বন্ধ জানালা, খোলা কপাট !
**২০০৩-এর শেষের দিকে সম্ভবত এম ভি নাসরিন মেঘনার বুকে তলিয়ে গিয়েছিল । সাথে নিয়ে গিয়েছিল অনেক মায়ের সন্তান, অনেক সন্তানের পিতাকে । এই অনুগল্পটি সেই সময়ে লিখিত ।
২০০৮-এর শুরুতে আজ আবার মুন্সিগঞ্জে ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ হলো মানুষ । দুর্বৃত্ত যাত্রাপথের কবলে নিজেদের হারিয়ে ফেলা সেইসব মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য...।
**
এক
কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো সুমুর । সুমুর বেলায় এরকমটা হয় না । ওর ভোর হয় সকাল ন'টায় । কিন্তু আজ হয়েছে । আজ একটু অন্যরকম, ব্যতিক্রম ।
আজ সুমুর বিশেষ দিন ।
কি যে আনন্দ হচ্ছে সুমুর । ভীষণ আনন্দ । মনে হচ্ছে, সে আসলে মানুষ না, পাখি ! ডানাওয়ালা পাখি ! ডানামেলে উড়ছে আকাশ হতে আকাশে । বাতাসে-বাতাসে ।
আজ দিনটা ভাল কাটবে তার । ভীষণ ভাল । কতোদিন পর মাকে দেখতে পাবে আজ । ক-তো-দি-ন পর !
গেল মাসে মা'কে চিঠি লিখেছিল সুমু,-
মা ! মাগো !
তোমার ঘরকোণো ছেলেটা আসছে আর ক'টা দিন পর । আসছে তোমার কোলের কাছে বসে তোমার হাতে ভাতের গ্রাস খেতে ।
তোমার আঁচলে মুখ মুছতে । তোমার কোলে মাথা রেখে নির্ভরতার ঘুম দিতে । আর...? আর দশ - বিশটা টাকার জন্য রোজ তোমার পাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে !
আমার লক্ষ্মী মা ! এরকম যন্ত্রণা করলে তুমি কি, তোমার অবুঝ ছেলেটার 'পরে রাগ করবে খুব ?
ক'দিন পর যথারীতি মায়ের উত্তর পেয়েছিল সুমু । তার অসম্ভব ভাল মা'টি লিখেছিল,-
আমার চোখের মণি; বাছারে !
পড়ালেখার জন্য তোকে ঢাকায় পাঠিয়ে, মায়ের যে কি কষ্ট, তা কি তুই বুঝিসনা ? খেতে বসলেই তোর কথা মনে পড়ে , না জানি, বাছা আমার কি খাচ্ছে ! তখন আর গলা দিয়ে নামতে চায় না খাবার । সুমু, বাপ আমার; তুইতো জানিস না, তোর হইচই নেই বলে এখন মাঝে মাঝে এই ঘরটাকে আমার গোরস্থান বলে মনে হয় ! তোর যন্ত্রণা সইবার জন্যইতো তোর এ দুঃখীনী মা পথ চেয়ে অপেক্ষা করছেরে সোনামাণিক আমার ! শিঘ্র এস মাকে একবার দেখা দিয়ে যা ।
হ্যাঁ,সুমু যাবে । মায়ের কাছে ছুট দেবার সেই কাঙ্ক্ষীত দিন আজ । দিনের আলো কমে এলেই মায়ের উদ্দেশ্যে ছুট দেবে সে ।
দুই
রাত এগারটা চল্লিশ । ঘুটঘুটে অন্ধকার মেঘনার বুক ।
সুনসান নীরবতা লঞ্চময় । দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নৌযানগুলোতে জ্বলছে পিটপিট আলো । এ যেন দূরের কোন দ্বীপে দূরের বাতিঘর । অন্ধকার মেঘনার বক্ষ চিড়ে ছুটে চলেছে এম ভি নাসরিন- এক । নাসরিনের মাস্তুলে জ্বলা সার্চ লইট থেকে ছিটকে আসা একরাশ আলোয় পথ চলছে নাসরিন ।
উত্তাল মেঘনায় টালমাটাল নাসরিন অকস্মাৎ প্রচন্ড ঘূর্ণনে কেঁপে ওঠে । সুমুর চোখের ঘুমভাব কেটে যায় । বিস্পোরিত চোখে নির্বাক সুমু দেখে তীব্র বেগে তলিয়ে যাচ্ছে নাসরিন । পলক ফেলার সময় পায় না সুমু । ঝপাস শব্দে মেঘনার জলরাশি ঢেকে দিয়ে যায় নাসরিনের ডেক ।
আগ্রাসী মেঘনার দুরন্তস্রোত দুর্বার গতীতে সুমুকে অতলান্তে টেনে নিয়ে যায় । সর্ব শক্তি প্রয়োগে একবার শুধু চিৎকার করে সুমু,-মা...!
পৃথিবীর আকাশে বাতাসে সে আর্তচিৎকার পৌঁছায় না আর !!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।