রাজনীতির কৌশল, উন্নয়নের সমন্বয়
ফকির ইলিয়াস
====================================
সংলাপ প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। মে মাসের মধ্য ভাগেই শুরু হবে ফাইনাল সংলাপ পর্ব এটাও মোটামুটিভাবে সবাই ধারণা করছেন। এখন বক্তব্য দিচ্ছেন বর্তমান সরকারের কর্ণধাররা। বেশ কিছু কৌশল পরিবর্তনের সম্ভাবনাও লক্ষ্য করছেন দেশবাসী। বিএনপির সংস্কারপন্থিরাই শেষ পর্যন্ত সংলাপ করেছেন সরকারের সঙ্গে।
খালেদাপন্থিরা বলেছেন, তারা খালেদা জিয়া ছাড়া সংলাপ, নির্বাচন কোনটাতেই যাবেন না। এদিকে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি মত পাল্টিয়েছেন। নির্দিষ্ট বয়সে রাজনীতি থেকে অবসরের যে কথা তিনি বলেছিলেন তা থেকে তিনি সরে এসেছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, রাজনীতিতে থেকেই তিনি আজীবন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যেতে চান।
একজন জাতীয় নেতা কিংবা নেত্রী, জাতীয় প্রয়োজনে তার মত পাল্টাতেই পারেন।
কাউকে রাজনীতি থেকে অবসর নিতে হবে এমনও কোন কথা নেই। শেখ হাসিনা রাজনীতিতে থাকছেন এবং আগামী দিনে আওয়ামী লীগের কর্ণধার হয়েই থাকবেন এটাও প্রায় নিশ্চিত। কারণ চাপ দিয়ে দুই প্রধান দলে যোগ-বিয়োগের যে কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছিল তা জনগণ খুব একটা আমলে নিয়েছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন না।
এমনকি বিদেশী দাতা, মিত্রদেশগুলোর বিভিন্ন মুখপাত্রও বলছেন, মানবাধিকার ক্ষুন্ন করে কিংবা প্রমাণহীনভাবে কয়েদে রেখে বাংলাদেশে দল ভাঙা যাবে না। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী শেরি ব্লেয়ার বাংলাদেশ সফর করেছেন।
তিনি খুব জোর দিয়ে বলেছেন, মানবাধিকার ক্ষুন্ন করে গণতন্ত্র রক্ষা করা যায় না। একই কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদতের মুখেও। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, শেখ হাসিনার চরম অসুস্খতাকে অবজ্ঞা করে কেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এমন আচরণ করছে তা বোধগম্য হচ্ছে না অনেকের কাছেই। শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি যে কোন সময় স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। তার শারীরিক অবস্খা খারাপের দিকেই এগুচ্ছে!
অন্যদিকে বিএনপির সংস্কারপন্থিরা বেগম খালেদা জিয়াকে তাদের নেত্রী বলে মানলেও তার আদেশ তারা মানছেন না।
এমন অভিযোগ করেছেন খালেদা জিয়া মনোনীত মহাসচিব খন্দকার দেলোওয়ার হোসেন। সাইফুর-হাফিজপন্থিরা বলছেন, তারা ঐক্যবদ্ধ হবেন। কিন্তু এই ঐক্যের প্রক্রিয়া কি, কীভাবে হবে তার কোন আলামত দেখছে না দেশবাসী।
সব মিলিয়ে যে বিষয়টি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে তা হচ্ছে সংলাপের নামে সরকার তাদের ইচ্ছে চাপিয়ে দিতে চাইছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। আর সে জন্যই তৃণমূল পর্যায়ে দুই নেত্রীর মুক্তির দাবি তাই জোরালো হচ্ছে প্রতিদিন।
দুই.
নির্বাচন আদৌ হবে কিনা, হলে তা কতটা অর্থবহ হবে তা নিয়ে সংশয় বাড়ছে সাধারণ মানুষের মনে। চ্যানেল আইতে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের একটি সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজাকে দেয়া সে সাক্ষাৎকারে এই নেতার মুখেও দ্বিধা প্রকাশ পাচ্ছে বলে আমার মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, প্রতিদিন মানুষ তার কাছে জানতে চাইছে নির্বাচন হবে তো?
নিউইয়র্কে একটি মতবিনিময় সভায় একই মঞ্চে বসেছিলেন বামপন্থি নেতা রাশেদ খান মেনন ও জাতীয় পার্টির একাংশের নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। এই দুই নেতা একই কণ্ঠে বলেছেন, শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়াকে বন্দি রেখে সংলাপ কখনই সফল করা যাবে না।
এই দুই নেতা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ বলেও মত প্রকাশ করেছেন। মেনন এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, দুই নেত্রীকে গ্রেফতার করাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তিনি বলেন, তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
দেশে-বিদেশে একটি বিষয় বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে কিংবা হচ্ছে তার ভিত্তি কতটুকু মজবুত। কারণ এসব অভিযোগ যদি এতই শক্তিশালী হয়ে থাকে তবে সঠিক আইনি প্রক্রিয়ায় চার্জশিট গঠনে এতটা গড়িমসি করা হচ্ছে কেন? কেন এখন পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের সঠিক তারিখ ঘোষণা করা হচ্ছে না? প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, সামনে রমজান মাস, দুই ঈদসহ বিভিন্ন কারণ থাকায় এখনও সঠিক তারিখ দেয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু রোডম্যাপের গতিধারা ঠিক রাখতে হলে তো তফসিল ঘোষণার পর্ব কার্যাবলী ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হওয়ার কথা।
নির্বাচনের আগে জরুরি অবস্খা তুলে নেয়া হবে কিনা তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে বর্তমান সরকার। কারণ এ কথাটি খুবই সত্য যে, জরুরি অবস্খা তুলে নেয়ার পরপরই নির্বাচনী কার্যক্রম তুঙ্গে চলে যেতে পারে। দুই নেত্রীর মুক্তির দাবিতে লাগাতর কর্মসচি ঘোষণার সম্ভাবনাও ক্ষীণ করে দেখার নয়। সবচেয়ে বেশি শঙ্কার কারণ হচ্ছে, জরুরি অবস্খা উঠে গেলেই সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী শক্তি বাংলাদেশে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
বিভিন্ন অপকর্মের হার বেড়ে যেতে পারে।
দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের মাঝে বিরাজ করছে এক ধরনের অস্খিরতা। যারা বলছেন ৩৬ বছরে বাংলাদেশ অনেক কিছুই পেয়েছে, তাদের জানা উচিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় দেশের উন্নয়ন বাড়েনি। শুধু দেড় কোটি মানুষের হাতে মোবাইল ফোন থাকা এবং দু’চারটি ভাঙা রাস্তা মেরামতের নামই উন্নয়ন হতে পারে না। এই চরম দাবদাহের সময়ে রাজধানীর মানুষের লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের গ্রামান্তরের মানুষরা কেমন আছেন! হালকা বৃষ্টি হলেই শহরের পয়:নিষ্কাশনের নালাগুলো উপচে পড়ে রাজপথে।
তার কারণ হচ্ছে দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে নর্দমা পরিষ্কার করার পদ্ধতি এবং কার্যক্রম এখনও আধুনিকতার ছোঁয়াই পায়নি। বড় বড় ইমারত গড়ে উঠলেও এর পাশাপাশি স্যানিটারি বিষয়টি যে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে জড়িত তা বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, পৌর কর্তৃপক্ষ, নগরায়ন বিভাগ সবাই।
তিন.
একটি রাষ্ট্রে গণপ্রতিনিধি এবং প্রশাসক এই দুটি পক্ষের সমন্বয় কর্মের মাধ্যমেই সাধিত হয় সর্বপ্রকার উন্নয়ন। রাজনীতিকরা জনগণের প্রতিনিধি, আর প্রশাসকরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। গণতান্ত্রিক বিশ্ব এই ধারাই মেনে চলে।
উন্নত দেশগুলোতে আমরা দেখি জনপ্রতিনিধিরা আইন পাস করেন। প্রশাসন তা প্রয়োগ করে মাত্র। এবং তা হয়ে উঠে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে। দরিদ্র এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোতে জনপ্রতিনিধিরা নষ্টের দখলে চলে যায় বলেই প্রশাসকরা লাই পায়। প্রশ্রয় পেয়ে নানা কুকর্মে তারাও জড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে এই দুর্নীতি, রাজনৈতিক হানাহানি, সর্বোপরি দেশের প্রতি মমত্বহীনতার কারণে সামাজিক উন্নয়নটি পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়েছে তিন যুগেরও অধিক সময় ধরে। গ্রামে-গ্রামান্তরে ফতোয়বাজের মতো দুষ্টগ্রহ বেড়ে উঠেছে এক শ্রেণীর রাজনীতিকের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই। কেউ এর প্রতিবাদ করলে, ধর্মের দোহাই দিয়ে এসব অর্ধশিক্ষিত সামাজিক তস্করদের বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে কোন কোন রাজনৈতিক কাফেলা।
ফলে প্রকাশ্যে মুণ্ডুপাতের মতো হুমকি দিলেও রাষ্ট্রপক্ষ তাৎক্ষণিক এসব তথাকথিত ‘রাজনীতিবিদ’দের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্খা নেয়নি। আজ সবাই মিলে যে ধকল সইতে হচ্ছে তা সেই ‘দেখেও না দেখা’র ফসল মাত্র।
রাজনীতি করতে হলে তো ''চোখ থাকিতে অন্ধ" সাজার ভান করা উচিত নয়।
বাংলাদেশে ২০০৮ সালে রাজনীতির কৌশল বদলানোর চেষ্টা অনেকের মাঝেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যে সাইফুর-হাফিজরা আজ বলছেন, চৌদ্দ বছর ধরে বিএনপির কাউন্সিল হয়নি তারা খালেদা জিয়ার সামনে ‘রা’ করেননি। বরং হাওয়া ভবনের পদলেহনে ব্যস্ত ছিলেন। কৌশল বদলে শেখ হাসিনা রাজনীতিতে থেকে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রায় প্রতিদিনই কৌশল বদলাচ্ছে বর্তমান তদারকি সরকার। কিন্তু রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন সাধনের জন্য কি সমন্বয় ঘটানো দরকার, জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কি কাজ করা অত্যাবশ্যক সে চিন্তায় সব পক্ষেরই ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
রাষ্ট্রের উন্নয়ন চাইলে সব কাজে স্বচ্ছতা প্রদর্শন করতে হবে রাজনীতিবিদ, প্রশাসক সবাইকেই। মনে রাখতে হবে যারা এই দেশ মাতৃকার জন্য প্রাণটি উৎসর্গ করেছিলেন, সেই ত্রিশ লাখ শহীদের একটিই স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলাদেশ।
রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা অনৈক্য এবং প্রকৃত দেশপ্রেমের অভাবই আজ এমন চরম সঙ্কট সৃষ্টি করেছে।
কৌশল যতই বদলানো হোক না কেন উন্নয়নের সপক্ষে সত্যিকারভাবে আন্তরিক না হলে এ সঙ্কট বাড়তেই থাকবে।
------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ। ঢাকা । ৯ মে ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।