মনের খোলা জানালয় কত আলো কত রঙ, খেলা করে চুপি সারে, আসে যায় কড়া নাড়ে ... ...
আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিন,
তুমি থাক সিন্ধু পারে, ওগো বিদেশিনী,
ভূবন ভ্রমীয়া শেষে, আমি এসেছি নুতন দেশে ...
আমার বিদেশিনী রবিঠাকুরের সিন্ধু পারে থাকা সেই বিদেশিনী না। ও থাকে পাহাড ঘেরা কাবুল উপত্যকা, কাবুল শহরে। নাম তার জেহের। না, ভয় পাওয়ার কিছু নাই, আমার দেয়া নাম। অবশ্য ওর কাজিন সাহার এর নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছি।
কাবুল আসার কদিন পর মার্কেটে ঘুরছিলাম। হটাৎ মেসেজ ... ''I love you Omaid. Chara zang namezani?'' এই দিয়ে শুরু। প্রথম বাক্য আমি কেন, আপনিও বুঝবেন। পরের বাক্য দাড়ি (ফার্সির যে রুপ কাবুলে চলে, কাবুলীদের শেকড় ইরান দেশে) বা পশতু (আফগানীদের ভাষা) হবে। এর কোনটাই বুঝার এলেম আমার পেটে নাই।
আমরা সাধারনত লোকালদের সাথে ইংরেজী বা ভাঙা উর্দু (হিন্দি মুভি দেখে শেখা) ভাষায় কাজ চলাই। প্রায় সব পয়সা অলা পরিবারেরই পাকেস্তানে আর একটা ঘর আছে। তাই এরা উর্দু প্রায় সবাই-ই পারে।
রোমাঞ্চকর ঘটনা। গেস্ট হাউসে আসার পর কল ব্যাক করলাম।
মেয়ে গলা। হাউ মাউ করে অজানা ভাষায় কত কি বল্ল অভিযোগ মাখা কন্ঠে তার ইয়াত্ত নাই। একবিন্দু যদি বা বুঝি! আর কোন ভাষাও জানেনা বোধহয়। তারপর শুরু হল মিসকল বন্যা। সামি (আফগান-আমেরিকান) কে জিজ্ঞাস করলাম।
সে বল্ল আমার এই অফিসিয়াল নাম্বার আগে ওমেদ নামের একজন ব্যবহার করত। আমরা আসার ক-মাস আগে ইউরোপ চলে গেছে। অনেক কষ্টে এই আজাব থেকে রেহাই পেলাম। সে লম্বা গল্প।
দিন যায়।
মাসও গেল। হটাৎ আন্য এক নাম্বার থেকে মিসকল আর মেসেজ। বাধ্য হয়ে ২/৪ টা মিসকল খেলাম। আবশ্যই গায়ে লাগবে কারণ প্রতি মিনিট ৫ আফগানী (= ৭ টাকা)। কোন পালস নাই (ক-এক বছর আগে আমাদের দেশে যে রকম ছিল)।
এবার দেখি কল করে মেয়েটা আমাকে কল ব্যাকের রিকোয়েস্ট করল। ভাব নিয়ে ৪/৫ মিনিট পরে ব্যাক করলাম। বেশ স্মার্ট। নাম সাহার। পুরা নাম ভুলে গেছি।
ঐ সময় আমার উর্দু এখনকার চেয়ে অনেক খারাপ ছিল। আর সাহার বেশ ইংরেজী বলে। অনেক্ষণ কথা হল। পুরা গোস্ঠির ইতিহাস শুনা হল। ১২ গ্রেডে পড়ে, বয়স ১৮।
২ ভাইয়ের ১ বোন। যুদ্ধের সময় পাকিস্তান ছিল।
এর পর হটাৎ হটাৎ মিসকল দিলে কথা হত মাঝে সাঝে। আস্তে আস্তে ইচ্ছা কমে এল। ইদানিং এড়িয়ে যেতাম।
বাংলাদেশের কল রেট খুব বেশি এখান থেকে। প্রায় ৩৫ টাকা পার মিনিট। কম্পানীর দেয়া ১০০ ডলারের কার্ড ছাড়াও আমরা VOIP'র উপর বেশি নির্ভরশিল। তাই বাজে খরচ পোষাবে না।
আরো কত মেয়ে যে ফোন করত তখন।
অনেকেই বলে দেবার পর আর ঝামেলা করত না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কাজ হত না। বাধ্য হলে মিসকল শিকার শুরু করতাম। ফল হত প্রায় তাৎক্ষণিক।
কিন্তু এক জন কে বাগে আনা গেল না।
খালি মিসকল মারে মাগার ফোন করলে কথা বলে না। পরে দেখি আর কলও ধরেও না। আমি কোন কুল করতে না পেরে আমার পার্সনাল নাম্বার থেকে ফোন দিলাম। জানি আপরিচিত কন্ঠের সাথে এই কঠিন চিজ কথা বলবে না। আমি হ্যালো হ্যালো করি কিন্তু অপর প্রান্ত নিরুত্তর।
চোর পালানোর আগেও অনেকের বুদ্ধি গজায়। ফট করে বল্লাম I am Omaid, Hum Omaid hu. দীর্ঘশ্বাসের শব্দ, অত্যন্ত সুরেলা গলায় ভেসে এল প্রশ্ন, যেন জলতরঙ্গ, ''ওমেদ? তুম ওমেদ হু?'' আমি বল্লাম ''আপ ওমেদ কু ঢুনড-রাহা?'' তারপর বুঝানোর চেষ্টা করলাম। আমি ওমেদ না, ২ মাস মাত্র কাবুলে। এই নাম্বারে কোন ওমেদ নাই। আমি এক অভাগা বাংলাদেশী।
মেয়ে শুনে আর হাসে। আর ফার্সিতে কত কি বলে। আমি বলি ''আগার তুমকো আংরেজী নেহি আতা, তো উরদুমে বাত কারো, মাগার দাড়ি-পাশতু নেহি বলনা প্লিজ। হাম সামাঝ নেহি পাতা। '' মেয়ে শুনে আর হাসে।
ওর উর্দূও আমার মত নড়বড়ে। সাথে আবার তার নিজের ভাষাও মিশিয়ে দেয় হটাৎ হটাৎ। আমি বার বার একই অনুরুধ করি উর্দূ বলতে। কিন্তু আমার ও লাইন কাটতে ইচ্ছকরে না! অনেক কষ্টে বুঝালাম আমি সে না, যাকে সে খুজছে। তারো একই কথা বার বার ''তুম ঝুট!, ঝুট!, ঝুট!''।
নাছোড়বান্দার মত সেও নব নব উদ্যমে মিসকল দিয়ে চলে। এই মজাদার যন্ত্রণাকে সেভ করলাম Crazy নামে। আবশ্য বার বার বুঝানোর পর আস্তে আস্তে মিসকলের হার কামতে কমতে প্রায় শূন্যের ঘরে ঠেকল।
গতকাল হটাৎ পুরানো ৩/৪ টা নাম্বার থেকে মিসকল এল বেশ ক-বার। সাহারও আছে তার মাঝে।
বার বার মনে হল কল করি। শেষ পর্যন্ত নিজেকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করলাম। সেদিন সপ্তার শেষ অফিশ, শুক্র-শনি ছুটি। তাই রাত ২/৩ টা পর্যন্ত গেম খেলে ঘুমাতে গেলাম। রাতে Crazy বেশ কবার মিসকল দিল।
অবশ্য ১১ টার আগে।
সকাল ৮টার পর আমার উপর দোজখ ভেঙে পড়ল যেন। Crazy, Crazy, Crazy। মিসকল, মিসকল, মিসকল।
ঘুমের মাঝে সাইলেন্ট করার কথও মনে এল না।
কয়েকটা মিসকল খাওয়ার পর মনে পড়ল সেই জলতরঙ্গের হাসির কথা। উঠে টেবিলে বসে ল্যাপটপটা অন করে সিগারেটে আগুন দিলাম। কল করে প্রায় ১২ ডলার খরচ করলাম। বুঝালাম, ''হাম খারেজি (বিদেশী) হু, ইয়ে আফগান হে, তুমারা সাথ এইসা বাত কারনা আছ্ছা নেহি হে। তুমারা বাপ-ভাই নে হাম কো মারকে যায়ে গি।
'' কার গোয়াল আর কে দেয় ধুয়া! মেয়ে শুনে আর হাসে। কথার সাথে আবার তার নিজের ভাষা মিশিয়ে দেয় হটাৎ। আর শুধু বলে ''ঝুট!, ঝুট!, ঝুট!, তুম ওমেদ হু, তুমারা আওয়াজ মুঝে ধোকা নেহি দে সেকতা!'' আর আমার দাড়ি না বুঝাটাও নাকি তাকে ধোকা দেবার চেষ্টা। এত মিষ্টি ভাবে বলে! নিজেকে ত ওমেদই ভাবতে মন চায়। কথায় কথায় জানা গেল ও সাহারের কাজিন।
১১ গ্রেডে পড়ে, উমর ১৭। ও ই সাহারকে দিয়ে ফোন করিয়েছিল। আর নাম জিজ্ঞাস করলেই খালি হাসে। বলে, ''তুম বাতাও, তুম ত জানতিহু''! আর কিইবা করা? তাই আমি ওর নাম দিলাম জেহের। তার সে কি হাসি।
বলে ''কিউ?, জেহের কিউ?''। আমি বল্লাম ''ওমেদ হল্যান্ড কি এক লাড়কি কি সাথ সাদি করকে হল্যান্ড চলা গিয়া। (কদিন আগে শুনা, কথা সত্য!) তুম ত উছছে বহত পেয়ার করতা হু। তো উসকি লিয়ে থোড়া সা জেহের খা-কি মার যাও না, হাম ভি বাচ যায়েগি!!!'' আবার জলতরঙ্গের শব্দ...। ওমেদ নাকি ১/২ দিন আগে সাহার কে ফোন করেছে।
তাও আমার নাম্বার থেকে। ওফ! পাগল নাকি? কি করি? বুঝলাম ওমেদ শালা যে ভাবেই হোক যোগাযোগ করেছে, তাই একমাত্র সূত্র আমার নাম্বারের উপর হামলা হচ্ছে সব দিক থেকে।
শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর স্থির রাখা গেল না। আমার মা'র কসম খাওয়াল, আমি ওমেদ না! তবুও তার অটল বিশ্বাস, আমি ঝুট তারপরও। এবার রাগ লাগল।
এই ময়ে অন্যের প্রমে পাগল, আমি কেন মরি মাঝে পড়ে? কাবাব মে হাড্ডি! দিলাম জোরসে বকা। বল্লাম তোমার এই নাম্বার বন্ধ করাব যদি আমাকে আর তাং কর । খুব রেগে দেঝানোর পর দেখলাম বেচারার গলায় কাদো কাদো ভাব। আমার কিইবা কারার? তিন ভাষা মিলিয়ে অনেক অভিযোগ করল ... অনেক অভিমান নিয়ে। আমি বল্লাম, ''মুঝে মাফ কার দো ভাই।
তুম ইয়া ওমেদ কিসিকিভি সাথ হামারা কোই লেনা-দেনা নেহি হে। তুম ইধার আওর ফোন মাত কারনা, প্লিজ। ''
এটা আজ ২০ জুন দুপুরের কথা।
এখন কাবুল টাইম রাত ১০ বাজে। এর মাঝে ঐ নাম না জানা বিদেশিনী আমার ২ ফোনে প্রায় ৩০/৩৫ বার কল করেছে।
আমি ধরি নি।
ঐ যে!, আবার রিং হচ্ছে ... Jeher!!!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।