নামলাম নিজেও বুঝলাম না। এক লোক সাহায্য করছিলেন। তিনিই বললেন এটা হার্টস সেন্টার; তবে কোথাও তেমনটা লেখা দেখলাম না। এরপর শুরু করলাম হাটাহাটি।
চুপচাপ নিরিবিলি একটা এলাকা। কেউ কোথাও নেই। এর মধ্যে শুরু হলে প্রচন্ড বাতাস। বাতাসের গন্ধে বুঝলাম একটু পর বৃষ্টি শুরু হবে। একটার পর একটা বাড়ী।
নিরিবিলি। কোনও শব্দ পর্যন্ত নেই কোথাও। হঠাৎ দেখলাম একটা ছেলে একটা মেয়েকে কিস করতে করতে এদিকে আসছে। একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আয়োনা স্ট্রিটের ব্যপারে। কিস থেকে মুখ তুলে কোন রকমে বললো, No clue! আমি অবার ঘুরতে শুরু করলাম।
কিছুদূর যাওয়ার পর আরেকটা ছেলে এবং মেয়েকে পেলাম। এরা কিস করেছ না তবে মেয়েটাকে ছেলেটা ধরে রেখেছে (কঠিন প্রেম তাদের)। তাদেরও জিজ্ঞেস করলাম। এরা একটু আগ্রহ নিয়ে জানার চেষ্টা করলো আমি কোন রোডটা খুঁজছি। তারপর তারাও বললো এই নামে আসেপাশে তারা কোন রোড চেনে না।
আমি পড়লাম মহা বিপদে। কি করা যায়? ভাবতে লাগলাম। যেখানে নেমেছিলাম সেখান থেকে হেটে আমি অনেক সামনে চলে এসেছিলাম। ঠিক করলাম বাম দিকের এলাকাগুলোও একটু দেখবো। হাটা শুরু করলাম।
এই এলাকাটা একটু পাহাড়ী, ঠান্ডাটাও প্রচন্ড লাগতে শুরু করলো। বাতাস যদি ২ ডিগ্রি ঠান্ডা নিয়ে মুখে এসে লাগে, অবস্থা কি যে হয় বোঝাতে পারবো না। তবুও হাটছিতো হাটছি। হঠাৎ আমি লক্ষ্য করলাম আমি আরো নিরিবিলি এলাকায় চলে এসেছি। আসেপাশে একটা গাড়ি পর্যন্ত চলছে না।
আগের রাস্তায় হুস করে একটা-দুটা গাড়ি চলে যাচ্ছিল। এখানে সেটাও নাই। ঝড় ততক্ষনে প্রায় উঠেছে। কি করবো বুঝতে পারছি না। এমন সময় একটা খুব স্পিডে এসে ব্রেক করলো।
ড্রায়ভারের হাতে একটা বিয়ার, অন্যরাও সেরকম কিছু ধরে আছে। হঠাৎ দেখলো আমি একা দাড়িয়ে আছি। সাথেসাথে তারা প্রচন্ড শব্দ করে শুরু করলো চিৎকার। অনেকটা গর্জন এবং গোঙ্গানীর মত তাদের চিৎকার। গো-গো করে শব্দ করছে আর আমার দিকে বিয়ার বাড়িয়ে দিয়ে হাসছে।
বিকট হাসির সাথে চিৎকার। আমি দেখেই বুঝলাম সমস্যায় পড়েছি। আমার সাথে অনেক টাকা তখন। কোন কিছু না ভেবে উল্টা দিকে (যেদিক থেকে এসেছিলাম) দৌড় দিলাম। দুই ডিগ্রি ঠান্ডায়ও আমি তখন ঘামাচ্ছি।
দৌড়িয়ে চলে আসলাম বাস স্টপের ওখানে যেখানে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল বাস। এসে দেখি সেই দুই কাপল ওখানে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। আমার কাছে জানতে চাইলো আমি বাসা খুঁজে পেয়েছি কি না। কি যে ইংলিশ বললাম, নিজেও বুঝিনি! এর পরপরই একটা বাস আসলো। দুটো কাপলই উঠে পড়লো।
এটা কোথায় যাবে জানতে না চেয়ে আমিও উঠে পড়লাম। ড্রায়ভার জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবো। বললাম, ট্রিনিটি। সে জানালো এই বাস ট্রিনিটির দিকে যাবে না। বললাম যেখানে যায় আমাকে সেখানে নামিয়ে দিও।
এর পর সোজা গিয়ে বাসের পেছনে বসলাম। ধীরেধীরে ঠান্ডা হলাম। বাস আমাকে লাস্ট স্টপে নামিয়ে দিল। ওখান থেকে নদীর পাড় ধরে হেটে হেটে বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে বের করলাম এবং সব শেষে DSG-তে ফিরে আসলাম। আহ....! শান্তি!!!
এবার নুতন সমস্যা সৃষ্টি হলো; আমি এখন কি করবো? থাকবো কোথায়? DSG-তে রাতে হিটার চলে না।
দুই ডিগ্রি ঠান্ডটা মনে হয় আরো কমে যাচ্ছে। কম্পিউটারে বসে চ্যাট করলাম কিছু সময়। কিন্তু মাথায় তখন থাকার চিন্তা। কোথায় থাকবো, কোথায় থাকবো করে চিন্তাটা মাথায় ঘুরছে। একসময় দেখলাম রাত একটার মত বাজে।
আর পারছি না তখন। DSG-এর ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম। জীবনে এই অভিজ্ঞতাও হবে, ভাবিনি। সকালে ক্লিনার এসে আমাকে জাগালো। আমি পরদিনও ডাবলিনে থাকার মত জায়গা খুঁজে পেলাম না এবং যথারীতি ফ্লোরে শুয়ে কাটালাম আরেকটা রাত এবং এর পরের রাতও।
চতুর্থ দিনে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। এখানে রাতে থাকাটা কোন ব্যপারটা। আমার কাছে আই.ডি. কার্ড আছে যেটা পাঞ্চ করলেই গেট খুলে যায়। আর DSG-এর রুমের চাবিও সবার কাছে একটা করে আছে, আমার কাছেও। অতএব বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাটা কোন সমস্যা না।
হোস্টেলে থাকতে প্রতিরাতে € 25 দিতে হচ্ছিল। তাই একটা এয়ারবেড (ঠিক এয়ার ব্যাগ না) কিনে নিয়ে আসলাম € 29 দিয়ে। বেডটায় রাতে ইলেক্ট্রিক পাম্প দিয়ে ফুলিয়ে আমি শুতাম, আর দিনে বাতাস ছেড়ে গুছিয়ে রেখে দিতাম। শুরু হলো আমার জোস একটা জীবন। বাসা পাওয়া পর্যন্ত প্রায় দশদিন বিশ্ববিদ্যালয়েই থাকলাম।
মজার ব্যপার হলো এখানে আমাদের জন্য চমৎকার একটা কিচেন আছে, একটা শাওয়ার প্লেস আছে, টয়লেটও বেশ কুল। এয়ার বেড কিনে নেয়ার পর ভালোই আরামে থাকলাম।
এর পর শুরু হলো বাসা খোঁজার পালা। একটার পর একটা বাসা দেখি। অনেকে ইন্টারভিউ নেয়।
কেউ কেউ আজব সব কথা বলে - "If I bring a girl, do u have any problem ?" আমি হেসে বলি আমার রুমে না ঢুকলেই চলবে, কিন্তু আমি রুম চাই। আরেকবার একজন বললো এ বাসায় উঠলে রাতে সাবধানে থাকতে হবে কারন এলাকার ছেলেরা ধরে মাইর দেয়ার চান্স আছে। এটা মাঝেমাঝেই করে! কত আজব এলাকায় গেলাম বাসা খোঁজার জন্য। সব শেষে যেখানে বাসা নিলাম, একদম সাগরের পাশে। ভিউটা এত সুন্দর যে একটু বেশি ভাড়াতে বাসা নিতেও আমার বাধলো না।
সকাল বেলা আমি যখন বাসে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি, তখন দুচোখ জুড়িয়ে যায় সমুদ্রকে দেখে। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত আমি রুম পেলাম, আমার সুইট রুম।
এবার শুরু হলো আরেক সমস্যা। রুমে বেড আছে কিন্তু আর কিছু নাই। ফলে শুরু করলাম বালিস, ডুভেট, বেড কভার ইত্যাদি কেনা।
পুরো মেয়েদের কাজ করা শুরু করলাম। দুদিনে আমার রুমটাকে চকলেট কালারের একটা রুম বানিয়ে ফেললাম। নিজেই মুগ্ধ আমার নিজের কেনাকাটায়। কিন্তু শান্তি আসলো না। এবার গ্লাস, প্লেট, চামচ দরকার হলো।
ফলে আবারও বের হলাম এবং কিনে আনলাম সব। আমি নিজেই নিজের কাজে হাসি। কি আজব এই দুনিয়া! যে আমি কোন দিন একবার বিছানাও গোছাইনি, সে কিনা এখন কিনে কিনে সব সাজাচ্ছি!
খাওয়া দাওয়া এখনও বানাতে পারিনা সব কিছু কিনেই খাই। একদিন ম্যাকডোনাল্ডস, একদিন বার্গার কিং অথবা অন্য আরেকদিন এরকমই কোন এক দোকানে। একদিন একটা ক্যাফেতে বসে আছি, হালকা মিউজিক বাজছে।
ধরনটা মান্না দের "কফি হাউজের সেই আড্ডাটার" মত। শুনছি আর মনে মনে ভাবছি ইশ, যদি মান্না দের গানটা বাজানো যেতো। একটু পর ঠিকই কফি হাউজের সেই আড্ডাটা বেজে উঠলো। বুঝলাম বাংলা গানটা ওয়েস্টার্নের নকল। কিন্তু শুনে বেশ মজা লাগলো।
এরকম আরো অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। এখানে কিছু ফকির আছে। আমি প্রতিদিন তাদের লক্ষ্য করি। আজ দেখলাম তারা কফি দিয়ে পার্টি করছে। কি আনন্দ তাদের! মানুষের খুশি হবার কারনগুলোও খুব অদ্ভুত।
কেউ অনেক কিছু পেয়েও খুশি হয় না, আবার কেউ কত অল্পতেই খুশি হয়ে যায়।
রাতের বেলা যখন বৃষ্টি নামে, তখন আমি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাটি। একা একা। চারদিক নিরব। বাতাস, অনেক জোরে বাতাস বইতে থাকে।
আমি ইনসোমনিয়া ক্যাফের সামনে ১৩০ বাস থেকে নামি। আস্তে আস্তে হাটি আর গান গাই। রীতিমত জোরে জোরে - "এই দূর পরবাসে, তারাগুনে আকাশে আকাশে, কাটে নিঃসঙ্গ রাত্রিগুলো....." টুলুর সুরটার মাহাত্ম এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসে এই গান সুর করার সময় কেমন ছিল তার অনুভুতি, কিছুটা হলেও বুঝি এখন।
জীবন তবুও এগিয়ে চলছে জীবনের নিয়মে। সকলের দোয়াতে আমি অনেক ভালো আছি এখন।
আশা করি যোগাযোগ হবে আবার। আল্লাহ হাফিজ। (মেইলটা এখানেই শেষ)
৫ ডিসেম্বর ২০০৭
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
-----------------------------------------------------------
এটা কোন ব্লগপোস্ট নয়। বন্ধু ও পরিচিতজনদের কাছে আমার লেখা একটা ই-মেইল।
হাতেগোনা কয়েকজন পুরোটা পড়েছিল। তারাই সুন্দর রিপ্লাই দিয়েছিল। অন্যরা বিরক্ত হয়েছিল অথবা রাগ করেছিল। আজ তাদের ক্ষমা করে দিলাম (কত বড় দুঃসাহস আমার!) কারন এত বড় মেইল, তাও আবার এসব ভাবের কথা দিয়ে আমাকে কেউ লিখলে জুতার ছবি পাল্টা মেইলে রিপ্লাই পাঠাতাম। যাইহোক, সে জন্য এখন আর মেইল করি না।
এখন ব্লগ লিখি। সেদিনের কিছু হৃদয়হীন রিপ্লাই আজকের ব্লগার নিয়াজকে জন্ম দিয়েছে। তাদের জানাই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।