আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঈমান কেন প্রয়োজনীয়?

আমি একজন মুসলিম

পরম করুনাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। ঈমান আনা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? বর্তমানে অনেকেই বলে যে, এই সব ধর্ম বা স্রষ্টায় বিশ্বাস এর কোন প্রয়োজন নেই। আমরা ভাল কাজ করলেই তো হয়। তারা নতুন এক ধর্মের কথা বলে যার নাম হল মানবধর্ম। মানবধর্ম কি? মানুষ হল সবকিছুর উপরে।

Ethics এর এক ক্লাশে বিভিন্ন মনীষীর দেয়া Ethics এর সংজ্ঞা পড়ানো হচ্ছিল। এক মনীষীর মতে, মানুষের মূল্য হচ্ছে পরম। মানুষের উপকারে আসে এরকম সব কাজই হচ্ছে নৈতিক কাজ। খুবি চমৎকার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের তত্ত্ব জেনেও কারো চরিত্রের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না।

Ethics এর ক্লাশ করে একজনের চরিত্র বদলে গেছে এরকম মানুষ আমি পাই নি। একেবারে গোড়াতে আমাদের মৌলিক কিছু সমস্যার সমাধান না করা পর্যন্ত আমাদের চরিত্র বদলাবে না। একজন মানুষের জীবনের লক্ষ্য কি তার উপর নির্ভর করে তার নীতি কিভাবে নির্ধারিত হবে। কাজেই আমাদের জীবনের লক্ষ্যকে সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। জীবনের লক্ষ্যকে সঠিকভাবে নির্ধারণ করাটাই হল ঈমান আনা।

ঈমান মানে কি শুধু বিশ্বাস? আমার কাছে তা মনে হয় না। কারন শুধু বিশ্বাস করাটাই যদি ঈমান হয়, তাহলে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই মুমিন। কিন্তু মুমিন হওয়া কি এত সহজ? একবার কিছু সাহাবী ইসলামে প্রবেশ করে নিজেদের মুমিন বলছিলেন। তখন তাদেরকে বলা হল যে, তোমরা নিজেদেরকে মুমিন বল না, বল যে তোমরা ইসলামে প্রবেশ করেছ। আরো কিছু উদাহরন দেখা যাক।

ফিরআউন কি মুমিন? ফিরআউন কিন্তু আল্লাহকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করত। শয়তান কি মুমিন? কোন সাধারন মানুষের শয়তানের থেকে বেশি আল্লাহর উপর বিশ্বাস নেই। তারপরও শয়তান মুমিন না। তাহলে ঈমান আনা বলতে আসলে কি বুঝায়? এ ব্যাপারে পরিষ্কার জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। আমি নিজেও এখনও এ ব্যাপারে পুরোপুরি জ্ঞান অর্জন করতে পারি নি।

এখানে আমি এ পর্যন্ত যা বুঝে এসেছি তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। একজন মানুষ যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন তার ভিতরে ভালবাসা, দয়া, উদারতা, সদয়ভাব, সৌজন্যবোধ ইত্যাদি গুনাবলীগুলোর বীজ বপণ করা হয়ে থাকে। এ গুণগুলো প্রত্যেক মানুষের ভিতর সহজাত ভাবে থাকে। অর্থাৎ একটি শিশুর জন্ম নেওয়া মানে একটি গাছের চারা রোপিত হওয়া। এখন এই চারাটাকে বিকশিত করতে হবে।

এই পৃথিবী হল সেই চারার বিকশিত হবার মাধ্যম। কোন মানুষ যত বেশি ভালবাসা, দয়া, উদারতা ইত্যাদি সদগুণগুলো অনুশীলন করবে তার সেই চারাটা তত বেশি বিকশিত হবে, সুস্থ-সবলভাবে বড় হবে। আর সে যদি তার উল্টোতা করে, অর্থাৎ অন্যায়, অত্যাচার করে তাহলে সে সেই চারাটাকে ধ্বংস করে। কুরআনে আল্লাহ বারবার বলছেন যে, তোমরা তোমাদের আত্মার জন্য ভাল কাজ পাঠাও। তিনি আরো বলছেন, তোমরা যদি অন্যায় কর, জুলুম কর তাহলে তোমরা আল্লাহ বা অন্য কারোর কোন ক্ষতি করবে না, বরং তোমরা তোমাদের নিজেদেরই ক্ষতি করবে।

আল্লাহ বলছেন, তোমরা তোমাদের আত্মার প্রতি জুলুম কর না, তোমাদের আত্মাকে ধ্বংস করো না। কুরআনে আল্লাহ খুব চমৎকার একটা রূপক ব্যবহার করেছেন। সেটি হল এরকম যে, তারা যখন কোন অন্যায়-অত্যাচার, খারাপ কাজ করে, তখন তাদের আত্মার অবস্থা হয় এরকম যেন একটি টর্নেডো এসে একটি শস্যক্ষেত্রকে লন্ডভন্ড করে গেল। আরেকটি চমৎকার রূপক আছে কুরআনে। উর্বর ভূমি থেকে বিভিন্ন ধরনের শস্য বের হয়ে আসে।

কিন্তু অনূর্বর ভূমি থেকে তেমন কিছুই বের হয়ে আসে না। আমাদের আত্মার অবস্থা হবে অনেকটা এরকম। কাজেই আমাদের ভিতর চমৎকার সব গুণাবলীগুলোর সুপ্ত যে প্রতিভা আছে তাকে লালন করে বিকশিত করা হচ্ছে এই পৃথিবীর জীবনের উদ্দেশ্য। এবার একটা ব্যাপার চিন্তা করে দেখি। যে সব গুণাবলীর কথা বলা হল সেগুলোর সবচেয়ে বেশি ধারক কে? কার কাছে এই গুণগুলো সবচেয়ে বেশি আছে? কার এই গুণাবলীগুলো নিখুঁত এবং অসীম? তিনি আল্লাহ! আমরা যদি এই গুণগুলোকে বিকশিত করতে চাই তাহলে আমাদেরকে টার্গেট করতে হবে আল্লাহকে, কোন মানুষ বা শয়তান বা কোন বস্তুকে নয়।

আল্লাহকে অনুসরন করতে হবে। আল্লাহ মানুষকে তার অবয়বে তৈরি করেছেন এই অর্থে যে, আমরা আল্লাহর অসীম সব গুণাবলীগুলোকে শেয়ার করতে পারব, আয়ত্ব করতে পারব। আল্লাহর এই গুণাবলীগুলোকে অর্জন করে আমরা আল্লাহর কাছাকাছি যেতে পারব। এই ক্ষমতা আমাদের ভিতরে দিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা আল্লাহর প্রতিনিধি।

এখন আমাদের সহজাত এই প্রবৃত্তিকে আমরা মেনে নেব কি নেব না? আমরা কি আমাদেরকে গড়ে তুলব না আমাদেরকে ধ্বংস করব? এবার ঈমান নিয়ে চিন্তা করা যাক। ঈমান এর বিপরীত হল কুফর। কাফারা করা মানে হল অবিশ্বাস করা, অস্বীকার করা, অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ইত্যাদি। ঈমান আনা হল বিশ্বাস করা, স্বীকার করা, বিশ্বস্ততা প্রকাশ করা। আমি এটাকে এভাবে দেখি।

ঈমান আনা হল আমাদের যে সহজাত প্রবৃত্তি আছে তাকে স্বীকার করা, আমাদের উপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, যে আমানত দেয়া হয়েছে সেটাকে রক্ষা করার অঙ্গীকার করা, আমাদের ধ্যান-জ্ঞানকে আল্লাহমুখী করা, আল্লাহকে আমাদের জীবনের লক্ষ্য করা, আমাদের এবং আল্লাহর মাঝা সরল রাস্তা তৈরি করা, আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়া। আর ঈমানের বহি:প্রকাশকে আমি বলি ইবাদাত। এবার ঈমানের প্রভাব নিয়ে চিন্তা করা যাক। একজন মানুষ যদি তার দৃষ্টিকে শুধু তার নিজের ভিতর সীমাবদ্ধ রাখে, তাহলে তার সচেতনতা, সজ্ঞানতা থাকে অনেক সীমিত। সে তখন নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বুঝে না।

সে নিজেকে একটি সীমিত গন্ডির ভিতর আবদ্ধ করে রাখে। লোভ-লালসা, অহংকার ইত্যাদি শৃঙ্খল দ্বারা নিজেকে বেধে রাখে। তার অবস্থা হয় অনেকটা এরকম যে সে দেখেও দেখতে পারে না, শুনেও শুনতে পারে না। আল্লাহ তাদের কথা বলছেন যে, তারা বধির, বোবা এবং অন্ধ। সে এই পৃথিবীর জাকজমক দেখে প্রতারিত হবে, সে থাকে প্রচন্ডরকমের এক ধোঁকার ভিতরে।

এখন কেউ যদি তার দৃষ্টিকে এই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দিকে নিয়ে যায় তাহলে তার সচেতনতা, সজ্ঞানতা হবে অনেক বিস্তারিত। সে তখন সবকিছু দেখার, বুঝার, শোনার চেষ্টা করবে। সে যখন আল্লাহর বিভিন্ন গুণাবলীগুলো চিন্তা করবে এবং সেগুলোকে নিজের ভিতরে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। তার ভালবাসা, দয়া, উদারতা, সৌজন্যবোধ তখন শুধু নিজের এবং তার আশেপাশের গুটিকয়েক মানুষ বা বস্তুর ভিতর সীমাবদ্ধ থাকবে না। তার ভালবাসা হবে সুদূর প্রসারিত।

সে সবাইকে সমানভাবে ভালবাসবে, সবার প্রতি দয়া দেখাবে। শুধু তার পরিবার ও আত্মীয়দের প্রতি না, শুধু মানুষের প্রতি না, সমগ্র সৃষ্টির প্রতি তার ভালবাসা, দয়া, উদারতা ইত্যাদি প্রসারিত হবে। আল্লাহর জন্য অন্যকে ভালবাসা বলতে আমি এটাকেই বুঝি। এবার সূরা ফাতিহার প্রথম পাঁচটি আয়াতের প্রতি মনোযোগ দেয়া যাক। পরম দয়ালু ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।

১। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টিজগৎসমূহের রব(পালনকর্তা)। ২। তিনি পরম দয়ালু ও অসীম করুনাময়। ৩।

তিনি বিচারদিবসের মালিক। ৪। আমরা শুধু তোমার ইবাদাত করি এবং তোমার কাছে সাহায্য চাই। ৫। আমাদেরকে সহজ-সরল পথে ধাবিত কর।

প্রথম ৩ আয়াতে আল্লাহর ৩ ধরনের গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে। এই ৩ ধরনের গুণাবলী হচ্ছে প্রধান এবং এগুলো থেকে অন্যান্য গুণাবলীগুলো চলে আসে। প্রথম গুণ হল, পালনকর্তা। যে ঈমান এনেছে, সে নিজেকে পালনকর্তা হিসেবে গড়ে তুলবে। সে তার আশেপাশের মানুষ, বস্তু, পশু-পাখি, গাছপালা সবাইকে প্রতিপালন করার চেষ্টা করবে।

সবাইকে সে যত্ন করবে। দ্বিতীয় গুণ হল, দয়ালু ও করুনাময়। একজন মুমিন হবে সবার প্রতি দয়ালু ও করুনাময়। তৃতীয় গুণ হল, বিচারের মালিক। একজন মুমিন বিচারের ক্ষেত্রে হবে আপোসহীন, সুবিচারের প্রতি থাকবে সে কঠোর যদিও তা তার নিকট আত্মীয়ের বিরুদ্ধে হয়।

৪র্থ আয়াত হল আমরা শুধু আল্লাহকে অনুসরন করব, আল্লাহর দিকে নিজেদের ধাবিত করব, আল্লাহকে আমাদের সামনে রাখব এবং তার কাছে সাহায্য চাব। আর ৫ম আয়াত হল আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। উপরে গুণাবলীগুলো আমরা আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে, আল্লাহকে অনুসরন করে অর্জন করব এবং এভাবে আমরা আল্লাহর কাছে যাওয়ার রাস্তায় নিজেকে নিয়ে যাব। কত চমৎকার এই সূরা! প্রতিদিন কমপক্ষে ১৭ বার এটিকে স্মরণ করলে আর কিছুর কি প্রয়োজন আছে? কুরআনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একজন মুমিন নিজেকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে যায় যে, সে তখন অন্যের জন্য তাই ভালবাসে যা সে নিজের জন্য ভালবাসে। নিচের ঘটনাটা খেয়াল করি।

ঘটনা: এক সাহাবী তার সঙ্গীসহ বাজারে গিয়েছেন। সে এক দোকানের সামনে গিয়ে একটা জিনিসের দাম জিজ্ঞাসা করল। দোকানদার তাকে বলল যে, জিনিসটার দাম ৫ দিরহাম। সাহাবী তখন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল যে, আমাকে এটি ৭ দিরহামে দিবেন? দোকানদার বলল যে, অবশ্যই দিব, আমি তো এটাকে ৫ দিরহাম দিয়েই দিতে চাই। তখন সাহাবী আরো কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল যে, এটা আমাকে ৮ দিরহামে দিবেন? দোকানদার তাকে একি উত্তর দিলেন।

এভাবে সাহাবী শেষপর্যন্ত ১২ দিরহাম দিয়ে জিনিসটা কিনলেন। তার সঙ্গী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, যে জিনিসটা ৫ দিরহামে কেনা যেত সেটা কেন আপনি ১২ দিরহাম দিয়ে কিনলেন? সাহাবী তাকে উত্তর দিলেন, আমি চিন্তা করে দেখলাম যে, আমি যদি জিনিসটার মালিক হতাম তাহলে ১২ দিরহাম দিয়ে বিক্রী করতে পারলে আমি খুশি হতাম, তাই আমি ১২ দিরহাম দিয়ে জিনিসটা কিনেছি। একজন মুমিন হবে এরকম। আমরা সবাই বেহেশতে যেতে চাই। অনেকে বেহেশতে যাবার জন্য এতই পাগল থাকে যে, যদি কারো কারনে তার নামাযের ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে তাকে মারধোর করতে পর্যন্ত দ্বিধা করে না( বাংলাদেশের পত্রিকায় পেয়েছি)।

আমি এখানে বলে রাখি, ততক্ষণ পর্যন্ত কারো ঈমান পরিপূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে চাবে যে, তার ভাই তার আগে বেহেশতে যাক। ঈমানের স্বাদ যে পেয়েছে তার কাছে পৃথিবীর সবকিছু অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই পৃথিবীর লোভ-লালসা, অর্থ-সম্পদ, গাড়ি, বাড়ি দ্বারা সে আর আকৃষ্ট হয় না। নতুন কোন পণ্য বাজারে বের হলেই সে সেটাকে কেনার জন্য পাগল হয় না। লোক দেখানোর জন্য সে কোন কাজ করে না।

অন্যেরা তাকে সম্মান করুক, তার প্রশংসা করুক, তার সিজদা করুক সেটাও সে চায় না। কে তার উপকারে আসবে আর কে তার উপকারে আসবে না এইসব আর তার মাথাব্যথার কারন না। তার ধ্যান-জ্ঞান থাকে শুধু আল্লাহ। একজন মুমিন ব্যক্তির চরিত্র হল অসাধারন যা আমরা বেশিরভাগ সময়ই চিন্তা করতে পারি না। আর মুমিন হবার জন্য দরকার কুরআনের জ্ঞান।

তবে এ কথা বলছি না যে, কুরআন না পড়লে মুমিন হওয়া যাবে না। আমি এমন মানুষ দেখেছি যারা তাদের মত করে স্রষ্টাকে পাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে যারা কুরআনের সন্ধান পেয়েছে, তারা যদি কুরআন থেকে জ্ঞান লাভ করতে না পারে, তাহলে সেটা হবে খুবি আফসোসের বিষয়। কুরআন তোতা পাখির মত আবৃতি করার জন্য না, এটা জ্ঞান লাভের জন্য। আসুন আমরা কুরআন পড়ি, নিজেদেরকে আল্লাহর পথে প্রতিষ্ঠিত করি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।