চোখ মেলে পাইনি,চোখ বুজে পেতে তো মানা নেই...
ঘুম। দুই অক্ষরের এতটুকুন একটা শব্দ। অথচ প্রধাণ উপদেষ্টা থেকে রাস্তার ফকির, এমন কাউকে খুজে পাওয়া যাবেনা যার জীবনে ঘুম জিনিসটা আকাঙ্ক্ষিত নয়। ভার্সিটি জীবনে এর বিস্তার মনে হয় আরো বেশি। কত ক্লাস আর ক্লাসটেস্ট যে ঘুমের জন্যে অবলীলায় বিসর্জন দিয়েছি তার হিসাব নেই।
মানুষ নাকি দিনে কাজ করে আর রাতে ঘুমায়। কিন্তু ভার্সিটিতে দেখি আমার বেশ কিছু ক্লাসমেট(মাঝে মাঝে আমি সহ) দিনেও ঘুমায় রাতেও ঘুমায়। সেই অর্থে ওরা মানুষ কী না সেই বিতর্কে না গিয়ে বরং ঘুম প্রিয়তার কথাটাই শুধু ভেবে দেখি।
ক্যাডেট কলেজে এত বেশি মাত্রায় ঘুমানোর কোন পথ খোলা নেই। কিন্তু যতটূকু আছে তা লুফে নেয়নি এমন বোকা খুজে পাওয়া খড়ের গাঁদায় সূচ খোঁজার মতই।
রাতের বেলা পৌনে এগারোটা থেকে ক্যাডেট কলেজে ঘুমানোর সময় শুরু। যাকে লাইটস অফ বা লাইটস আউট বলা হয়। প্রচলিত আছে ক্যাডেটদের দিন শুরু হয় নাকি রাত থেকে। তাই লাইটস অফের পর থেকে শুধু ঘুমানোর রাজত্ব এমনও কিন্তু নয়। বরং বলা যায় এ সময়ে ঘুম আর জাগরণ এক সাথে জড়াজড়ি করে থাকে।
সেভেন থেকেই শুরু করি। ক্লাস সেভেনে এত কষ্ট স্বত্বেও শুধু একটা কারণের জন্য মনে হয় ঐ সময়টাতেই আমি সবচেয়ে সুখী মানুষ ছিলাম। ঘুম। নভিসেস ড্রিল প্রাকটিস এ মরার মত খাটুনি,ক্লাস করে এনার্জি লস আর সিনিয়রের ফাই ফরমায়েশ পর্ব শেষ করে যখন থার্ড প্রেপ এর পর রুমে আসতাম বিছানায় ঠিক মত শুয়ে পড়ার আগেই দু চোখ ভেঙ্গে ঘুম নামতো। তথাকথিত ডিম লাইটের হাজার ওয়াটতূল্য আলো তখন আমলেই আসতোনা।
আহারে… আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!!
ক্লাস এইটে উঠে একটু অন্যরকম ভাব। এপুলেটে একটা দাগ বৃদ্ধি আর পায়ের নিচে(ক্লাস এইটে দোতলায় থাকতাম) নতুন আরেকটা ব্যাচ। এত তাড়াতাড়ি ঘুমালে কি আর সিনিয়র হওয়া যায় নাকি। ডিম লাইটের উপরকার লাল নীল রঙ ব্লেড দিয়ে চেছে একেবারে ন্যাড়া করে ফেলা হল যাতে লাইটস অফ এর পরেও গল্পের বই পড়া যায়। সেই লাইট লাগানোর পরে দেখা গেল এটাকে এখন ডিম লাইট না বলে ফ্লাড লাইটও বলা যায়।
পুরা রুম একেবারে ফকফকা। তখনতো কেবল উঠতি বয়স। তিন গোয়েন্দার চেয়ে মাসুদ রানার ওয়ালথার পি পি কে ই কাছে টানে বেশি। সাথে হুমায়ুন আহমেদ কিংবা লাইব্রেরি থেকে ইস্যু করে আনা কোন বই। ঘুম বাদ দিয়ে জেগে জেগে বই পড়াটা তখন অসম্ভব প্রিয়।
সবাইতো আর বইয়ের পাগল ছিলোনা। অনেকে দেখা যেত কারো বেডে বসে বসে গল্প করছে লাইটস অফের পর। চেয়ার থাকতেও চেয়ারে বসতোনা কেউ। মাত্র তো তখন নিজের বেড ছাড়া অন্যের বেডে বসার পারমিশন পেয়েছি। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে কেউ কার্পণ্য করতোনা।
এই দুই প্রজাতি ছাড়া আরেকটা গ্রুপ ছিল যারা জিনিয়াস সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা ডিম লাইটের নিচে চেয়ার টেবিল টেনে এনে টেক্সট বইয়ে নাক মুখ গুজে থাকতো। গল্পের বইয়ের একটা করে পাতা উল্টাই আর ওদের দিকে একবার করে তাকাই। ইশ্… আমি কেন ওদের মত হতে পারিনা!! কি আর করা, ওদের মত না হবার দুঃখ ভুলতে আবার গল্পের ভেতর ডুব দেই।
ক্লাস নাইনে ওঠার পর থেকে নিজেদের রুম এ নিজেরাই রাজা।
রুম লীডার হিসেবে কোন সিনিয়র নেই। তখন থেকে লাইটস অফ এর পর যার যার বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুম বাদ দিয়ে গ্যাজানোর শুরু। বাইরে নাইট গার্ডের থেমে থেমে হাঁক ছাড়ার শব্দ আর ভেতরে অন্ধকার রুম জুড়ে দশটা মানুষের কথা ভেসে বেড়াতো অনেক রাত পর্যন্ত। আজ কোথায় সেই অন্ধকার রুম আর কোথায়ই বা রুমের মানুষগুলো। পুরোনো দিন(কিংবা রাত) গুলোর কথা ভেবে এখনো কত বিনিদ্র রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করি।
ক্লাসটেনে উঠে নতুন হুজুগ শুরু। দিনে রুম ক্রিকেট খেলেও পোলাপানের শখ মিটেনা। ঘুম বাদ দিয়ে লাইটস অফের পর ডিম লাইটের ফ্লাড লাইট সুলভ আলোয় খেলার আয়োজন করা হল। রীতিমত প্রাইজসহ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। দুই জনের এক একটা টীম।
পিং পং বল আর দেড় লিটার সেভেন আপ এর বোতলের জমজমাট লড়াই। প্রথম প্রথম আমি বেডে শুয়ে শুয়ে ওদের কার্যকলাপ দেখতাম আর এরকম ছেলে মানুষীর একশ একটা অনর্থ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়তাম। পরবর্তীতে সেই ছেলেমানুষীর কোন অর্থ খুজে পেয়েছিলাম কীনা আজ আর মনে পড়েনা। তবে কয়েকদিন পরেই আমি আর মোরশেদ মিলে একটা টিম হিসেবে সেই টুর্নামেন্টে নাম লিখিয়েছিলাম।
এস এস সির সময়েতো আরেক মজা।
ক্যান্ডিডেটস টাইম। এর আগে যতই বান্দরামি করি এখন তো অফিসিয়ালি এস এস সি পরীক্ষার্থী। লাইটস অফের পর রাত জেগে জেগে পড়াশুনা করে জ্ঞানী হবার চেষ্টা করি আর বই একটা হাতে করে করিডোর ধরে আমি কি হনুরে ভাব নিয়ে জুনিয়রদের চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে ঘুরে পড়ি। এ সময়টাতে সবাই দেখি বাসা থেকে ফ্লাস্ক নিয়ে এসেছে। রাত জেগে পড়া, সে তো ম্যালা খাটুনির ব্যাপার।
ডাইনিং হল থেকে ফ্লাস্কে করে গরম পানি এনে হরলিক্স কিংবা কফি বানিয়ে না খেলে কিছু হল নাকি। আর এই জন্যেই সবার ফ্লাস্ক আনা। প্রত্যেক দিন দেখতাম নাসির আর ইরাদ সবার আগে লাইটস অফের পর করিডোরে টেবিল এনে হেভী মনযোগ দিয়ে পড়া স্টার্ট করতো। কিন্তু একটু পরেই দেখা যেত বই খাতা সামনে খুলে রেখে পড়াশুনার বাইরের রাজ্যের আলাপ ওদের দুজন থেকে ছড়াতে ছড়াতে আমাদের মাঝেও সংক্রমিত হত।
ক্লাস ইলেভেন।
রাজার আমল। নতুন গ্রুপের উদ্ভব মাত্র। ইনারা লাইটস অফের পর তিন তলায় যাবার জন্য থার্ড প্রেপের পর থেকেই হাত কচলানো শুরু করেন। আমিও টুয়েলভথ ম্যানের মত মাঝে মাঝে যোগ দিতাম। সাপ্লাই এর সমস্যা না থাকলে গোল্ড লীফ।
আর আকালের যুগে নেভী চলতো। তিন তলায় সিঁড়ির চিপায় বসে উদাস হয়ে ধোঁয়া ছাড়তাম। ধোঁয়ার কুয়াশায় মুখ ঢেকে হঠাৎ করে মনে হত এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছি।
কলেজে থাকতে অনেক কিছুই ভাল লাগেনি। অনেক ব্যাপারই অসহ্য মনে হত।
কিন্তু ক্লাস টুয়েলভে উঠে আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম কলেজের এইসব অসহ্য ব্যাপারগুলো ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে গিয়ে মাঝে মাঝেই নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছি। লাইটস অফ এর পর পোর্চে বসে ফেলে আসা পাঁচটা বছর যত্ন করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবতাম। প্রতি বৃহস্পতিবার ডাইনিং হল থেকে স্পেশাল ডিনার এনে রাখা হত। পোর্চে শুয়ে শুয়ে গ্যাজানোর পর ক্ষুধা লেগে গেলে তখন সেটা সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খেতাম। ক্লাস টুয়েলভের শেষ এর দিকে সেভেন আপ পার্টির কথা ভোলার নয়।
কুপন চাঁদা তুলে বিকেল বেলাতেই ক্যান্টিন থেকে সেভেন আপ এনে রাখতাম। মাথাপিছু পাঁচটা কিংবা ছয়টা করে পড়তো সবার। সাথে পটেটো ক্রেকার্স কিংবা চানাচুর। মাকসুদ এর কাছ থেকে ধার করে আনা রেডিওতে ইন্ডিয়ান এফ এম চ্যানেল চলতো সেই সাথে। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকানোর পর কম্বল পেতে পোর্চেই শুয়ে পড়া।
চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা কয়েক জোড়া স্বপ্নালু চোখে তারা ভরা আকাশ উপুড় হয়ে নেমে আসতো। পাশেই অন করে রাখা রেডিওতে বেজে চলতো আমাদের প্রিয় প্রোগ্রাম “রাত বাকি বাত বাকি”। কলেজের মত অমন তারা ঝকঝকে আকাশ এখন আর অমন করে শুয়ে শুয়ে দেখা হয়না। তখন তারা দেখতে দেখতে বাসার কথা ভাবতাম। আর এখন বাসার বারান্দায় বসে পূর্ণিমা দেখতে দেখতে কলেজের কথা ভাবি।
দিনগুলো কেমন করে চলে যায়। কলেজের সব কিছুই মিস করি। দিনের ব্যাস্ততা থেকে রাতের নির্জনতা-সব কিছু। তবুও লাইটস অফের পরের জীবনটা একটু আলাদা ভাবনা হয়েই মনে আসে। ক্যাডেট মাত্রেই এমন হয়।
কোন সন্দেহ নেই।
কলেজে ছেড়ে চলে এসেছি বেশ কয়েকবছর হল। ভার্সিটি জীবনে এসে নিয়মিতই রাত জাগা হয়। এখন তো বেশ বড়ই হয়ে গিয়েছি। যত রাতই জাগি না কেন খবরদারি করার মত কেউ মাথার উপরে নেই।
তবুও লাইটস অফের পরের সেই অনুভূতি আজো অন্যরকম লাগে। সেটা ঠিক এখনকার সময়ে রাত জাগার আটপৌরে অনুভূতির মত নয়। হাউস বেয়াড়া মনির ভাইয়ের কন্ঠ এখনকার রাতগুলোতে আর দাপড়ে বেড়ায়না আগের মত। বোধ হয় এজন্যই । “কি ব্যাপার? এখনো লাইট অফ করেন নাই? সেই কখখ্ন লাইটস অফের বেল পইড়া গ্যাসে।
হাউস মাস্টার রে ডাকতে হইবো নাকি?”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।