আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডাবলিনে আমার প্রথম তেইশ দিন (দ্বিতীয় খন্ড)

.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)

ডাবলিন এয়ারপোর্টে যখন নামলাম, রাত প্রায় ১২.৩০ বাজে তখন। এত রাতে এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার প্রশ্নই আসে না। এক ফাকে একটু বাহিরে ঘুরে আসলাম। প্রচন্ড ঠান্ডা। আমি যে কাপড় পড়ে আছি সেটা বাংলাদেশের শীতের জন্য যথেষ্ট, কিন্তু ডাবলিনের শীত? কিছু না বলাই ভালো এ ব্যপারে! হাটাহাটি করে, আমার কাজিনকে লন্ডনে ফোন করে এবং আসপাশটা ঘুরে দেখতে দেখতে রাত দুটার মত বাজলো।

এয়ারপোর্টের একটা দোকানে গেলাম, ভাবলাম কিছু খেয়ে নেই, কারন সর্বশেষ খেয়েছি দুবাই থেকে ফ্লাই করার পর। জাস্ট দোকানে ঢুকলাম (কথাও বলিনি), একটা ছেলে বসা ছিল, বিরক্ত হয়ে বললো "Closed"। হা করে দেখলাম। কতরকমের খাওয়া সাজানো, পকেটে টাকাও আছে, ৯৫০ ডলার। কিন্তু আল্লাহ রিজিকে রাখেননি।

তাই ইকোনোমিক্সের তত্ত্বকে অমান্য করে আমার পেট খালিই রয়ে গেলো। কিছুক্ষন ইন্টারনেটে বসে চ্যাট করলাম। কিন্তু সময় আর কাটে না। ক্লান্তিতে দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এর পর এয়ারপোর্টের লম্বা এবং শক্ত চেয়ারগুলোতে জুতা খুলে পা তুলে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

দেশে রেলস্টেশনে মানুষকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখেছি। কোনদিন ভাবিনি প্রায় একই রকম ভাবে নিজেও একদিন শুয়ে থাকবো। জীবন অনেক কিছুই আমাদের করে দেখায় যা আমরা কোন দিন কল্পনাও করি না। সেদিন মনে হয়েছিল, জীবন বড় কঠিন। সকাল হলো, ঘড়িতে, আলোতে না।

কারন এখানে সূর্য উঠে আটটার পর এবং সেই সূর্য নামেমাত্র, দেখা যায় না। লক্ষ্য করলাম আসতে আসতে এয়ারপোর্ট জেগে উঠছে। টয়লেটে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিলাম। ভাবলাম একটা বড় কর্ম সারতে হবে। কিন্তু কিভাবে? এখানেতো পানির নামগন্ধও নেই! টিস্যু পেপার ছাড়া আর কিছু পেলাম না টয়লেটে, একটা পানির কলও না।

কি আর করা, যে দেশ সে রীতি! ওভাবেই কাজ চালিয়ে নিলাম। তথাকথিত পরিষ্কার হয়ে এসে সেই আগের দিনের দোকানে গেলাম। জিনিসের দাম দেখে আঁতকে ওঠার দশা। 250ml পানির দাম প্রায় € 4.00. বাংলাদেশি টাকায় ৪০০ টাকা! একটা সেন্ডউইচ নিলাম, € 6.00 পড়লো। সাথে এক্সপ্রেসো কফি অর্ডার করলাম।

ছোট একটা কাপে যে আমাকে কি দিল, আল্লাহই জানেন। এখানে এটাকে বলে এক্সপ্রেসো এবং আমরা যেটাকে দেশে এক্সপ্রেসো নামে চিনি সেটাকে বলে ক্যাপাচিনো (হয়তো আমার জানার কমতি থাকতে পারে কিন্তু গুগলও একই জিনিস দেখাচ্ছে। ) সকাল হবার পর আমি একটা বাসে করে ডাবলিন সিটিতে আসলাম। কিন্তু আমার জানা ছিল না ছয়টা মানে এখানে আসলে অনেক রাত। বাসটা আমাকে ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলো।

আমি ধীরেধীরে ট্রিনিটির প্রধান গেটে পা রাখলাম। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম ক্যাম্পাসের দিকে। এই সেই ক্যাম্পাস যাকে এতদিন ইন্টারনেটে দেখতাম। এই সেই ক্যাম্পাস যাকে দেখতে বছরে ১.২ মিলিয়ন মানুষ আসে। এই সেই ক্যাম্পাস যেখানে পড়তে আইরিশ ছেলেমেয়েরা পাগল হয়ে থাকে।

মুগ্ধ হয়ে ক্যাম্পাসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছবিতে যা দেখেছি তার থেকে অনেক বেশি সুন্দর। আস্তে আস্তে হেটে ভেতরে ঢুকলাম। ট্রিনিটির বুকে আমার প্রথম পা রাখা (My first foot-step on Trinity! - মূল মেইলে এ লাইনটা লিখেছিলাম। পুরো লেখায় একটা লাইন বদলে দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।

বাংলাটা যেন আমার ভেতরের কথাটা প্রকাশ করছে)। গেটে সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করলাম কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টটা কোথায়। সে আমাকে ম্যাপে যা দেখালো তাতে আমার মাথা ঘুরে গেলো। আমি দাড়িয়ে আছি ফ্রন্ট গেটে। কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট হলো পেছনের গেটে।

দূরত্ব মাইলের উপরে এবং বহু আঁকাবাকা গলি আছে। কি আর করা, হাটা শুরু করলাম। বারবার পথ হারিয়ে ফেললাম এবং আবার খুজেও পেলাম। শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাড়ালাম কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের সামনে। কিন্তু তখনও কেউ আসেনি।

তাই দাড়িয়ে থাকলাম ডিপার্টমেন্টের নিচে স্টুডেন্ট ইউনিয়নের একটা দোকান আছে, ওখানে। দোকানের পাশে একটা প্যাসেজ আছে যেখানে স্টুডেন্ট ইউনিয়নের নোটিশ বোর্ড। পড়তে লাগলাম নোটিশগুলো। The Hist এবং The Phil-এর ডিবেট আছে, ইনভাইট করেছে সবাইকে। এ হলো সেই দুটো ডিবেটিং ক্লাব যারা ইউরোপের ডিবেটিং পাওয়ার হাউজ।

বর্তমান বিশ্বর‌্যাঙ্কিং ৯ম, যেখানে তারা Uni of Toronto, UNSW, Princeton, ANU, Harvard, McGill, Alberta, UBC, Stanford-এর মত বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে এসেছে। ভাবতেই ভালো লাগছিল কিছুদিন পর আমিও বলতে পারবো আমি The Phil-এর মেম্বার (ঠিক করেছি এটাতেই জয়েন করবো। ) যাইহোক, এই হলো আমার ট্রিনিটিতে প্রথম ভোর। এর পর ডিপার্টমেন্টে গেলাম এবং এক সময় আমার রিসার্চগ্রুপ - Distributed Systems Group অথবা সংক্ষেপে DSG-তে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। আমি অনেক ভাগ্যবান যে এমন একজন সুপারভাইজার পেয়েছি যিনি খুবই হেল্পফুল।

ড. স্টিফান ওয়েবার, জার্মান এবং একটু পাগল টাইপের। আরো আছে মার্ক, আইরিশ একটা ছেলে। সেও খুব হেল্পফুল। মার্কও আমার মত ওয়ারলেস কমিউনিকেশনে পড়ছে। PhD-এর শেষ পর্যায়ে।

আরেকটা জার্মান মেয়ে আছে, সেরেনা। আজব এক মেয়ে। সবসময় বয়ফ্রেন্ডের সাথে (সন্ধা সাতটার পর) DSG-এর ফোন দিয়ে গল্প করে আর কাঁদে। আমার সামনে বসে জেনি নামের আরেকটা মেয়ে। এ মেয়েটাও জার্মান, প্রচন্ড সুন্দরী কিন্তু কেন যেন প্রথম দিন থেকেই সে আমাকে দুচোখে দেখতে পারেনা।

আমিও পাত্তা দেই না। এরকম মেয়ে বহু আছে আমার দেশে (ভাব..!)। আমাদের সবার জন্য একটা করে ডেস্ক আছে কেবিন সহ। অনেকটা বাংলালিংক অথবা কর্পোরেট অফিসগুলোর মত। দুটা টেবিল - একটায় ডেল-এর ডেস্কটপ আরেকটায় ল্যাপটপ (ল্যাপটপের কাহিনী পরে আসছে)।

পার্টিশন দিয়ে যে যার মত করে কেবিন বানিয়ে নিয়েছে। আমার কেবিনটা এমন ভাবে বানানো ছিল যে ফ্রন্টটা ফাকা এবং জেনিকে দেখা যেতো। যখন আমি বুঝলাম এই মেয়ে আমাকে এড়িয়ে চলছে, তখন আমি একটা পার্টিশন এনে ঢেকে দিলাম ভিউ-টা, অনেকটা এই স্টাইলে - "যাহ! তোকে দেখলাম না। " এর পর সে আমার উপর আরো রাগলো। গতকাল একটা মেইল করেছে, আমি নাকি DSG-তে বেশি কথা বলি।

আমি সন্ধা সাতটার পর ভয়েস চ্যাট করি। এটা তার লেগেছে খুব। ভাবছি একটা মেইল করবো, সাতটার পর DSG-তে অফিস আওয়ার বলে কিছু থাকে না। যাইহোক, প্রসঙ্গে ফিরে আসি। প্রথমদিন ট্রিনিটিতে ঘন্টাখানেক থেকে আমি হোস্টেলের উদ্দেশ্যে বের হলাম।

আমাকে আগেই হোস্টেলের ঠিকানাটা দিয়ে দেয়া হয়েছিল। গিয়ে ডর্মে একটা বেড নিলাম তিনদিনের জন্য। চার বেডের রুম। সৌভাগ্যবশত রুমে আমি একাই ছিলাম প্রথম দুদিন। কিন্তু তৃতীয় দিনে দুটা মেয়ে আসলো এবং প্রথম বারের মত FIRST WORLD-এর যন্ত্রনা অনুভব করলাম।

মেয়েগুলো ছিল লেসবিয়ান। পুরো রাত তাদের যন্ত্রনা সহ্য করতে হলো। পরদিন যখন আমি এডমিনকে জানালাম আমি আমি আমার রিজার্ভেশন বাড়াতে চাই তারা জানালো পুরো হোস্টেল বুকড্। তখনও অনুভব করতে পারিনি বুকড্ শব্দটার মাহাত্ব। সারাদিন ডাবলিন চষে বেড়ালাম, কিন্তু কোন হোস্টেল অথবা হোটেল পাইনি যেখানে রুম খালি আছে।

ফোর স্টার হোটেল কয়েকটা পেয়েছিলাম যাদের রুম ছিল। তবে ভাড়া € 130 প্রতিরাত। হঠাৎ করে অনুভব করলাম আজ রাতে আমার থাকার কোন জায়গা নেই। এক বাংলাদেশী ছেলেকে চিনতাম ফেইসবুকের মাধ্যমে। তাকে ফোন দিলাম।

সেও জানালো কিছু করার নেই। আমার সুপারভাইজার চিন্তিত হয়ে পড়লেন। রাত হচ্ছে ধীরেধীরে। আমি কোথায় থাকবো? অনেক খোঁজাখুজি করে একটা রুম পাওয়া গেলো। ভিলেজ সাইডের একটা বাসা।

এক বুড়ির বাসায় একরাতের জন্য আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। € 35 ভাড়া। আমি তখন থাকতে পারলেই খুশি, কত ভাড়া জানতে চাচ্ছিলাম না। বুড়িটাও ভিষন ত্যাদড় ছিল। তার সাথে ফোনে কথপোকথনটা অনেকটা এমন ছিল: Me: Mam can i get a single room for today and tomorrow ? She: This is not a hostel or hotel, still u can. but u will have to pay 35 euro per night. Me: Okay mam, can i get the address ? She: It's on Iona street. Me: Okay, thanks. She: Why thanks! You need to know more. Me: Ohh, okay, sure.... She: House number 44 Me: Okay, thanks. She: Wait, you will have to catch 19 or 19A Bus to reach here. Me: Okay mam.... She: You will have to get off at Heart's Center bus stop. Me: Okay man.... She: Fare is € 1.40. Me: okay mam. Thanks. She: Hey, wait, You must keep exact figure, this bus does not give any change. Me: okay mam... anything more ? She: You must come within next two hours! Me: Thanks and cut (without giving her a single chance to speak) এর পর দৌড়ালাম 19 অথবা 19A বাস ধরতে।

(চলবে) ৫ ডিসেম্বর ২০০৭ ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড। তৃতীয় এবং শেষ খন্ড - Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।