আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাবুলিওয়ালার কথা (দুই)

মনের খোলা জানালয় কত আলো কত রঙ, খেলা করে চুপি সারে, আসে যায় কড়া নাড়ে ... ...

(পূর্বকথা) ঢাকা-চট্টগ্রাম, কাকরাইল-সচিবালয়, উত্তরা-গুলশান-বাসাবো এই করেই কাটল দেড়-দুমাস। জটিলতম কর্মযজ্ঞের পর, VISA-NOC পেয়ে মনে হল বিশ্বজয়ি আলেকজান্ডার কিছুই করে নাই। কেন্তু তার পরও শেষ রক্ষা হয় নি। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলাম। আবার জিয়া থেকে ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে ফেরত এলাম ... ।

আবার টেনশান, নেটে বসে ফিরতি মেইলের অপেক্ষা... আবার এয়ারপোর্ট, মাটির মায়া ত্যাগ করে নীল আকাশের ছোয়া ... হাপ ছেড়ে বাঁচা... আসলেই কি তাই? কাবুলিওয়ালার কথা (এক) পড়তে চাইলে: Click This Link (দুই) বিমানের ভেতর একুশে পরিবহনের মত জ্যাম। ভাবলাম ইমিরেটস্‌ও বুঝিবা এদেশের ভাও বুঝে গেছে!!! আমার নাম্বার মিলিয়ে গিয়ে দেখি সিটের দখল নিয়ে আছে কাল স্কার্ট-টপ পরা আরবী-আরবী চেহেরার এক কিশোরি, ১৩/১৪ হবে। বাংলা-ইংরেজী যাই বলি ফিরেই তাকায় না। হেডফোন লাগিয়ে গ্যাট হয়ে বসে আছে, গানের শব্দ পাচ্ছি। পরের সিটে আরেক পিচ্চি ১০/১১ হবে, ছোট বোন মনে হয়, মুচকি-মুচকি হাসে।

তৃতীয় সিটের দাড়িঅলা যদি এদের বাবা হয়, তাহলে মা নিশ্চয়ই অ্যারাবিয়ান। বেটাও কোন কথা বলে না, ভাব যেন কিছু দেখছে না। মহাবিপদ দেখি। ফিলিপিনো এক এয়ারহোস্টেস যাচ্ছিল, ঘটনা বলার পর ওয়েট বলেই হাওয়া। দেখলাম আমাদের প্রায় সবারই সমস্যা।

একটু পর রাজপুত্র টাইপ চেহারার লম্বা এক ছেলে এসে পাশের সিটে বসিয়ে দিয়ে গেল। সবাই ছডিয়ে-ছিটিয়ে গেলাম। এদিকে আমাদের আধাঘন্টার উপর লেট। একটু পর বিমান ৩২,০০০ ফুট ছুল। এনাউন্সমেন্ট হল সাগরে নিম্ন চাপের কারনে বিমান একটু ঘুরে যাবে, আধঘন্টা মত বেশি সময় লেগেছিল।

কিছুক্ষণ পরপর বাম্পিং হচ্ছে, সিটবেল্ট বেধে বিরস বদনে বসে আছি। আমার পাশে জানালা নেই, আগের সিট ছিল মাঝের রো-তে। এনাউন্সমেন্ট হল, আমরা নাগপুরের উপর। এল.সি.ড. স্ক্রিণে দেখাচ্ছে। বেল্ট খুলে টয়লেটের পাশের জানালায় দাড়ালাম নাগপুর দেখার জন্য।

গুগল-আর্থে দেখেছি এমন, অণূবিক্ষন যন্ত্রের নিচে যেন। ছাড়া-ছাড়া মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে উপরে নিচে। নাস্তা-লাঞ্চ করে Transformer দেখা শুরু করলাম, ক-এক দিন আগেও দেখেছিলাম অবশ্য। মাঝে কিছুক্ষন গান টান শুনলাম, হালকা-পাতলা ঘুমও মারলাম। হটাৎ দেখি মেয়েটার সিস্টেম হ্যাং, ওয়াক-ওয়ের দুপাশে দুজন।

বেচারা খালি টিপাটিপি করে, লাভ হয়না। করুন মুখে এদিক ওদিক করে। মনে মনে আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলাম। আমার দিকে চাইল হটাৎ, বাচ্চা-বাচ্চা চেহারা, কি করুণ-সুন্দর চোখ! হালকা নীল, ল্যান্স না কি? গাধাটা প্লেনের কাউকেও বলে না কেন? আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙার পর দেখি ২৫ মিনিটের মাঝে ল্যান্ড করবে।

হালুম হুলুম হাই তুলে একটু কফি চেয়ে নিলাম। আরামদায়ক মশৃণ ল্যান্ডিং। নামার পর সবাই মিলে এদিক ওদিক ঘুরে এক জায়গায় জড়ো হলাম। লোকাল টাইম পৌনে-একটায় আমরা ওখানে পৌছি। ১০ ডলার কার্ড কিনে দেশে কল দিলাম।

আব্বা-আম্মা, খালা, ফ্রেন্ডদের আর সৌদীতে ভাইয়াকে ফোন দিলাম। তারপর শুরু করলাম চক্কর মারা। ২ নম্বর টার্মিনাল দেখার মত সুন্দর। ১৮ ঘন্টা ট্রানজিট ছিল, পুরা দেখার এনার্জি হ্য়নি। একটা কথা এখানে বলা দরকার।

প্রতিবার টার্মিনালে ঢুকতে (টার্মিনাল ১ এবং ২) মেটাল ডিটেক্টরের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এ সময় বেল্ট, জুতা, ঘডি, মোবাইল, এম.পি.থ্রি., এমন কি মানিব্যাগ পর্যন্ত বাস্কেটে করে চালান দিতে হয়, মোজা পরে হাটতে হয় তিন-মত কদম। জঘন্য ব্যাপার। পরে অবশ্য শান্তি পেলাম, যখন দেখলাম এমন কি ইউরোপিয়ান দেরও খালি পায়ে ঐ পুল্‌শি রাত পার হতে হচ্ছে। যাক, এটা তাহলে শুধু এশিয়ানদের জন্য না! অনেক পরে দেখেছিলাম Mr. Djung USA থেকে আসার সময় বেল্ট-ই নাই।

পরের দিন বেল্ট পরা অবস্থায় দেখে বুঝলাম মামা কোন ঘাটের জল খেয়েছিল! লাঞ্চ করব, কিন্তু খাব কি? আধাসিদ্ধ সাদা সদা মাংস, দেখে ভয় লাগে। বাপ-রে! বার্গার আর আইসক্রিম ছাড়া খাবার কিছু নাই। আনেক ঘুরে ৪টা বার্গার, ফ্রেন্চ-ফ্রাই, কোক নিলাম মেকডোনাল্ড থেকে। ১০ ডলারে ভালই খাওয়া হল দুই জনের। বিকালের চা'র বিল চাইল ৪ ডলার করে! তাও অনেক ভাল।

রাতের খাবার সময়, পেটের মাঝে ছুচোর কেত্তন। এমন খিদা, ভাত চাই-ই-চাই। খুজে খুজে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট বার করলাম আমি, শৈকত ভাই আর জুয়েল ভাই মিলে। কেরালার রেস্টুরেন্ট, বান্দর টাইপের একটা পোলা আছে, আমাদের বয়সের। অনেক আলোচনা করে পোলাও-রোস্ট নিলাম।

১২ ডলার পার হেড। জুয়েল ভাই খাওয়ার ব্যপারে অসম্ভব খুত-খুতে। বেচারা ৩ চামচও খেতে পারে নাই। মাংসটার ভেতরে কিচ্ছুই ঢুকেনাই, মনে হচ্ছে শুধু স্টিমড্‌। বাইরে চামড়া (ওয়াক!) পুড়িয়ে লাল করা।

আমি কিছুটা খেলাম। আর শৈকত ভাই ভালই খেল। খুব দূঃখের ব্যপার, আবার আইসক্রিম। এদিকে সেন্ট্রাল এসি, মরুভূমির মাঝে মেরু অঞ্চল, মনে হচ্ছে জমে যাব। রাত ১টা মত ঘুরা-ঘুরি করে কিছুটা ঘুমিয়ে নিলাম।

আমাদের কানেকটিং ফ্লাইট সকাল ৭টায়। সমস্যা হল টার্মিনাল বদল করতে হবে। কাবুলগামী পাম এয়ার ছাড়বে ১ নাম্বর টার্মিনাল থেকে। টার্মিনাল চেন্জের জন্য ট্রানজিট লাউন্জে হাজিরা দিলাম ৩টার পর পর। ঘুমে উল্টে পড়ার অবস্থা।

কাউন্টারের লোকজন খুব স্লো, বাঙ্গালী নাকি? এখানে এই প্রথম বিরক্ত লাগল সার্ভিসে। বোর্ডং-পাস নেবার পর অনেক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। এইখানে বসার কোন জয়গা নেই। ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে সবাই কার্পেটর উপরই শুয়ে-বসে আরাম করলাম কিছুক্ষণ। সাড়ে চারটার দিকে ডাক পড়ল।

বাসে করে ২০ মিনিটের ধাক্কা। ১ নম্বর টার্মিনালের অবস্থা মোটামুটি সাধারন। নাস্তা-পানি খাবার পর অপেক্ষার পালা শুরু আবার। আমার পেটে প্রচন্ড চাপ, কিন্তু টয়লেটে গেলে কাজ হয় না, তাই মনে শান্তি নাই। ৭টার দিকে পাম-এয়ারের ডাক আসল।

আস্তে আস্তে সবাই লাইনে দড়ালাম। আবার বাসে করে বিশাল এয়ারফিল্ডের এক-কোনায়। পাশে দাড়ানো ৭৩৭ টা আমাদের বাহন। ছোট বিমানটার পেটের ভেতর সব দাড়ি-জোব্বা-পাগড়িঅলা বিশাল-বিশাল পাঠান দেহ, উজরস্থি-জিয়রস্থি (কেমন আছেন?-ভাল আছি!)। আমার পাশের লোকটা দারুন স্মার্ট।

২৫-২৬ হবে,সাদা কম্‌প্লিটে নায়কের মত লাগছে। ভালই ইংরেজি বলে। সিনিয়ররা আগেই মানা করেছেন লোকালদের সাথে মিশার ব্যপারে। তাই ইচ্ছা থাকলেও চুপ আছি। কিন্তু বিমান আর ছাড়ে না।

অনেক রামায়ন-মহাভারতের পর জানা গেল, ইন্জিনে সমস্যা। ভাগ্য ভাল আকাশে উঠার পর হয় নাই! এখানে-ত আর ধানক্ষেত নাই যে নিরাপদে এয়ার পারাবতের মত নামিয়ে দিবে! আবার টার্মিনাল-১। বিপদের উপর বিপদ। বার বার না খোলার জন্য বেল্টটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ছিলাম। পুরা ব্যাগ এবার খুলে দেখাতে হল।

একাকার অবস্থা। শুনলাম, পমের আজ কোন ফ্লাইট নাই আর। ইন্জিন সারাতে বিকাল হতে পারে। না হলে কাল সকালে ফ্লাইট নিশ্চিত!!!! অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর!!! (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।