আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডাবলিনে আমার প্রথম তেইশ দিন (প্রথম খন্ড)

.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)

এটা আসলে কোন ব্লগপোস্ট নয়। গত ৫ ডিসেম্বর ২০০৭ আমি এই পোস্টটি ই-মেইল আকারে বন্ধু এবং পরিচিতজনদের পঠিয়ে ছিলাম। সাথে সাথে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম। কেউ কেউ পড়ে খুশি হয়েছিল, আবার অনেকে রেগেও গিয়েছিল। তখন বুঝিনি তবে আজ যখন বাংলিশ ভাষা থেকে বাংলা ফন্টে টাইপ করতে বসলাম তখন বুঝতে পারলাম এর দৈর্ঘ্য।

এতবড় ই-মেইল যদি কারো কাছে যায় তার মেজাজ যে সপ্তমে চড়বে, সেটাই আসলে স্বাভাবিক। যাইহোক, এই ই-মেইল পড়ে আমার ভালোবাসার মানুষটি খুব খুশি হয়েছিল এবং আমাকে ব্লগ লিখতে উৎসাহিত করেছিল। সেই থেকে শুরু হয়েছিল আমার ব্লগিং জীবন। হ্যালো সবাইকে............ ডাবলিন থেকে বলছি। আপনাদের ভেরী ও'উন, শান্ত।

লিখতে অনেক দেরী করে ফেললাম। নভেম্বরের ১২ তারিখ রাতে এসেছি, আজকে ডিসেম্বরের ৫ তারিখ। এই তেইশ দিনে কি একটা মেইল লেখারও সময় ছিল না? ছিল। অনেক সময় ছিল। তবুও মেইল লিখিনি কারন আমি চাইনি এমন কোন খবর দেই যেটা আপনাদের চিন্তিত করুক।

জীবনের এমন অনেক অদ্ভুত সময়ের ভেতর দিয়ে গিয়েছি যা ভাষায় লেখা সম্ভব নয়। তবুও দাতে দাত চেপে সহ্য করে গিয়েছি। জীবনেরতো সবে শুরু, আরো কত কঠিন সময় আসবে! তাই এই সূচনাতেই ঘাবড়ে যাইনি। কিন্তু আপনারা আমাকে যারা চেনেন তারা হয়তো দূশ্চিন্তা শুরু করতেন। তাই কোন খবর দেইনি।

এখন সেট হবার পর খবর দিচ্ছি - আল্লাহ-তা'লার রহমত এবং আপনাদের দোয়াতে আমি এখন অনেক ভালো আছি। আলহামদুলিল্লাহ। ঢাকা থেকে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি ১২ তারিখ ভোরে। ২০ কেজি+ ওজন নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম, কারন আমার লাগেজের ওজন আরো বেশি হবার সুযোগ ছিল এবং হয়েছেও তাই - ৩১ কেজি। শেষ পর্যন্ত ইমিগ্রেশনের এক অফিসারের সাহায্যে সব কিছু ম্যানেজ করে ফ্লাইটে উঠলাম।

আজব এক অনুভুতি, এমন এক দেশে যাচ্ছি যেখানে কাউকে চিনি না। কার কাছে যাব? কি করবো? কোথায় উঠবো ? কিছুই জানি না। তবুও পথ চলা.....। দুবাই গিয়ে ফ্লাইট আর ল্যান্ড করে না, অনেক সময় নিয়ে ঘোরাঘোরি করলো আকাশে। এয়ারপোর্ট দেখতে পাচ্ছি কিন্তু ল্যান্ড আর করে না।

এক সময় ক্যাপ্টেন এ্যানাওন্স করলো এখন আমরা ল্যান্ড করতে যাচ্ছি। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম, কারন এই ঘোরাঘোরিগুলো এত নিচ দিয়ে করেছে যে মেঘলা আকাশে ঝাকি বেশ ভালোই খেয়েছি, এবং প্লেনে হালকা ঝাকি খেলেই যে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায় সেটা বলাইবাহুল্য। ফ্রন্ট ক্যামের দিকে তাকানো আমি, একটু একটু করে রানওয়ের দিকে যাচ্ছি....। এক সময় চাকা বের হওয়ার শব্দ পেলাম, রানওয়েতে নামলাম - চাকা রানওয়ে ছুয়ে গেলো। এর পর যে কি হলো, আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে প্লেন আবার আকাশে।

সম্পূর্ন দুটো ভিন্নমূখী বলের মাঝে - শুরুতে নিম্নমূখী এবং হঠাৎ করে উপরের দিকে। অদ্ভুত একটা অনুভুতি। ঝাকিটা খাবার সাথে সাথে ফ্রন্ট ক্যামটা বন্ধ হয়ে গেলো; বস্তুত সব চ্যানেলই বন্ধ হয়ে গেলো। একটু নিরবতা! এর পর প্রথমে ইংরেজীতে, তারপর আরবীতে এবং শেষে বাংলায় ঘোষনা এলো। দুঃখপ্রকাশ করা হলো এই অনাহুত ঝাকির জন্য এবং জানানো হলো এটা টাওয়ারের দোষ।

আমাদের সামনে আরেকটা ফ্লাইট ছিল যেটা ল্যান্ড করতে দেরি করায় এবং টাওয়ার সেটা বুঝতে না পারায় আমাদের ল্যান্ড করার সিগনাল দিয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা জানানো হলে ক্যাপ্টেন দ্রুততার সাথে আবার ফ্লাই করে ফেলে এবং সমুহবিপদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে সবাই!!! দুবাইতে ফ্লাইট বদল করলাম। এবার লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। দেখলাম পরিবেশই বদলে গিয়েছে। দুবাইয়ের ফ্লাইটে অধিকাংশ শ্রমিক শ্রেনীর মানুষ ছিল, এমনকি এরকম দুজন লোক ছিল যারা টয়লেট করেছে দরজা খুলে এবং প্যান্ট ঠিক করেছে বাহিরে এসে! কিন্তু এবারের ফ্লাইটে সব ভাবের মানুষ।

আমার দুই পাশে দুই হোয়াইট। কিছু হলেই 'পারডন' আর 'সরি'। পড়লাম মহা যন্ত্রনায়। যে ভয়টা বারবার পাচ্ছিলাম, সেটাই হলো শেষ পর্যন্ত, পানি ফেলে দিলাম ডান পাশের জনের পায়ের উপরে। সরি বললাম।

কিন্তু লোকটা কিছু বললো না। শুধু তাকালো। শীতল দৃষ্টি! লন্ডন ল্যান্ড করার পর শুধু হাটি আর হাটি। কোন দিক-দিশা খুঁজে পাই না। শেষ পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল থেকে ডোমেস্টিক টার্মিনালে গেলাম (আয়ারল্যান্ডকে এরা ইউ.কে.-ই ভাবে।

ছোট ভাইতো - এক সাথে লেখে UK & Ireland)। এবং গিয়েই ধরাটা খেলাম। আমার কাছে ইউ.কে.-এর ভিসা নেই এবং সেটা নাকি থাকতেই হবে। কি বিপদ! আমি বললাম আমিতো ইউ.কে-তে থাকবো না। আমি ডাবলিন যাচ্ছি।

কে শোনে কার কথা। দুটা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান মেয়ে বসা। একসেন্ট পুরো ব্রিটিশ, শুধু চেহারার জন্য বোঝা যাচ্ছে ইন্ডিয়ান। পরে আমি একটু ত্যাড়া চোখে আই.ডি. কার্ড থেকে নাম পড়ে নিশ্চিত হলাম যে তারা ইন্ডিয়ান। দুবাইতেও দুই ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসার জালিয়েছিল।

এখানেও পড়লাম এদের হাতে। আমি এক সময় বললাম, যা খুশি করো। আমার কিছু করার নেই। তারপর তারা প্রশ্নকরা শুরু করলো। এক সময় বিরক্ত হয়ে বললো, ঠিক আছে।

তোমাকে এবারের মত ছেড়ে দিলাম। নেক্সট টাইম কিন্তু আর ছাড়াছাড়ি নাই। এ কথা বলে ২৪ ঘন্টার ট্রানজিট ভিসা (তাও আবার ফ্রিতে!) দিয়ে ছেড়ে দিল। আবার সেই হাটার পালা। ডোমেস্টিকে এদের চারটা টার্মিনাল।

এর মধ্যে আমি যেটায় হাটছি সেটায় ৯১টা গেট। আমার হলো ৮৪। হাটছি তো হাটছি, আমার গেট আর আসে না। অনেক সময় পর পেলাম ৮৪। কুকুর-বেড়াল ঘুমিয়ে থাকা অবস্থা ঢুকতে পারলে এখানে সত্যিই ঘুমাতো।

এত নিরবতা। জানি না কুকুর বেড়ালের জন্যও ভিসা লাগে নাকি। নাকি শুধু আমাদের এশিয়ানদের জন্য ভিসা লাগে। হয়তো আমরা কুকুর বেড়ালের থেকেও নীচ। যাইহোক, দুই ঘন্টা বসেবসে দেখলাম।

কি জীবন! মানুষ আসছে, যাচ্ছে। অনেক সময় পর ফ্লাইটে উঠলাম। ব্রিটিশ মিডল্যান্ড। এবং প্রথমবারের মত রেসিস্ট একটা আচরনের গন্ধ পেলাম। এয়ারহোস্টেজ সব হোয়াইটদের হ্যালো স্যার বললো, কিন্তু আমাকে বললো না।

আমি যখন আমার সিটটা কেথায় জানতে চাইলাম, ঠিক মত কথাও বললো না। সবাইকে যেচে গিয়ে ড্রিংস সার্ভ করলো। একমাত্র আমাকে করলো না, এমন কি একবার জিজ্ঞাসও করলো না। আজব লাগলো। পরে ডাবলিনের জায়গায় জায়গায় লেখা দেখেছি - "Keep your office racism free" এবং তখন বুঝেছি এদের আসলেই সমস্যা আছে।

যাইহোক, ডাবলিন ল্যান্ড করার পর মনে হলো....ফাইনালি.... আহহহ...। নামার পর ইমিগ্রেশন অফিসার যখন দেখলো আমার এম্বার্ক ইনিশিয়েটিভ স্কলারশীপ, বেশ খাতির যত্ন করলো। জিজ্ঞেস করলো MSc কত দিনের এবং PhD কত দিনের। বললাম MSc এক বছর, যদি PhD পর্যন্ত করি তাহলে তিন বছর। মেয়েটা আমার কথা হয় বোঝেনি, না হয় গাধা।

আমাকে চার বছরের ভিসা রিকম্যান্ড করে দিল, ছবি তুলে নিল এবং বললো পরবর্তি চার সপ্তাহের মধ্যে গিয়ে ভিসা স্ট্যাম্পিং করিয়ে নিয়ে আসতে। মনেমনে হাসছিলাম। আমি থাকলে না এতদিন এই দেশে! এক বছরের হলেই আমার জন্য যথেষ্ট। সততার সাথে বলছি, জার্নিটা সব দিক দিয়ে এত বাজে ছিল বলার না। দুবাই এয়ারপোর্টে আমার শেইভিং কিট (আমি ইডিয়টের মত হ্যান্ড ব্যগে নিয়েছিলাম) নিয়ে গিয়েছিল এবং ইউ.কে-তে বেল্ট, জুতা, মোজা সব কিছু খুলিয়ে চেক করিয়েছিল, যেন আমি আল-কায়েদার কেউ।

যাইহোক পারফেক্ট ওরস্ট জার্নি হতে হলে একটা জিনিসই বাকি ছিল, মনে মনে ভাবছিলাম সেটা এবং হলোও তাই। লাগেজ হারিয়ে গেলো। ডাবলিনের তিন ডিগ্রি ঠান্ডায় আমি বাংলাদেশের কাপড়ে কোথায় যাবো, কি করবো, কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমাকে শুধু জানানো হলো যে তারা (এয়ারলাইন কতৃপক্ষ) আমার লাগেজ খুঁজে বের করার ব্যপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে এবং ২৪ ঘন্টা থেকে ৩ মাসের মধ্যে আমার বাসায় দিয়ে আসবে! আমি কিছু সময় মনেমনে হাসলাম। হোয়াট এ্যা জার্নি! (চলবে) ৫ ডিসেম্বর ২০০৭ ডবলিন, আয়ারল্যান্ড।

২য় খন্ড - Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।