জাদুনগরের কড়চা
------
[পর্ব ১] [পর্ব ২] [পর্ব ৩]
-----
ডিম চাইনিজ
রশীদ হলে রাতের দিকে ১২টার পরে হলের ছেলেরা সব বেরিয়ে পড়তো। যারা দেরী করে ফিরেছে হলে, তারা হয়তো ডাইনিং এর খাওয়া মিস করেছে ... অথবা পড়াশোনা করতে করতে আঁতেল গোছের ছাত্রদের খিদে পেয়ে গেছে ... সবাই যেতো হলের ক্যান্টিনে, অথবা পলাশীর মোড়ে।
হলের ক্যান্টিনে রাত ১১টার পর থেকে পাওয়া যেতো পরোটা, গরুর মাংসের ঝোল (যদিও মাংসের বদলে তাতে থাকতো হাড্ডি), ডাল, ডিম ভাজি ইত্যাদি। পলাশীর মোড়ে খুলতো ইটালিয়ান হোটেল ... ইটালিয়ান কারণ অনেকটা ইটের উপরে বসার ব্যবস্থা, অথবা কপাল ভালো হলে বেঞ্চ, আর সেখানে পাওয়া যেতো সদ্য ভাজা পরোটা, আর রকমারী ডিমভাজি। বাহারী নাম তাদের, যেমন ডিম পাটোয়ারী, ডিম চাইনিজ ... পাটোয়ারীটা কী তা মনে করতে পারছিনা, কিন্তু চাইনিজটা ছিলো স্ক্র্যাম্বল্ড এগ ... ডিমকে ভেজে তার পর ঝুরা ঝুরা করে দেয়া।
বন্ধু বান্ধবদের সাথে বিস্তর সেখানে রাতে খেয়েছি ... সদ্য ভাজা পরোটা আর ডিমে এতো মজা আর পাইনি কোথাও।
জীর্ণ মোষদলের অন্তিমযাত্রা
সেই ইটালিয়ান হোটেলের বেঞ্চে বসে ডিম চাইনিজ খেতে খেতে রাতের ঢাকার রূপ দেখতাম। উল্লেখযোগ্য যে ব্যাপারটা চোখে পড়তো, তা হলো গবাদীপশুর বিশাল মিছিল। উত্তরবঙ্গ থেকে গাবতলীর হাট দিয়ে এগুলো এসে পলাশীর রাস্তা দিয়ে যেতো বিভিন্ন বাজার আর কসাই খানাতে, পরদিনের বিক্রি হওয়া মাংসের যোগান দিতে। মজার ব্যাপার হলো, যতদিন দেখেছি এই পশুর মিছিল, কোনো সময়েই গরু দেখিনি এই মিছিলে।
গরুর বদলে ছিলো মোষ ... জীর্ণ শীর্ণ মোষের দল।
এতো সব মোষ কোথায় যায়, তা অবশ্য বুঝতে সমস্যা হয়নি। আমাদের হলের ডাইনিং এ গরুর মাংসের নামে যা দিতো, তা সব সময়েই হতো ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের। গরুর মাংসের লালচে আভা দেখিনি, কালো রঙ, আর শক্ত ভাবে দেখে বোঝা যেতো, এগুলো সেই মোষের মিছিল থেকে উদ্ভুত।
---
cliche গল্পের ডাল
হলের ডাইনিং এর ভাত যারা একবার খেয়েছে, দুনিয়ার যেকোনো খাবারই নির্বিবাদে খেয়ে ফেলতে পারবে, তা বলতে পারি নিঃসন্দেহে।
হলের ডাইনিং এর খাবার নিয়ে কিছু cliche, অর্থাৎ বহুল প্রচলিত, এবং অতি-ব্যবহারে বিপর্যস্ত গল্প চালু আছে, একটা হলো এরকম, গল্প লেখক হলের ডাইনিং এ গিয়ে ডালকে হাত ধোয়া পানি, অথবা হাত ধোয়া পানিকে ডাল মনে করে খেয়ে ফেলেছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। বেশ কয়েকজনের লেখাতে এই একই গল্প পড়ে মনে হতো আগে, বোধ হয় কেউ কারো গল্প মেরে দিয়েছে।
রশীদ হলের ডাইনিং এর ঐতিহাসিক ডাল দেখে অবশ্য এই গল্পের শানে নযুল টের পেয়েছি প্রথম দিনেই। আমার আবার ঘন ডাল পছন্দ, তলানি থেকে নেয়াটা অভ্যাস। সমস্যা বাঁধতো, যখন পাতলা ডাল খাওয়া কারো পাশে বসতাম, পাশের জনে চামচ দিয়ে ঘুটা দিয়ে পুরো ডালের মিশ্রণকে সমঘনত্ব (শূন্য ঘনত্বের কাছাকাছি) করে ফেলতো, তখন সেই ডাল, আর হাত ধোয়া পানির মধ্যে পার্থক্য থাকতো না।
ডাইনিংএ মোষের মাংসের হাড্ডি আলু ঝোল ছাড়াও বিচিত্র সব খাবার মিলতো। একবার লাল শাক মুখে দিয়ে টের পেলাম, শক্ত কিছু ... গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো হিটারের কয়েলের তারের কিছু অংশ! কাঠের টুকরা, পাথর এসব তো মিলতোই। চিল্লাচিল্লি করে বেশি লাভ হতো না, যে কে সেই অবস্থা।
প্রতি বেলার খাবারের মূল্য ছিলো ৮ টাকা, কাজেই অবশ্য এই টাকাতে কিছু মিলতো সেই বড়ো কথা। পুরো মাস এভাবে আধাপেটা খেয়ে থাকতে হতো, কিন্তু ছেলেপেলে আপত্তি করতোনা, কারণ সবুরে মেওয়া ফলে, আর ঠিক একই ভাবে পুরো মাস পাথর, মোষ, তার, ডালস্য পানি - এসব খেয়ে পেটে পাথর বেঁধেই সবাই তীর্থের কাক হয়ে থাকতো, তার প্রধান কারণ হলের ফিস্ট।
---
পেটে খেলে পিঠে সয়
রশীদ হলের ফিস্ট ছিলো এক দেখার মতো মচ্ছব। প্রতিদিনের বাজার করার বাজেট যেখানে হাজার চারেক আটেক, সেখানে ফিস্টের বাজেট ছিলো ৫০ হাজার থেকে লাখ খানেক টাকার মতো। কারণটা পরিস্কার, ফিস্টে প্রায় ৯-১০ পদ রাজভোগ খাওয়ার আয়োজন হতো। কাচ্চি বিরিয়ানী, মুরগীর আস্ত রোস্ট, কাবাব, মাছ ভাজা, খাসির রেজালা, মিষ্টি, জর্দা, আপেল/আম, কমলা, পায়েস, বোরহানী, আর কোক/পেপসি । এই ফিস্ট খেতেই অন্য হলের অনেকে আসতো রশীদ হলে।
পুরো মাসের সব হা-পিত্যেস করা লোকজনে এই এক দিনের রাজকীয় খানাদানা পেয়ে খুশি থাকতো বেজায়। আর মোটাসোটা থেকে শুরু করে কাকলাশ টাইপের রোগাভোগারাও যে পরিমাণে বিরিয়ানী টানতো, তাতে বোঝা যেতো, সবাই পয়সা উশুল করছে এই এক বেলাতেই।
হলের ডাইনিং এর বাজার করার দায়িত্ব পেতো দুইজন ম্যানেজার। পেশাদার নয়, বরং প্রতিমাসে ছাত্রদের মধ্য থেকেই ম্যানেজার নিয়োগ করা হতো। আর এই দায়িত্ব পাওয়ার জন্য কাড়াকাড়িটাও দেখার মতো।
রীতিমতো দরখাস্ত দিয়ে আবেদন করে প্রভোস্টকে ইন্টারভিউ দিয়ে ম্যানেজারি পেতে হবু-প্রকৌশলীদের প্রবল প্রচেষ্টা লক্ষ্যনীয় ছিলো।
কারণটা আর কিছুই না ... গোপন সূত্রে শোনা যেতো, ম্যানেজারি পেলে প্রতি দিনের বাজার থেকে কিছু টাকা হাতানো যায়, হলের ৫০০ ছেলের বাজার প্রতিদিনে হাজার আটেকের মতো, তা থেকে শ পাঁচেক দিনে হাতাতে পারলেই মাসে ৩০ হাজারের উপরে জমে। তাই বেশ কিছু ছাত্র আপ্রাণ চেষ্টা করতো ম্যানেজারির খাতায় নাম লেখাতে। আর ম্যানেজারি করে সিনিয়র অনেক ভাই সেই মাসে কম্পিউটার কিনেছেন, এই কথাও বেশ প্রচলিত ছিলো।
ম্যানেজারদের এই টাকাচুরি সাধারণ ছাত্রদের প্রচন্ড ক্ষোভের কারণ ছিলো, মাসের ২৯ দিন পাথুরে চাল, মোষের হাড্ডি - এসব খেয়ে খেয়ে সবার রাগ যখন তুঙ্গে, তখন তাদের ঠাণ্ডা করার জন্যেই ফিস্টের দিন বিশাল খাওয়া দাওয়ার আয়োজন থাকতো।
বুয়েটের ছাত্ররা গড় হিসাবে গোবেচারা, তাই সেই ফিস্টের রাজভোগ খেয়েই সব যেতো ভুলে।
লেপ তোষকের বনফায়ার
তবে, অতি লোভের জন্য ম্যানেজারদের কেউ কেউ হিসেবে ভুল করে বসতো। শেষ করছি সেরকম অতি-লোভী এক ম্যানেজারের কাহিনী দিয়েই। সেবার পুরো মাস যথারীতি বাজে খেয়ে সবার মেজাজ তিরিক্ষি, ম্যানেজার ভাই নাকি একটার বদলে দুইটা কম্পিউটার বাগাচ্ছে বলে গুজব চালু বাজারে। সবাই তাই বেশ আশা করে ফিস্টে হাজির, যদি ফিস্টে খেয়ে টাকা উশুল হয়।
কিন্তু ম্যানেজারের দ্বিতীয় কম্পিউটার, অথবা মটর সাইকেলের দাম মেটাতে গিয়ে ফিস্টের বাজেটেও টান পড়েছে, যার ফলে ফিস্টে কাচ্চির বদলে সাধারন পোলাও, মুরগির আস্ত রোস্টের বদলে কোয়ার্টার রোস্ট, রেজালাও বাদ, আর কোকের বোতলের বদলে আধা সাইজের পেপসির ক্ষুদে বোতল। ফলও লাপাত্তা। মেসের বাজার করার ছোকরাকে দুটো ধমক ধামক দিতেই সে জানালো, প্রতিদিন বাজারের টাকা থেকে শ-চারেক পাঁচেক সরানোর আদেশ ম্যানেজার দিয়েছে, আর সেও পুরো মাস ধরে তা দিব্যি পালন করে চলেছে।
পুরো মাসের সঞ্চিত ক্ষোভ এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, আর গোবেচারা ছাত্ররাও কী করতে পারে, দেখা গেলো। ফিস্ট থেকে বেরুতেই দেখলাম, হলের বারান্দায় হঠাৎ একজন আছাড় মেরে পেপসির ক্ষুদে বোতল ভাঙলো, তার দেখাদেখি সবাই লাগাতার ভাঙা শুরু করলো বোতল।
শুরু হয়ে গেলো শ্লোগান, "ম্যানেজারের চামড়া, তুলে নেবো আমরা"।
আমার দুই রুমমেট, রমণীমোহন আর শিল্পপতি ভাই, দুজন এমনিতে বেশ নির্বিবাদী। কখনো কারো সাথে এমনকি উঁচু গলাতেও কথা বলতে দেখিনি। কিন্তু হলের সেই ম্যানেজারবিরোধী উত্তাল আন্দোলনের জোয়ারে তাঁদের জোশ দেখে আমি তাজ্জব। সবাই ম্যানেজারকে এক দফা "বানানো"র জন্য খোঁজাখুজি করছিলো, কিন্তু ম্যানেজার ভাই টাকা মারাতে বেকুব হলেও সময় মতো আক্কেলমন-চরিত্রের পরিচয় দিলেন ... ঘটনার আভাস পেয়ে মুহুর্তেই গায়েব।
ছেলে পেলে পেটের সুখ, হাতের সুখ মেটাতে উদগ্রীব। কী আর করা, ম্যানেজারের রুমে অভিযান শুরু হলো। কম্পিউটার সম্ভবত আগেই সরিয়ে ফেলা ছিলো, কাজেই ম্যানেজারের বইপত্র আর লেপ তোষক মশারী ছাড়া আর কিছু জুটলোনা।
বুয়েটের ছেলেপেলে, হাজার হলেও আঁতেল পরিচয়, তাই বইপত্র পোড়াতে মন সায় দেয়নি। কাজেই সবাই মিলে লেগে পড়লো চোর ম্যানেজারের লেপ-তোষক আর মশারী পোড়াবে, সেই বনফায়ার শুরুর উদ্যোগে।
বিস্মিত হয়ে আমার দুই রুমমেটকে এই বহ্নুৎসবে নেতৃত্ব দিতে দেখলাম, স্যোৎসাহে লেপ তোষকে আগুন দিয়ে মনের সুখ মেটাতে সবাই চরম আনন্দে উদ্বেল।
পরে একজনে জানিয়েছিল, ম্যানেজারের লেপ-তোষক-চাদর সম্ভবত চার/পাঁচ বছরে কেউ পরিস্কার করা বা রোদে দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। এতোই চিটচিটে বোঁটকা ছাগগন্ধ ছিলো সেখানে, আগুন ধরাতে ফুয়েল-ফ্ল্যাশ-পয়েন্টের নাড়ি নক্ষত্র জানা হবু প্রকৌশলীদেরও বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আর পোড়ানোর পরে বোঁটকা যে গন্ধ ছড়িয়েছিলো, তার কথা না হয় নাই বললাম।
--
পাদটীকা - মেস ম্যানেজার সপ্তাহ কয়েক গা ঢাকা দিয়ে পরে দিব্যি ফেরত এসেছিলো।
ততোদিনে বিপ্লবী আঁতেল ছাত্ররা পরের মাসের ম্যানেজারের শাপ-শাপান্ত করতে ব্যস্ত, যদিও সেই ম্যানেজার আর একই ভুল করেনি, বিশাল ফিস্ট দিয়ে সবাইকে ঠান্ডা করে দিয়েছিলো। হলের কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করে রীতিমত সাক্ষ্য গ্রহন-টহন করেছিলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোষক-বনফায়ার ধামাচাপাই পড়ে যায়।
আর হলের সেই মোষের মাংস খেয়ে আমাদের শরীরটাও কিন্তু ছিলো বেশ ভালো, হলের ছেলেপেলে হৃষ্টপুষ্ট না হলেও মারা পড়েনি। কেবল বুয়েটের হলের মিনারেল সমৃদ্ধ পানি খেয়ে অকালেই অনেকে চুল হারিয়েছিলো, এই যা।
[চলবে]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।