চলতাছে আরকি
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুদের অন্তরে—সম্প্রতি বাবা হবার পর এই অনুভূতিটাই আমার হচ্ছে। ফলে আমার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে অনাগত সকল বাবাদের জন্য এই সিরিজটা লিখছি-
মানব সন্তান জন্ম দেয়া প্রকৃতিগতভাবে মায়ের কাজ। মা-ই আসলে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে, সমস্ত কষ্ট সহ্য করে এবং শারীরিকভাবে মাকেই পুরো ধকলটা নিতে হয়। আসলেও ব্যপারটা অনেক বিস্ময়কর। একটা শরীরের মধ্যে বেড়ে উঠছে আরেকটা শরীর।
সে একদিন পৃথিবীর আলোর মুখ দেখবে। যেহেতু মানুষকে তার জিন টিকিয়ে রাখতে হবে, তার বংশগতি-র ধারাকে রক্ষা করে যেতে হবে, সেহেতু তার জন্মক্ষণকে পুরো মানবজাতির আরেকটা মাইলস্টোন হিসাবে ধরা হয়। একটা শিশুর জন্ম শুধু তার পরিবারের ব্যপার নয়, এটা গোটা মানবজাতির জিনপুল-কে বহন করে নেবার মিশন। কাজেই শিশুদের এবং নারীদের সভ্য দেশসমুহে এত গুরুত্ব দেয়া হয় কিংবা প্রোটেকশন দেয়া হয়। নারী এবং শিশুর জন্য যুদ্ধ-শান্তি উভয় সময়েই আলাদা করে খেয়াল রাখতে হয়।
যেকোন প্রজাতির প্রথম উদ্দ্যেশ্যই হল তার জিনপুল-কে ঠিক ঠাক করে এগিয়ে নেয়া। তার জন্য যত প্রচেষ্টা, যত তিতিক্ষা আর ত্যাগ স্বীকার করতে হয় – এবং হবে। এই জিনপুলকে বার বার রিপ্রোডাক্ট করার মধ্যেই নিহিত আছে প্রজাতির ভবিষ্যত- তার বিবর্তন আর উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়া। আর তাই আমাদেরো বলতে হয়- “এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান”।
এখনো পর্যন্ত মানব শিশু জন্ম দেয়ার ব্যপারে নারীদেহই সবচেয়ে ব্যবহৃত মাধ্যম।
কাজেই নারীদের আলাদা করে আমাদের দেখার ব্যপার রয়েছে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের একটা গরীব মুসলিম দেশে নারীদের সাধারণ এবং মাতৃত্বকালীন – কোন অবস্থাই ঠিক মত থাকেনা। শিশু এবং মাতৃমৃত্যু হার কিছুদিন আগে পর্যন্ত একটা ভয়াভহ ব্যপার ছিল। সুখের কথা, ইদানীং অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। আগে সন্তান জন্ম দেয়ার ব্যপার-স্যাপারগুলো অনেকটাই অন্দরমহলের নারীদের মধ্যকার ব্যপার ছিল- দাইমা কিংবা বয়স্কা মুরুব্বিদের হাতেই ছিল সব।
পুরুষদের সেখানে আনাগোনা খুব একটা ছিল না। সন্তানের পিতা ও খুব একটা এদিকে নজর দিতে পারত না। আজকাল অবশ্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কিছুটা পরিবর্তিত হচ্ছে। মায়ের টেক-কেয়ার থেকে শুরু করে বাচ্চার ডায়াপার বদলানো কিংবা বাচ্চাকে খাওয়ানো- অনেক কাজেই বাবারাও সক্রিয় হচ্ছে। আর এরকমই হতে হবে।
দায়িত্ব শুধু মায়ের নয়, বাবাদেরও কম নেই।
সুস্থ সন্তানের জন্য দরকার সুস্থ জন্মদান-প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, কনসিভ করার আগ মূহুর্ত থেকে বাচ্চার জন্ম পর্যন্ত প্রত্যেকটা ধাপই গুরুত্বপূর্ণ এবং সচেতন-মনিটর ও মনোযোগের দাবি রাখে- মা বাবা দুজনের জন্যই। এই একটা বছর মা-বাবাদের উচিত এই বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেয়া। এ ব্যপারে অবশ্যই প্রত্যেকধাপে ডাক্তার এবং চিকিতসাবিদ্যার নিদানগুলো অনুসরণ করতে হবে।
এর কোন বিকল্প নেই। আমি চিকিতসক নই। একজন ফার্স্ট-টাইম বাবা। কাজেই আমাদের এই আলোচনায় ডাক্তারি ব্যপার থাকবে না, কেবল অভিজ্ঞতালব্ধ করণীয় থাকবে। আবারো বলি- এরকম গাইডলাইন বা বই পড়া যায় কিন্তু শেষ বিচারে অবশ্যই ডাক্তারই এক্ষেত্রে আসল বস।
অনেকেই এখানে অভিজ্ঞ বাবা আছেন, আমার পন্ডিতি তাদের জন্য নয়, বরং যারা হবেন তাদের জন্য। অভিজ্ঞ বাবারাও এই আলোচনায় অংশ নিতে পারেন, কারণ শুধু আমার একার একটি বাচ্চার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই যথেষ্ট নয়। আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা পুরো প্রক্রিয়াটাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে নিতে পারি।
পর্ব ১- বিয়ে-শাদী, ইটিশ-পিটিশ, অতপরঃ
শেষ পর্যন্ত আপনি ফাইস্যাই গেলেন অর্থাৎ বিয়ে করে ফেললেন। ইটিশ পিটিশ ও হচ্ছে।
যদি লাভ ম্যারেজ হয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই, হয়ত বিয়ের আগেই বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরেঞ্জড ম্যারেজ হলে একটু টাইম নেন। কিছুদিন পর বিষয়টা নিয়ে ভাবীর সাথে আলোচনা করুন। কিছু ভাবনার পয়েন্ট আছে। কবে নিতে চান? এখনি নাকি ২/৪ বছর পরে।
নিজের ক্যারিয়ার, ভাবির অফিস, পারিবারিক অবস্থা, সামনের কয়েকবছরের পরিকল্পনা এসব মাথায় রেখে ঠিক করুন কবে বাবা হতে চান। ২/১ বছর সময় অন্তত নিন বিবাহিত জীবনে সেটেলড হবার জন্য। ‘ধর তক্তা মারো পেরেক’ করার দরকার কি? কারণ লাভ কিংবা এরেঞ্জড, যাই হোক না কেন, বিবাহিত জীবনের প্রথম দুএক বছর একটা সার্কাসের মত—আত্মীয়দের আত্মীয়গিরি, ঝগড়া- মারামারি, শরীর-মনের খোড়াখুড়ি, বেড়ানো এসব হবে- তারপর আস্তে আস্তে থিতু হয়ে উঠবেন-তখন বাকী চিন্তা। এমনকি জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কোনটা স্যুট করছে দেখে নিন। (তেতুল শফি যতই বলুক হারাম, জন্ম নিয়ন্ত্রণ জরুরি ব্যপার)।
সুস্থ মা-বাবাই পারে সুস্থ বাচ্চার জন্ম দিতে। কাজেই দেখে নিন দুজনেই সুস্থ আছেন কি না। মা কি এই মুহুর্তে এই ধকল নিতে পারবে কিনা। ডায়াবেটিস, এনিমিয়া, ব্লাড প্রেসার কিংবা অন্য ক্রনিক ডিজিস আছে কিনা পরীক্ষা করে নিন। থাকলে আগেই যথা সম্ভব চিকিতসা করে নেয়া উচিত।
অর্থ-কড়ি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার। কন্সিভ করার মুহুর্ত থেকে সন্তান জন্মদানের কয়েক মাস পর্যন্ত বেশ খরচাপাতির ব্যপার আছে। ৯ মাসের মেডিক্যাল চেকাপ, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ওষুধ পথ্য, হাসপাতাল খরচ, শিশুর খরচ, শিশুর কোন জটিলতা থাকলে তার ডাক্তার—এসব বেশ খরচ স্বাপেক্ষ। ভালো ডাক্তার এবং মেডিক্যাল ফ্যাসিলিটিস নিতে হলে আপনার একটা আর্থিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত। সেটা কত? জটিলতা-ডাক্তার-হাসপাতাল ভেদে এই খরচ ৫০ হাজার থেকে ৩/৪ লাখ হতে পারে।
এ বিষয়ে পরের পর্বে আরো বিস্তারিত আলোচনা থাকবে। কাজেই কন্সিভ করার আগে এই বিষয়টাও ভেবে দেখতে হবে।
ধরে নিচ্ছি কিছুদিন পর আপনারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সন্তান নেবার। এবার বিবেচনা করুন সময়। চেষ্টা করুন এমন একটা সময়ে কন্সিভ করতে যাতে জন্মের সময় আবহাওয়া ভালো থাকে।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর কিংবা ফেব্রুয়ারি-মার্চ জন্মের জন্য ভালো- না বেশি শীত, না বেশি গরম। বাচ্চার সারভাইভালের জন্য ভালো। না হলেও অসুবিধা নাই। অনেক সময় আপনি আগে থেকে বুঝতে পারবেন না ঠিক কখন শুক্রাণু ডিম্বানুকে আঘাত করল।
সাধারণত পরবর্তী ম্যানুস্ট্রেয়শনের সময়েই বুঝে ফেলবেন যে আপনার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা।
সেরকম মনে হলে বাজার থেকে প্রেগনেন্সি টেস্টের কিট কিনে নিয়ে আসুন। প্রেগাটেস্ট, প্রেগা নিউজ—এরকম বেশকিছু কিট বাংলাদেশে পাওয়া যায়। দাম ৬০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে। প্রাথমিকভাবে ঘরেই নিশ্চিত হয়ে নিন। গর্ভবতী হবার লক্ষণসমুহ জেনে নিন।
এবং নিশ্চিত হয়ে নিন যে আপনার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। এখানেই শেষ নয়। পরবর্তী পর্বসমুহ আসছে।
পরবর্তী পর্বসমুহে যে আলোচনাগুলো থাকবে—
পর্ব ২।
শরীর-মনের কেমিস্ট্রি—গর্ভধারনের পর পর নারীর দেহ-মনের পরিবর্তন এবং হবু বাবা হিসাবে আপনার করনীয়
পর্ব ৩। নলেজ ইজ পাওয়ার—কোন ধরনের বই, আর্টিক্যাল বা ওয়েবসাইটে ভালো তথ্য পাবেন।
পর্ব ৪। ডাক্তার আপা--কোন ডাক্তার, কি টেস্ট, কোন হাসপাতাল, নর্মাল না সিজার?
পর্ব ৫। তিনটি ট্রিমিস্টারঃ ৯ মাসে ৩ টি পর্ব – কোন পর্বে কি করনীয়
পর্ব ৬।
ফুড ইস গুড- মায়ের খানাখাদ্য, বাপের বিদ্যা-বাদ্য।
পর্ব ৭। নতুনের আয়োজনঃ কি কি কেনাকাটা করে রাখবেন? হাসপাতেলের জন্য কি কি লাগবে?
পর্ব ৮। কুসংস্কারসমুহ এবং তাদের প্রতিরোধ
পর্ব ৯। জন্ম এবং অতঃপর।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।