লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। পুরষ্কার
মোহাম্মদ ইসহাক খান
আলম রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। রাস্তা দিয়ে বলতে রাস্তার পার্শ্ববর্তী ফুটপাত দিয়ে।
জঘন্য অবস্থা। বিড়ি-সিগারেটের অবশিষ্টাংশ, চিপসের প্যাকেট কিংবা কলার খোসা তেমন সমস্যার বিষয় নয়। সমস্যা হল, ফুটপাতের পাশের চিকামারা দেয়ালটিতে পানি দিয়ে মজবুত করার সদুদ্দেশ্যেই হোক (?!) কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক, কে বা কারা যেন পুরো ফুটপাত জুড়ে মূত্রত্যাগ করে রেখেছে, দুর্গন্ধে তিষ্ঠানো দায়। তার মধ্য দিয়েই লোকজন নির্বিকারভাবে পথ চলছে। একজন লোক লুঙ্গি তুলে তো আলমের ঠিক পাশেই বসে পড়লো, দেয়াল ঘেঁষে, আরও কিছু "পানি দিতে।
"
আলমের স্বভাব হল আশেপাশের মানুষগুলোকে লক্ষ করা, তাদেরকে নিয়ে চিন্তা করা, তারা কে কোথায় যাচ্ছে, তাদের সম্ভাব্য পেশা কী হতে পারে, এসব আন্দাজ করার চেষ্টা করা। এটা তার মজার একটি খেলা। তাই সর্বক্ষণ ওর চোখ চারপাশে ঘুরতে থাকে, সামনে, পেছনে, ডানে, বাঁয়ে। যেমন, ওর একটু পেছনে হেঁটে আসছেন একজন বৃদ্ধ লোক। পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো।
বোঝা যায় ডায়াবেটিসের রুগী, সকালের হাঁটা সেরে কোন একটা ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে ঢাউস সাইজের একটা বাঁধাকপি আর লালশাকের একটা আঁটি কিনে ফিরছেন।
আলমের ঠিক পাশ দিয়ে চলছে আরেকজন মানুষ, দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে। এই লোক যেকোনো পেশার হতে পারে, তবে গায়ের শার্টে কালি লেগে আছে দেখে মনে হয় কাছের কোন অটোমোবাইল শপে মেকানিকের কাজ করে।
আর আলমের আগে আগে দ্রুতবেগে চলছেন একজন ভদ্রমহিলা। তাঁর পোশাক ধোপদুরস্ত।
সম্ভবত তিনি একজন চাকরিজীবী, কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য হেঁটে চলেছেন, সামনের মোড় থেকে কাউন্টারে টিকিট কেটে বাসে উঠবেন কিংবা একটা ট্যাক্সিক্যাব নেবেন। পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে, তাঁর খাটো করে ছাঁটা চুলের রং হলুদ এবং নীল মেশানো, বেশ অদ্ভুত। আজকালকার চল হয়েছে যত অদ্ভুতের, সব স্বাভাবিক জিনিস উঠে যাচ্ছে। ছেলেরা পড়ছে গয়না, মেয়েরা চুলে দিচ্ছে কদমছাঁট। কে জানে, হয়তো আবার কোন একদিন পুরনো জিনিসগুলো ফিরে আসবে।
ভদ্রমহিলার কাঁধে ঝুলছে একটা বাহারি কাজ করা ভ্যানিটি ব্যাগ, হয়তো বিদেশী জিনিস। কিংবা কে জানে, হয়তো জিঞ্জিরাতে তৈরি, নিউমার্কেটের সামনে পসরা সাজিয়ে বসা কোন ঘাঘু দোকানী তাঁকে "এক নম্বর বিদেশী মাল" বলে গছিয়ে দিয়েছে।
এই মহিলাটির নিশ্চয়ই খুব তাড়া আছে, কারণ তিনি হাঁটছেন দ্রুত, এবং তাঁর কাঁধের ব্যাগটির চেন খোলা, কেমন ঝুলে হাঁ হয়ে আছে, তিনি লক্ষ করেন নি।
অসাবধানী লোকের বিপদ ঘটতে দেরী হয় না। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো।
মহিলার ব্যাগ থেকে টুপ করে পড়ে গেল চারকোণা কিছু একটা, তিনি টের পেলেন না। দেখতে পেলো আলম। একটু দ্রুতই এগিয়ে গিয়ে জিনিসটা হাতে তুলে নিলো সে। ওর পাশ দিয়ে চলে গেলেন বাঁধাকপি আর লালশাক হাতে বৃদ্ধ, তিনি রাস্তার অপর পাড়ে তাকিয়ে আছেন বলে দেখতে পেলেন না। আগেকার মানুষজন একে অপরের কর্মকাণ্ড খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত, আজকাল বড় একটা দেখে না, সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
হয়তো এটাই ভাল। জিনিসটাটা তুলে নেয়া তাই তাঁর চোখ এড়িয়ে গেল।
আলমের বুক ধুকধুক করছে। যে চারকোণা জিনিসটা ভদ্রমহিলার ব্যাগ থেকে পড়েছে, সেটা একটা পার্স। বড় ব্যাগের ভেতরে থাকে ছোট একটা ব্যাগ অর্থাৎ এই পার্স নামক বস্তুটি, তাতে থাকে একটা ছোট কুঠুরি, তারও ভেতরে ভাঁজ করে মেয়েরা টাকাপয়সা রেখে থাকে।
টাকা, কিংবা টাকার ব্যাগ হাতে এলে সম্ভবত সব মানুষেরই হৃদস্পন্দন একটু হলেও বেড়ে যায়, এবং গুণে দেখতে ইচ্ছে করে। আলমের ঘর্মাক্ত হাত তাই সচল হল, খুলে ফেললো পার্সের মুখটা। ভেতরে উঁকি দিচ্ছে একশো আর পাঁচশো টাকার কিছু নোট। আলম ঢোক গিলল।
কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই আলমের মনে একসাথে অনেক কিছু খেলে গেল।
সে এখন বেকার, পৃথিবীতে সবচেয়ে অবাঞ্ছিত গোষ্ঠীটির অন্তর্ভুক্ত বলে নিজেকে জ্ঞান করে। সম্পন্ন ঘরের ছেলে নয় সে, টিউশানি করতে হয়। গাঁটের পয়সা খুব হিসেব করে খরচ করতে হয়, নইলে মাসের শেষে টানাটানি লেগে যায়। সে হয়তো রাস্তার পাশে দশ টাকার একটা নোট পড়ে থাকতে দেখলে উঠিয়ে নেবে না, কিন্তু একটা টাকাভরা পার্সের ক্ষেত্রে বুকটা চিনচিন করবে বৈকি। গড়পড়তা মানুষের সততা একশো টাকা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, কিন্তু তাকে অনেক টাকার লোভ দেখালে পা ফসকানোর সমূহ সম্ভাবনা আছে।
কাজেই ভাগ্য যখন আলমের হাতে অচেনা রমণীর ব্যাগ থেকে পড়ে যাওয়া একটা টাকাভরা পার্স এনে দিল, তখন সে আলগোছে সেটা পকেটে ভরে ফেলবে, এটাই প্রত্যাশিত ছিল।
কিন্তু আলমের অপর সেদিন কিছু একটা ভর করেছিল। সে ভাবল, একটা পুণ্যের কাজ করি, কখনো তো সজ্ঞানে করে দেখিনি একটা ভাল কাজের স্বাদ কেমন! ভাল কাজ কোনদিন হয়ে থাকলে হয়ে গেছে অবচেতন মনে, আলম ইচ্ছে করে কোনদিন ভাল কিছু করেছে কীনা মনে করতে পারে না। কিন্তু অনেক খারাপ কাজ হয়ে গেছে, বড় বড় খারাপ কাজ নয়, সাধারণ ছোটখাটো অগনিত অন্যায় সে করেছে। যেমন এক টাকা ভাড়া নিয়ে বাসের কন্ডাক্টরের সাথে শুধু শুধু বাকবিতণ্ডা করা, মেয়েদের দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকানো (অবশ্য অনিচ্ছায়), মায়ের সাথে ঝগড়া করা, মুখ খারাপ করে কাউকে গালি দেয়া ইত্যাদি।
আজ আলমের হাতে সুযোগ এসেছে একটা ভাল কাজ করার। সজ্ঞানে, স্ব-ইচ্ছায়। যদি সেই রমণীটিকে পার্সটা ফেরত দেয়া যায়, তাহলে তিনি অনেক খুশি হবেন। এই কাজের জন্য সে কোন পুরষ্কার পাবে না, পাবে না কোন বাহবা, কিন্তু একটা ভাল কাজের আনন্দটা পাবে। তাই সে অন্য কিছু নয়, আনন্দটি পাবার জন্যই এগিয়ে গেল।
রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া পার্সটা পকেটে ভরে চলে গেলে কেউ তাকে দোষ দিত না, কারো কিছু বলার ছিল না, তবুও সে এটা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য স্থির সংকল্প হল। কুৎসিত কাজের প্রবৃত্তি হঠাৎ করে হাজির হয়, তেমনি বোধহয় ভাল কাজের প্রবৃত্তিও হাজির হয়।
সেই ভদ্রমহিলা অনেকটা এগিয়ে গেছেন, ফুটপাতের শেষ মাথায়। আলম প্রায় ছুটে গিয়ে তাঁকে ধরল। একজন অপরিচিতা মহিলাকে তো আর গায়ে হাত দিয়ে ডাকা যায় না, তাই সে পেছন থেকে ডেকে উঠলো, এই যে আপা!
মহিলা পেছন ফিরলেন না।
হয়তো রাস্তার কোলাহল আর যানবাহনের বিকট হর্নের শব্দে শুনতে পান নি, নয়তো ভেবেছেন, সে অন্য কাউকে ডাকছে।
আলম আবার পেছন থেকে ডাকল, এই যে আপা! আপনাকে বলছি, এই যে হলুদ চুল!
বলেই জিভ কাটল সে, হয়তো তাকে কেউ শেখায় নি বলেই সে জানে না কীভাবে একজন অপরিচিত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়, কিন্তু তাই বলে কি "হলুদ চুল" বলে কাউকে সম্বোধন করা যায়? আশেপাশে তাকাল সে, কেউ তার দিকে তাকিয়ে হাসছে কীনা। না, সবাই ব্যস্ত, কেউ তাকাচ্ছে না। সকালবেলায় সবাই ছুটে চলেছে নিজের গন্তব্যে, কারো "হাসার সময়" নেই।
সেই মহিলাটি এবার বুঝতে পেরেছেন আলম কাকে ডাকছে।
অপরিচিত এক যুবকের বিচিত্র সম্বোধনে খানিকটা অপ্রতিভ হয়ে তিনি তাকালেন।
আলম বলল, আপা, আপনার ব্যাগ থেকে এটা পড়ে গেছিল।
তিনি অবাক হয়ে একই সাথে নিজের ব্যাগের হাঁ হয়ে থাকা মুখটি লক্ষ করলেন, সেই সাথে হাত বাড়ালেন পার্সটি নেয়ার জন্য। তিনি বোধহয় কারো কাছ থেকে এমন অযাচিত উপকার আশা করেন নি, আজকাল কিছু একটা গেছে মানে একেবারেই গেছে, আর ফিরে পাওয়া যাবে না বলে ধরে নেয়া যায়।
তাঁর মুখে হাসি ফুটল।
আলমের মুখেও হাসি, সে হাসি নির্মল আনন্দের হাসি। সে তার সংকল্পের "ভাল কাজটি" করতে পেরেছে। ছোট কাজ, খুবই ছোট কাজ, তবুও, ভাল কাজ তো। কেমন যেন শরীরটা চিড়বিড় করছে আনন্দে! সে অপেক্ষা করতে লাগলো, মহিলাটি হয়তো একটা ধন্যবাদ দেবেন। সাধারণ ভদ্রতা।
কিন্তু মহিলাটি তা করলেন না। তিনি বোধহয় নগদ কারবার এবং অর্থমূল্যে বিশ্বাসী। যে পার্সটা তিনি এইমাত্র ফিরে পেলেন, সেটার চেন খুলে বের করলেন একটা একশো টাকার নোট। বাড়িয়ে ধরলেন আলমের দিকে। বললেন, নিন ভাই, এটা রাখুন।
এটা আপনার ... ...
"আপনার জন্য ছোট্ট উপহার" বলতে পারলেন না তিনি। এটা ঠিক উপহার নয়, কৃতজ্ঞতা নয়, এটা পুরষ্কার। বখশিশ।
আলম বিস্মিত হল। এই নারীটি কি জানেন না যে আলম শুধু একটা ভাল কাজের অবর্ণনীয় আনন্দের স্বাদ পেতে সে এটা ফেরত দিয়েছে? নাকি তার সাধারণ বেশভূষা দেখে তিনি ভেবেছেন যে বখশিশের আশায় সে এটা করেছে?
কিন্তু তা তো আর বলা যায় না।
হয়তো ভদ্রমহিলা এভাবেই তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন, তাঁর মনে অন্য কিছু, অবজ্ঞা কিংবা নাক উঁচু ভাব, এসব কিছু নেই। আলমকে হয়তো তিনি মোটেই ছোট চোখে দেখছেন না।
আলম হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিলো। কড়কড়ে নতুন একশো টাকার নোট, মুঠো করে ধরলে খসখস আওয়াজ হয়। নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে দেখতে ইচ্ছে হয়।
ভদ্রমহিলা আর দাঁড়ালেন না। পার্সটা ব্যাগে ভরে, ব্যাগের চেন আটকে তিনি চলে গেলেন তাঁর কাজে।
আলম যেখানে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তার কেন যেন খুব অপমান বোধ হচ্ছে। নিজেকে খুব ছোট জাতের কোন প্রাণী বলে মনে হচ্ছে।
*****
আগুন জ্বলছে। আগুনে পুড়ে খুব দ্রুত ছাই হয়ে যাচ্ছে একশো টাকার নোটটা।
গ্রামদেশে একটা কুসংস্কার আছে; টাকাপয়সা ছিঁড়তে, পায়ের নিচে ফেলতে কিংবা পোড়াতে নেই, এতে অমঙ্গল হয়, টাকাপয়সা আসা বন্ধ হয়ে যায়, সংসারে অভাব নেমে আসে ইত্যাদি। কিন্তু আলমের মনে হচ্ছে, একশো টাকার নোটটির এই শাস্তিই প্রাপ্য ছিল। তার ছোট্ট ভাল কাজটির আনন্দ এই শুকনো পার্চমেন্টের টুকরোটি নষ্ট করে দিয়েছে।
(৩১ জানুয়ারী, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।